দূষণে বিষাক্ত বায়ু, স্বাস্থ্যঝুঁকিতে শিশুরা
দেশে বাড়ছে বায়ুদূষণ। বাতাসের বিষে চরম ঝুঁকিতে পড়েছে জনস্বাস্থ্য। বিশেষ করে শিশুদের স্বাভাবিক শ্বাসপ্রশ্বাস বিঘ্নিত হওয়ার পাশাপাশি নানা শারীরিক জটিলতাও দেখা দিচ্ছে। স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের তথ্যমতে, গত চার মাসে (নভেম্বর-মার্চ) দেশে শ্বাসতন্ত্রের বিভিন্ন রোগে আক্রান্ত হয়ে ১১০ জনের মৃত্যু হয়েছে। অর্থাৎ বায়ুদূষণে প্রতি সপ্তাহে মারা গেছেন ৬ জন। আক্রান্ত হয়েছেন এক লাখ ৮ হাজার ৮৮৫ জন মানুষ।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, দীর্ঘদিন ধরে সারা দেশে বায়ুদূষণের ভয়াবহ পরিস্থিতি বিরাজ করছে। তাই এ মুহূর্তে দূষণরোধে যদি বিভিন্ন পরিকল্পনা হাতে নেওয়া না হয় তবে, বর্তমান ও পরবর্তী প্রজন্মকে বায়ুদূষণের কারণে অনেক ক্ষতির সম্মুখীন হতে হবে। এর জন্য সবাইকে একসঙ্গে কাজ করতে হবে। সবার আগে দূষণের কারণ বের করতে হবে। তারপর সমাধানে উদ্যোগ নিতে হবে। মার্কিন গবেষণা সংস্থার প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, বাংলাদেশে দূষণ নিয়ন্ত্রণ করা গেলে গড় আয়ুও বাড়বে। এক্ষেত্রে সবচেয়ে বেশি সুফল পাবে বাংলাদেশ। জন্ম নেয়া শিশুদের গড় আয়ু তখন ১.৩ বছর বেড়ে যাবে।
গত ১৩ এপ্রিল প্রকাশিত এয়ার কোয়ালিটি ইনডেক্স (একিউআই) এর তথ্য অনুসারে বর্তমানে ঢাকার বাতাসের মান ১৩৬। সংবেদনশীল গোষ্ঠীর জন্য এই মান খুবই ‘অস্বাস্থ্যকর’। এ অস্বাস্থ্যকর পরিবেশের কারণে মৃত্যুতে বাংলাদেশ শীর্ষ পঞ্চমে।
বিশ্বে বায়ু দূষণে প্রায় পাঁচ লাখ শিশু মৃত্যু হয়েছে। এমন তথ্য প্রকাশিত হয়েছে দি স্টেট অব গ্লোবাল এয়ার রিপোর্ট-২০১৯ এ। এখন বিশ্বে যেসব শিশু জন্ম নিচ্ছে, গড়ে তারা কাঙ্ক্ষিত লক্ষ্যমাত্রার চেয়ে ২০ মাস আয়ু কম পাচ্ছে। দক্ষিণ এশিয়ায় যা ৩০ মাস।
চিকিৎসকরা বলছেন, বায়ুদূষণের কারণে জন্ম নিচ্ছে কম ওজনের শিশু। যার প্রভাব বেশ নেতিবাচক। বাংলাদেশে বায়ুদূষণের প্রভাব পড়ছে গর্ভবতি মা ও অনাগত শিশুদের ওপর। গর্ভাবস্থায় বেশি বায়ুদূষণের শিকার মায়েদের মধ্যে কম ওজনের শিশু জন্ম দেওয়ার হার বেশি। এমনকি অকালে সন্তান জন্মদানের ঝুঁকিও তাদের মধ্যে বেশি। ‘ঢাকায় বায়ুদূষণ ও গর্ভাবস্থার ফলাফল’ শীর্ষক এক গবেষণায় এমনই তথ্য উঠে আসে।
স্বাস্থ্যহানিকর এই বায়ুদূষণের জন্য সবচেয়ে বেশি দায়ী ধুলা ও ধোঁয়া যা সংখ্যার হিসেবে প্রায় ৫০ শতাংশ। বিশেষ করে ঢাকার বায়ুদূষণ নিয়ে এমন গবেষণা ভিত্তিক তথ্য দিয়েছে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রসায়ন বিভাগের বায়ুমান গবেষণাকেন্দ্র। এ ধুলার বড় উৎস অব্যবস্থাপনার মধ্য দিয়ে নির্মাণকাজ, পুরনো যানবাহনের দূষিত বায়ুর মাধ্যমে বায়ু দূষণ করছে। বাকি ৪০ শতাংশ দূষণের উৎস খড়, কাঠ ও তুষের মতো জৈববস্তুর ধোঁয়া ও সূক্ষ্ম বস্তুকণা।
