ডাচ্-বাংলার টাকা ছিনতাই
দুই মাসেও হদিস মেলেনি বাকি ৩ কোটি টাকার
বুথে নিয়ে যাওয়ার পথে ডাকাতির কবলে পড়ে সোয়া ১১ কোটি টাকা খোয়া যায় ডাচ্-বাংলা ব্যাংকের। এখন পর্যন্ত চার দফা অভিযানে উদ্ধার হয়েছে ৮ কোটি ১০ লাখ ৫ হাজার ৫০০ টাকা। উদ্ধার করা হয়েছে ২০ লাখ টাকা মূল্যের একটি মাইক্রোবাসও। গ্রেফতার হয়েছেন ঘটনার মূল পরিকল্পনাকারী দুজনসহ মোট ১৩ জন। দুই মাস পেরিয়ে গেলেও এখনো হদিস মেলেনি বাকি তিন কোটি ২০ লাখ টাকার। অধরা রয়ে গেছেন আরও তিন ডাকাত।
বাকি টাকা উদ্ধারের চেষ্টা চলছে জানিয়ে ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা (ডিবি) পুলিশ বলছে, আসামি ও অবশিষ্ট টাকা উদ্ধারের পর চাঞ্চল্যকর এ মামলার অভিযোগপত্র দাখিল করা হবে।
টাকা ছিনতাইয়ের ঘটনার পরপরই আসামিরা দেশের বিভিন্ন প্রান্তে ছড়িয়ে যায়। এসব টাকা পাওয়া গেছে ডাকাতদলের সদস্যদের গ্রামের বাড়ির ধানের গোলা, কবরস্থান, পয়োবর্জ্যের কূপ, শহরে আত্মীয়-স্বজনদের বাসাবাড়ি এবং নিজেদের বাসার শৌচাগারের ওপর থেকে।
আরও পড়ুন>> অস্ত্র ঠেকিয়ে ডাচ্-বাংলা ব্যাংকের সোয়া ১১ কোটি টাকা ছিনতাই
সবশেষ গত ১৭ মার্চ সাভারের হেমায়েতপুর থেকে ছিনতাইয়ের ঘটনায় মূল পরিকল্পনাকারী সোহেল রানাকে (৩৩) গ্রেফতার করে ঢাকা মহানগর পুলিশের (ডিএমপি) গোয়েন্দা বিভাগ। তিনি এক সময় মানি প্ল্যান্ট লিংক কোম্পানির গাড়িচালক ছিলেন। গাড়িচালক থাকার কারণে কোম্পানির টাকা আনা-নেওয়ার খুঁটিনাটি বিষয় সম্পর্কে জানতেন। গাড়িচালক থাকার সময় লুট করা গাড়ির নকল চাবিও বানিয়েছিলেন সোহেল।
ডিবি জানায়, ঘটনার দিন অর্থাৎ, ৯ মার্চ তাৎক্ষণিক অভিযান চালিয়ে তিন কোটি ৮৯ লাখ ৫০ হাজার টাকা উদ্ধার করা হয়। মানি প্ল্যান্ট লিংক প্রাইভেট লিমিটেড বিভিন্ন ব্যাংকের বুথে টাকা লেনদেন করতো কোনো সিকিউরিটি ও অস্ত্র ছাড়াই। বিষয়টি ছিনতাইকারীরা দীর্ঘদিন ধরে নজরদারি করে। প্রতিদিন তাদের চার-পাঁচটি গাড়ি বুথে টাকা লেনদেনের জন্য বের হয়। কোম্পানিটির দু-তিনজন গানম্যান রয়েছে। তবে তারা গাড়ির সঙ্গে যায় না। শুধু অফিসে অস্ত্রসহ বসে থাকে। টাকা লেনদেনের অধিকাংশ সময় তারা থানাকে অবহিত করে না। এমনকি বড় অংকের টাকা বহন করার সময়ও তারা কাছের থানায় অবহিত করতো না।
মামলা সূত্রে জানা যায়, ডাকাতদলের সদস্য মিলন মিয়ার গ্রামের বাড়ি নেত্রকোনার দুর্গাপুরের উরফি পশ্চিমপাড়ায়। দরিদ্র পরিবারে বেড়ে ওঠা মিলন ঢাকায় স্যানিটারি মিস্ত্রির কাজ করেন বলে জানতেন তার গ্রামের লোকজন। সম্প্রতি ঢাকা থেকে পুলিশ মিলন মিয়াকে সঙ্গে নিয়ে তার গ্রামের বাড়ি যায়। পরে তার বাড়ির ধানের গোলার ভেতর থেকে প্লাস্টিকের একটি বস্তা বের করে পুলিশ। সেই বস্তায় পাওয়া যায় ১০ লাখ টাকা।
