কূটনীতিকদের নিরাপত্তা প্রত্যাহার, যা আছে ভিয়েনা কনভেনশনে
বাংলাদেশে নিযুক্ত কয়েকটি দেশের রাষ্ট্রদূতদের অতিরিক্ত নিরাপত্তা প্রত্যাহার করা হয়েছে। গত ১৪ মে থেকে যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, ভারত, সৌদি আরব, অস্ট্রেলিয়া ও জাপানের রাষ্ট্রদূত এবং হাইকমিশনারের অতিরিক্ত নিরাপত্তা প্রত্যাহার করেছে সরকার। যেসব রাষ্ট্রদূত ও হাইকমিশনার বাইরে চলাচলের সময় অতিরিক্ত পুলিশি নিরাপত্তা বা এসকর্ট সুবিধা পেয়ে থাকেন, তারা এখন থেকে এ সুবিধা পাবেন না। তবে রাষ্ট্রদূতদের নিরাপত্তায় নিয়োজিত গানম্যান তাদের দায়িত্ব পালন করবেন।
পররাষ্ট্রমন্ত্রী ড. এ কে আব্দুল মোমেন বলেন, বিশেষ পরিস্থিতিতে কয়েকটি দেশের রাষ্ট্রদূতদের বাড়তি নিরাপত্তা সুবিধা দেওয়া হয়েছিল। এখন বাংলাদেশের আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি যথেষ্ট ভালো। জঙ্গি দমনে সারা বিশ্বে রোল মডেল। তাই কূটনীতিকদের বাড়তি নিরাপত্তা সুবিধা দিলে বিদেশিদের কাছে দেশের আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি ও নিরাপত্তা নিয়ে ভুল বার্তা যায়। বাংলাদেশ কোনো ভুল বার্তা দিতে চায় না।
এছাড়া কয়েকটি দেশকে বিশেষ নিরাপত্তা সুবিধা দেওয়ায় অন্য দেশও তা চাইছিল। এ কারণে এভাবে বাড়তি নিরাপত্তা দেওয়া অব্যাহত রাখা আর সম্ভব হচ্ছে না।
কূটনীতিকদের বাড়তি এ নিরাপত্তা প্রত্যাহারের পর, তা নিয়ে বেশ আলোচনা চলছে। সরকার বিষয়টি স্পষ্ট করলেও বিভিন্ন মহল এটিকে ভিন্নভাবে উপস্থাপনের চেষ্টা চালাচ্ছে। এনিয়ে ভিয়েনা কনভেনশন কী বলছে? বাংলাদেশের কূটনীতিকরাও বিশ্বের বিভিন্ন দেশে কী এ সুবিধা পান? এ বিষয়ে জানার আগ্রহ অনেকের।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, বিশ্বের বিভিন্ন দেশে দায়িত্বরত বাংলাদেশের কূটনীতিকদের বাড়তি কোনো নিরাপত্তা সুবিধা দেওয়া হয় না। বিভিন্ন দেশে নিযুক্ত বাংলাদেশের বর্তমান ও সাবেক রাষ্ট্রদূত এবং হাইকমিশনাররা জানিয়েছেন, বাংলাদেশের রাষ্ট্রদূত বা হাইকমিশনাররা এ ধরনের কোনো সুবিধা পান না।
যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্যসহ বিভিন্ন দেশে বাংলাদেশের মিশনসমূহ ও মিশন প্রধানদের বাসভবনেও কোনো পুলিশি নিরাপত্তা দেওয়া হয় না। তাদের জন্য আলাদা কোনো গানম্যানও নেই। তারা সেসব দেশে স্বাভাবিক মানুষের মতোই চলাফেরা করেন। শুধু নয়াদিল্লিতে নিযুক্ত বাংলাদেশের হাইকমিশনার গানম্যান সুবিধা পান। সার্বক্ষণিক এসকর্ট বা নিরাপত্তা সুবিধা দেওয়া হয় না। এছাড়া বাইরে অবস্থিত বাংলাদেশের মিশনসমূহে বাংলাদেশের বিশেষ কোনো জাতীয় উৎসব আয়োজনের সময় পুলিশি নিরাপত্তা চাওয়া হলেও অধিকাংশ ক্ষেত্রেই সংশ্লিষ্ট দেশের কর্তৃপক্ষ নিরাপত্তা দিতে অপারগতা প্রকাশ করে।
