একপাশে শোক-পোড়া কাপড়, অন্যপাশে কেনাকাটার ধুম
ঈদের বাকি মাত্র চার-পাঁচদিন। বুধবার থেকেই ছুটি হচ্ছে সরকারি সব অফিস। অধিকাংশ বেসরকারি অফিসেরও ছুটি শুরু হচ্ছে সেদিনই। তাই অনেকেই ঈদে ঢাকা ছাড়ার আগে কেনাকাটা করতে ছুটে আসছেন রাজধানীর নিউমার্কেট এলাকায়।
তবে শনিবার (১৫ এপ্রিল) ভোরে রাজধানীর নিউ সুপার মার্কেটে আগুন লাগায় বন্ধ আছে সেটি। ওই মার্কেটে চলছে পোড়া কাপড় সরানোর কাজ। আছে শোকার্ত ব্যবসায়ীদের আহাজারি।
অন্যদিকে ঈদের কেনাকাটা থেমে নেই আশপাশের মার্কেটগুলোতে। ওই এলাকার অন্য সব ভবনেই আছে উপচেপড়া ভিড়। ফুটপাতেও নেই পা ফেলার জায়গা।
সরেজমিনে সোমবার (১৭ এপ্রিল) সকাল থেকে বিকেল পর্যন্ত নিউমার্কেট এলাকায় দেখা গেছে এ দৃশ্য।
ওই এলাকার গাউছিয়া সুপার মার্কেট, হকার্স মার্কেট, নূরজাহান সুপার মার্কেট, গ্লোব শপিংমল, বদরুদ্দোজা সুপার মার্কেট, নূর ম্যানশন সুপার মার্কেট, চাঁদনি চক, ইয়াকুব সুপার মার্কেট ও গোল্ডেনগেট সুপার মার্কেটসহ প্রতিটি মার্কেটেই ছিল মানুষের উপচেপড়া ভিড়।
মায়ের সঙ্গে গাউছিয়া সুপার মার্কেটে কেনাকাটার জন্য এসেছেন কলেজপড়ুয়া নাফিসা। তিনি জাগো নিউজকে জানান, আগামী বুধবার তার বাবার অফিস ছুটি। ওইদিন পরিবারসহ গ্রামে ঈদ করতে যাবেন। তাই গ্রামের আত্মীয়দের জন্য কেনাকাটা করতে এসেছেন।
আফসার বকুল নামের এক ক্রেতা জানান, নিউ সুপার মার্কেট ছাড়া অন্য মার্কেট খোলা রয়েছে জানতে পেরে আজ দুপুরে এসেছেন পরিবারের জন্য কিছু কেনাকাটা করতে। তার স্ত্রীর জন্য একটি শাড়ি, ছেলের জন্য প্যান্ট ও শার্ট এবং মেয়ের জন্য কিনেছেন থ্রি-পিস।
নিউমার্কেটে ফুটওভার ব্রিজের নিচে স্যান্ডেল ও মেয়েদের হিজাবসহ অন্য পোশাক পাওয়া যায়। নিজের জন্য দুই জোড়া স্যান্ডেল কিনে মায়ের জন্য স্যান্ডেল দেখছিলেন এলিসা ইলমা নামের এক ক্রেতা। তিনি বলেন, শনিবার নিউমার্কেটে কেনাকাটার জন্য আসতে চেয়েছিলেন। আগুন লাগার খবরে আসা হয়নি। আজ এসেছেন। কেনাকাটা করে ব্যাগভর্তি হয়ে গেছে বলেও জানান তিনি।
নূরজাহান সুপার মার্কেটের পাঞ্জাবি দোকানি কাজী ইয়াসিন আলী জাগো নিউজকে বলেন, ঢাকা নিউ সুপার মার্কেটে আগুন লাগার দিন দোকান খুলতে পারেননি। গতকাল থেকে দোকান খোলা। তবে গতকাল কাস্টমার কম হলেও আজ একটু বেশি। আশা করছেন সন্ধ্যা ও রাতে আরও বেশি কাস্টমার আসবে।