আরও পড়ুন>> মূল পরিকল্পনাকারী সোহেল গ্রেফতার, উদ্ধার আরও ৮৭ লাখ
মামলার তদারকি কর্মকর্তা ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশের (ডিবি) অতিরিক্ত উপ-কমিশনার (এডিসি) সাইফুল ইসলাম জাগো নিউজকে বলেন, আমরা এখন পর্যন্ত ৮ কোটি ১০ লাখ ৫ হাজার ৫০০ টাকা ও ২০ লাখ টাকা মূল্যের একটি মাইক্রোবাস উদ্ধার করতে পেরেছি। বাকি ৩ কোটি ২০ হাজার টাকা উদ্ধারের চেষ্টা চলছে।
যেভাবে টাকা উদ্ধার হয়
এডিসি সাইফুল ইসলাম বলেন, অসংখ্য সিসি ক্যামেরার ফুটেজ বিশ্লেষণ করে জানতে পারি, বনানী থেকে হেঁটে কুর্মিটোলা এসেছিল ডাকাতরা। সানোয়ার হাসান নামে ডাকাতদলের এক সদস্যকে প্রথম শনাক্ত করা হয়। তার বনানীর বাসায় অভিযান পরিচালনা করে উদ্ধার করা হয় এক কোটি ১৪ লাখ ৫১ হাজার ৫০০ টাকা। তার দেওয়া তথ্যের ভিত্তিতে বনানী সুপার মার্কেট থেকে গ্রেফতার করা হয় ইমন ওরফে মিলনকে। তার জোয়ার সাহারার বাসা থেকে উদ্ধার করা হয় ৩২ লাখ ৪৭ হাজার ৫০০ টাকা। একই দিনে সুনামগঞ্জ থেকে আরও চারজনকে গ্রেফতার করা হয়।
গোয়েন্দা মিরপুর বিভাগের দাবি, বদরুল আলম, মিজানুর রহমান, সনাই মিয়া ও এনামুল হক বাদশা নামে গ্রেফতার চারজনের কাছ থেকে একটি টাকাও উদ্ধার করা সম্ভব হয়নি। তারা মূলত ভাড়াটিয়া হিসেবে এসেছিলেন। টাকা ভাগ বাটোয়ারার আগেই তারা ধরা পড়েন।
গত ১৩ মার্চ সানোয়ার ও বদরুলের দেওয়া তথ্যের ভিত্তিতে গুলশান কড়াইল বস্তির বউবাজারে অভিযান চালিয়ে গ্রেফতার করা হয় ডাকাতিতে জড়িত আরেক সদস্য হৃদয়কে। উদ্ধার করা হয় ৪৮ লাখ ৭ হাজার টাকা। তার দেওয়া তথ্যের ভিত্তিতে ১০ লাখ টাকাসহ নেত্রকোনা থেকে গ্রেফতার করা হয় মিলন মিয়াকে।
আরও পড়ুন>> মূল পরিকল্পনাকারীর একজন সোহেল রানা মানি প্ল্যান্টের গাড়িচালক
গ্রেফতারদের দেওয়া তথ্যের ভিত্তিতে স্পষ্ট হয় ডাচ্-বাংলা ব্যাংকের টাকা ছিনতাইয়ে পরিকল্পনাকারী আকাশ, সোহেল রানা ও হাবিবের নাম। ১৪ মার্চ খুলনা সিঅ্যান্ডবি কলোনি থেকে গ্রেফতার করা হয় আকাশকে। তার দেওয়া তথ্যের ভিত্তিতে ডাকাতির টাকায় কেনা একটি গাড়ি জব্দ করা হয়। এরপর ১৭ মার্চ সাভারের হেমায়েতপুরে অভিযান পরিচালনা করে গ্রেফতার করা হয় সোহেল রানাকে। সেই বাসা থেকে উদ্ধার করা হয় লুট করা ৮৭ লাখ ৫০ হাজার টাকা। এরপর গত ৩০ মার্চ গোপালগঞ্জের কাজলীয়ায় অভিযান পরিচালনা করে ডাকাতদলের অধরা সদস্য হাবিবকে গ্রেফতার করা হয়। লুকিয়ে রাখা মোট ১১ লাখ টাকা উদ্ধার করা হয়। তবে এখনো অধরা ডাকাতদলের অন্য তিন সদস্য জনি, মোস্তফা ও হিমন।
ডাকাতির আরেক পরিকল্পনাকারী আকাশ