অপরদিকে ঢাকার স্ট্যামফোর্ড ইউনিভার্সিটির বায়ুমণ্ডলীয় দূষণ অধ্যয়ন কেন্দ্রের (ক্যাপস) গবেষণায় দেখা গেছে ঢাকা সবচেয়ে বেশি বায়ুদূষণ হচ্ছে নির্মাণখাত মাধ্যমে। গবেষণা বলছে, বায়ুদূষণের জন্য নির্মাণখাত ৩০ শতাংশ দায়ী। এরপর দ্বিতীয় সর্বোচ্চ বায়ু দূষণ হচ্ছে ইটভাটা ও শিল্পকারখানার মাধ্যমে।
ক্যাপস চেয়ারম্যান ড. আহমেদ কামরুজ্জামান মজমদুার বলেন, আবহাওয়া পরিবর্তনজনিত কারণ ছাড়াও বায়ুদূষণের অন্যতম কারণ হলো- ইটভাটা ও শিল্প-কারখানা, অপরিকল্পিত রাস্তা খোঁড়াখুঁড়ি ও নির্মাণকাজ, যানবাহনের কালো ধোঁয়া। ইটভাটাগুলো বায়ুদূষণের জন্য ৫৮ ভাগ দায়ী। ভরা মৌসুমে ইটভাটা দৈনিক প্রায় ১০ টন কয়লা পোড়ায়। কয়লা পোড়ানোর প্রচুর কার্বন-ডাইঅক্সাইড উৎপন্ন হয়। সেই সঙ্গে প্রচুর সালফার-ডাইঅক্সাইড, কার্বন-মনোক্সাইড, ডাই অক্সি ও ফুরান নিঃসরিত হয়।
পরিবেশ বাঁচাও আন্দোলন (পবা) এর চেয়ারম্যান আবু নাসের খান বলেন, বায়ু দূষণ থেকে উত্তরণ পাওয়া এখন বেশ কঠিন। বায়ু দূষণের দুইটা উৎস- ভেহিকেল ও কনস্ট্রাকশন। দেশের বিভিন্ন এলাকায় গাড়ির চাপ অনেক বেড়েছে। যানবাহনের কালো ধোঁয়া বায়ু দূষণের অন্যতম কারণ। আমাদের প্রাইভেট গাড়ি কমাতে পাবলিক পরিবহনের মান বাড়াতে হবে।
তিনি আরও বলেন, অন্যদিকে নিমার্ণকাজ বেড়েছে। এর ফলে দেশে ব্যাপক হারে অবৈধ ইটভাটা সৃষ্টি হয়েছে। পোড়া ইট যতদিন থাকবে ততদিন বায়ু দূষণ হবে। এতে যেমন কৃষি ফসলের ক্ষতি হচ্ছে। শিশুসহ মানুষের চরম স্বাস্থ্যঝুঁকি দেখা দিচ্ছে। এজন্য সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষকে বিকল্প উৎস খুঁজে বের করে বায়ু দূষণ রোধ করতে হবে।
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের রেসপিরেটরি মেডিসিন বিভাগের চেয়ারম্যান অধ্যাপক ডা. মোহাম্মদ আতিকুর রহমান বলেন, বায়ুদূষণের কারণে সর্দি, কাশি, মাথাব্যথা, অ্যালার্জি, বমি, শ্বাসকষ্ট ও হাঁপানিসহ শ্বাসযন্ত্রের বিভিন্ন রোগ হচ্ছে। বিশেষ করে বায়ুদূষণ শিশুদের বিকাশে ব্যাঘাত ঘটাচ্ছে। বাতাসের বিষাক্ত এবং ক্ষতিকর ভাইরাস শ্বাস-প্রশ্বাসের সঙ্গে মাধ্যমে ক্ষতিকর পদার্থ শরীরে প্রবেশের ফলে অ্যালার্জি, গলায় ইনফেকশন, নিউমোনিয়া, ফুসফুস, কিডনি, লিভার, হৃৎপিণ্ডে বিভিন্ন ধরনের সমস্যা তৈরি হচ্ছে। তাই দুষণরোধে সবাইকে সচেতনার পরামর্শ দেন এই বিশেষজ্ঞ।
জেএইচ/জিকেএস