তারা আরও জানিয়েছেন, যুক্তরাষ্ট্রের নাগরিকরা প্রাপ্তবয়স্ক হলেই আগ্নেয়াস্ত্র বহন করতে পারেন। স্কুল-কলেজ, শপিংমলসহ বিভিন্ন পাবলিক প্লেসে গুলি ছোড়ার ঘটনা খুবই সাধারণ। প্রায়ই এ ধরনের ঘটনায় বহু লোক নিহত হচ্ছে। কয়েকজন বাংলাদেশি নিহত হওয়ার ঘটনাও রয়েছে। যুক্তরাষ্ট্রে বাংলাদেশের রাষ্ট্রদূত কোনো পুলিশি নিরাপত্তা পান না, যেটা যুক্তরাষ্ট্রের বর্তমান প্রেক্ষাপটে অত্যন্ত জরুরি।
যুক্তরাষ্ট্রের তুলনায় বাংলাদেশের আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি অনেক ভালো। পাবলিক প্লেসে জনসাধারণের ওপর গুলি চালানোর ঘটনা বাংলাদেশে প্রায় ঘটেনি বললেই চলে, যেটা যুক্তরাষ্ট্রে নিয়মিত ঘটনা। এছাড়া নিউজিল্যান্ডের ক্রাইস্টচার্চে মসজিদে গোলাগুলির ঘটনা ঘটেছিল, যার খুব কাছেই অবস্থান করছিলেন বাংলাদেশের ক্রিকেটাররা। অল্পের জন্য তারা প্রাণে বেঁচে যান।
পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা গেছে, ঢাকায় হলি আর্টিসান জঙ্গি হামলার ঘটনার পর থেকেই কিছু রাষ্ট্রদূতের উদ্বেগ ও চাহিদার পরিপ্রেক্ষিতে অলিখিতভাবে গাড়িসহ মূলত নিয়মিত ট্রাফিক মুভমেন্টের (রাস্তায় চলাচল) সহায়তার জন্য বাড়তি কিছু লোকবল (এসকর্ট সুবিধা) দেওয়া হয়েছিল।
২০০৪ সালের মে মাসে তৎকালীন বাংলাদেশে নিযুক্ত যুক্তরাজ্যের হাইকমিশনার আনোয়ার চৌধুরীর ওপর সিলেটে গ্রেনেড হামলার পর থেকে তাকে বাড়তি নিরাপত্তা দেওয়া হয়। পরে যুক্তরাজ্যের অন্য হাইকমিশনাররাও এ নিরাপত্তা সুবিধা পেয়ে আসছিলেন। বর্তমানে বাংলাদেশের আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি স্বাভাবিক ও নিয়ন্ত্রণে। তাই তাদের বাড়তি নিরাপত্তা দেওয়ার আবশ্যকতা নেই। পাশাপাশি পুলিশ বাহিনীর কার্যপরিধি বাড়ানোর জন্য এ বাড়তি সুবিধা এখন অব্যাহত রাখা যাচ্ছে না।
সূত্র আরও জানিয়েছে, বিদেশি কূটনীতিকদের জন্য এখন শুধু এসকর্ট সুবিধা তুলে নেওয়া হয়েছে। অন্য সব নিরাপত্তা ব্যবস্থা অব্যাহত থাকবে। বারিধারা, গুলশানসহ কূটনৈতিক এলাকার নিরাপত্তার জন্য পুলিশের একটি আলাদা শাখা ‘ডিপ্লোমেটিক সিকিউরিটি ডিভিশন’ তৈরি করা হয়েছে, যেখানে প্রায় ১১০০ পুলিশ কর্মকর্তা-কর্মচারী কর্মরত, যারা সার্বক্ষণিক দূতাবাস এলাকার নিরাপত্তা নিশ্চিত করছে।
উদাহরণস্বরূপ বলা যায়, মার্কিন দূতাবাস, আমেরিকান সেন্টার, আমেরিকান ক্লাব ও রাষ্ট্রদূতের বাসভবনকে কেন্দ্র করে প্রায় ২০০ জন পুলিশ সদস্য প্রতিদিন দায়িত্ব পালন করছেন। এখন শুধু যে সাতজন মার্কিন রাষ্ট্রদূতের এসকর্টের দায়িত্বে ছিলেন, তাদের প্রত্যাহার করা হয়েছে। বাকিরা দায়িত্ব পালন চালিয়ে যাবেন। পুলিশ ছাড়াও অন্য সংস্থা ও গোয়েন্দা বাহিনীর সদস্যরা তাদের দায়িত্ব আগের মতো পালন করবেন।
অর্থাৎ রাষ্ট্রদূতদের নিয়মিত যে নিরাপত্তা দেওয়া হয়, তা অটুট থাকবে। বাড়তি নিরাপত্তা সুবিধা হিসেবে যানজট এড়ানোর জন্য অতিরিক্ত যে পুলিশ তাদের দেওয়া হয়েছিল, তা আর দেওয়া হবে না। কারণ যে ধরনের পরিস্থিতির কারণে বাড়তি নিরাপত্তা দেওয়া হচ্ছিল, সেটার যথেষ্ট উন্নতি হয়েছে। সরকারের পুলিশি জনবল সংকটও রয়েছে।