তদন্ত সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা জানান, ডাচ্-বাংলা ব্যাংক লিমিটেডের সোয়া ১১ কোটি টাকা ছিনতাইয়ের আরেক মূল পরিকল্পনাকারী মো. আকাশ আহমেদ বাবলু। তার বাড়ি গোপালগঞ্জ সদরে। ডিবি পুলিশের ছদ্মবেশে ডাকাতি করা তার পেশা। উত্তরায় চায়ের দোকানে বসে ডাচ্-বাংলা ব্যাংকের টাকা বহনকারী মানি প্ল্যান্ট লিংক প্রাইভেট লিমিটেডের সাবেক গাড়িচালক সোহেল রানার সঙ্গে পরিচয়। সেই সূত্রে কথাবার্তা হয়।
মানি প্ল্যান্টের চাকরিচ্যুত চালক সোহেল রানা পুলিশের জিজ্ঞাসাবাদে জানান, তিনি ও তার স্ত্রী একটি হত্যা মামলার আসামি। তিনি জানতেন মানি প্ল্যান্টের কোন গাড়ি লক্করঝক্কর, কোন গাড়িতে গানম্যান থাকে না। উত্তরা হাউজ বিল্ডিং এলাকায় আকাশের সঙ্গে পরিচয় হয়। কৌশলে জেনে নেন কীভাবে মানি প্ল্যান্টের গাড়িতে ডাকাতি করা যায়।
আরও পড়ুন>> সোয়া ১১ কোটি টাকা ছিনতাই: টাকার ৩ বক্সসহ গাড়ি উদ্ধার
গ্রেফতার অন্য আসামি হাবিবুর রহমান হাবিব পেশায় গাড়িচালক। গুলশানের একটি বাসায় চালক হিসেবে চাকরিরত অবস্থায় একজন গৃহকর্মী খুনের মামলায় তিনি ৩০ বছরের সাজাপ্রাপ্ত আসামি। আট বছর জেল খেটে বেরিয়ে তিনি আকাশের কথায় আবারও ডাকাতির কাজে জড়ান।
আকাশ, সোহেল ও হাবিবই ছিলেন মূল পরিকল্পনাকারী। বনানীর একটি স্পা সেন্টারে যাতায়াত ছিল আকাশের। সেই সুবাদে পরিচয় হয় দালাল ইমন ওরফে মিলনের সঙ্গে। ডাকাতির পরিকল্পনা শুনে লোক সংগ্রহসহ সার্বিক সহযোগিতার আশ্বাস দেন তিনি।
গ্রেফতার সানোয়ার হোসেন বনানী সুপার মার্কেট থেকে চারটি মোবাইল ফোন সেট ও সিম কেনেন। প্রথমে চারজন চাওয়া হয়েছিল। এরপর খবর পাঠানো হয় চারজন নয়, আটজন প্রয়োজন। কথা ছিল ডাকাতির ২০ শতাংশ টাকা তাদের দেওয়া হবে। সানোয়ার লোক সংগ্রহে সুনামগঞ্জের বালু ব্যবসায়ী বদরুলের সঙ্গে। এরপর সানোয়ার বদরুল মিলে ডেকে আনা হয় সনাই, মিজান, হিমন, বাদশা, হৃদয়, মোস্তফা, মিলন ও জনিকে। তাদের রাখা হয় বনানীর একটি হোটেলে।
গোয়েন্দা মিরপুর বিভাগের উপ-পুলিশ কমিশনার (ডিসি) মানস কুমার পোদ্দার জাগো নিউজকে বলেন, বেশিরভাগ টাকা উদ্ধার হয়েছে। কিছু আসামি পলাতক। তাদের গ্রেফতার ও বাকি টাকা উদ্ধারে অভিযান অব্যাহত রয়েছে।
গোয়েন্দা পুলিশের প্রধান অতিরিক্ত পুলিশ কমিশনার মোহাম্মদ হারুন অর রশীদ জাগো নিউজকে বলেন, আমরা বিভিন্ন জেলায় অভিযান পরিচালনা করে ১৩ ডাকাতকে গ্রেফতার করেছি। তারা আদালতে সব স্বীকার করেছে। আমরা এ পর্যন্ত ডাকাতির আট কোটি ৩০ লাখ ৫ হাজার ৫০০ টাকা উদ্ধার করেছি।
হারুন অর রশীদ আরও বলেন, অধিকাংশ ডাকাতির ঘটনায় ২০ শতাংশ টাকা উদ্ধার করতে পারি। কারণ ডাকাতরা টাকা খরচ করে ফেলে। তবে এই ডাকাতির ঘটনায় আমরা ৮০ শতাংশ টাকা উদ্ধার করতে সক্ষম হয়েছি। বাকি তিন কোটি টাকা উদ্ধারে চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছি।
টিটি/এএসএ/এমএস