সাম্প্রতিক সময় আরও বেশ কিছু দূতাবাস থেকে এসকর্ট সুবিধার জন্য অনুরোধ করার একটি প্রবণতা দেখা যাচ্ছে। এ কারণে তাদের সবার সুবিধার জন্য স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় বাংলাদেশ আনসার বাহিনীতে একটি চৌকস দল তৈরি করেছে। বিদেশি কূটনীতিকরা তাদের খরচে এ সুবিধা নিতে পারবেন।
এ প্রসঙ্গে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল বলেন, সব ভিআইপির সুরক্ষা দেবে আনসারের প্রটেকশন গার্ড রেজিমেন্ট। এ উদ্দেশ্যে আনসার ভিডিপিতে প্রটেকশন গার্ড রেজিমেন্ট তৈরি করা হয়েছে। সব ভিআইপি, মন্ত্রী, মন্ত্রীদের বাসা ও কেপিআইভুক্ত স্থাপনার নিরাপত্তার দায়িত্ব আনসারদের দেওয়া হবে। কোনো রাষ্ট্রদূত চাইলে তাদের এ সুবিধা দেওয়া হবে।
বিদেশি কূটনীতিকদের আনসার বাহিনী কীভাবে অতিরিক্ত নিরাপত্তা (এসকর্ট) দেবে, সেটিও চূড়ান্ত হয়েছে। ১৮-২১ মে’র মধ্যে নোট ভারবালের (কূটনৈতিক পত্র) মাধ্যমে দূতাবাসগুলোকে বিষয়টি জানানো হবে। ১৭ মে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে আনসার ও গ্রাম প্রতিরক্ষা বাহিনীর মহাপরিচালকের সঙ্গে বৈঠক শেষে এ কথা বলেন পররাষ্ট্র সচিব মাসুদ বিন মোমেন।
পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় থেকে যুক্তরাষ্ট্রসহ ছয়টি দেশের এসকর্ট সুবিধা প্রত্যাহার করায় এ ইস্যুতে কথা বলেছে যুক্তরাষ্ট্র। গত ১৫ মে মার্কিন পররাষ্ট্র দপ্তরের নিয়মিত প্রেস ব্রিফিংয়ে উপ-প্রধান মুখপাত্র বেদান্ত প্যাটেল কূটনীতিকদের সুরক্ষা ইস্যুতে ভিয়েনা কনভেনশন মনে রাখার পাশাপাশি মার্কিন কূটনৈতিক মিশন ও কর্মীদের নিরাপত্তা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ বলে জানিয়েছেন। যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্র দপ্তরের ওয়েবসাইটে ব্রিফিংয়ের বিস্তারিত বক্তব্য তুলে ধরা হয়েছে।
বেদান্ত প্যাটেল উল্লেখ করেন, কূটনৈতিক সম্পর্কের ভিয়েনা কনভেনশন অনুসারে, যে কোনো দেশকে অবশ্যই সব কূটনৈতিক মিশন প্রাঙ্গণ ও এর কর্মীদের সুরক্ষা নিশ্চিত করার জন্য বাধ্যবাধকতা মেনে চলতে হবে। কর্মীদের ওপর কোনো আক্রমণ প্রতিরোধ করার জন্য কার্যকর সব পদক্ষেপ নিতে হবে। তাদের কূটনৈতিক কর্মী ও স্থাপনার নিরাপত্তা এবং সুরক্ষা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।
বাংলাদেশে ভিয়েনা কনভেনশন মেনেই সবসময় কূটনীতিকদের নিরাপত্তা দেওয়া হয়েছে এবং ভবিষ্যতেও দেওয়া হবে বলে জানিয়েছে সরকার। ভিয়েনা কনভেনশন শুধু ছয়টি দেশের জন্য নির্ধারিত নয়। সব দেশের কূটনীতিকদের জন্যই সমান। ভিয়েনা কনভেনশন এসকর্ট সুবিধা দিতে বলে না, নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে বলে।
নিরাপত্তা নিশ্চিতের বিষয়টি একেক দেশের জন্য একেক রকম। তাই বাংলাদেশে ছয়টি দেশের রাষ্ট্রদূতদের এসকর্ট প্রত্যাহারে কূটনীতিকদের নিরাপত্তায় ভিয়েনা কনভেনশনের কোনো ব্যত্যয় ঘটবে না বলে জানিয়েছে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়।
এএএইচ/এসএইচএস/জেআইএম