অন্যদিকে পুড়ে যাওয়া ঢাকা নিউ সুপার মার্কেটের ব্যবসায়ীদের দাবি, ঈদের আগে যে কোনোভাবে মার্কেট খুলতে পারলে অন্তত তারা খেয়ে পরে বাঁচতে পারবেন। এছাড়া কর্মচারীদের ঈদের বেতন-বোনাসও দিতে পারবেন।
আগুন লাগা ঢাকা নিউ সুপার মার্কেটের ব্যবসায়ী ওমর ফারুক জাগো নিউজকে বলেন, ২০১৬ সালের আগে নিউমার্কেটে কর্মচারী হিসেবে কাজ করতেন। ধীরে ধীরে টাকা জমিয়ে ও স্ত্রীর গহনা বিক্রি করে ২০১৬ সালের শেষ দিকে একটি দোকানের মালিক হন। পরবর্তীসময়ে আরও একটি দোকান কেনেন ফারুক। দুই দোকানে বেচাকেনা ভালোই চলছিল। তার কর্মচারী ছিল মোট নয়জন। কিন্তু শনিবার ভোররাতে লাগা আগুনে তার দুই দোকানের মালামাল ও নগদ পাঁচ লাখ টাকা পুড়ে ছাই হয়ে যায়। ওমর ফারুক সব হারিয়ে এখন নিঃস্ব। তিনি কীভাবে আবার ঘুরে দাঁড়াবেন তাও বুঝতে পারছেন না।
ওমর ফারুক জাগো নিউজকে বলেন, ৩০ লাখ টাকা ব্যাংক ও আত্মীয়-স্বজনদের কাছ থেকে ঋণ করে দুটি দোকানে মালামাল তুলেছিলাম। ভেবেছিলাম ঈদের বেচাকেনার পর ঋণ পরিশোধ করবো। কিন্তু সেসব স্বপ্ন কয়লায় পরিণত হলো। এখন কর্মচারীর বেতন দেবো কীভাবে, আর আমার সংসারই বা কীভাবে চলবে। ঈদের আগে দোকান খুলতে না পারলে বেঁচে থাকাই কষ্টকর হবে।
নিউ সুপার মার্কেটের তৃতীয় তলার ব্যবসায়ী ইলিয়াস খান চোখের পানি ছেড়ে জাগো নিউজকে বলেন, ঈদের আগে ১৪ লাখ টাকার মালামাল তুলেছিলাম। অল্প কিছু বিক্রি হয়েছে। ঈদের এই কয়দিনই মূলত ব্যবসা হয়। কিন্তু আগুনে পুড়ে গেছে সব। আমাদের সামনের মার্কেটগুলোতে ক্রেতারা আসছে, আর আমরা শুধু তাকিয়ে রয়েছি, আমাদের পোড়া মার্কেটের দিকে। দোকানে তিনজন কর্মচারী ছিল। লজ্জায় ওদের ফোনও করতে পারছি না। মায়ের কাছে কী জবাব দেবো ভাই।
এদিকে ঢাকা নিউ সুপার মার্কেটে অগ্নিকাণ্ডের কারণ অনুসন্ধানে পাঁচ সদস্যের তদন্ত কমিটি গঠন করেছে ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্স। পাঁচ কর্মদিবসের মধ্যে আগুনের কারণ, ক্ষয়-ক্ষতি নিরূপণ করে প্রতিবেদন দাখিল করতে বলা হয়েছে।
সোমবার (১৭ এপ্রিল) বিষয়টি নিশ্চিত করেন ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্স অধিদপ্তরের মহাপরিচালক (ডিজি) ব্রিগেডিয়ার জেনারেল মো. মাইন উদ্দিন।
তদন্ত কমিটির প্রধান হলেন ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্স অধিদপ্তরের পরিচালক (প্রশাসন ও অর্থ) মো. ওয়াহিদুল ইসলাম। কমিটির সদস্যরা হলেন উপ-পরিচালক (পরিকল্পনা কোষ) বাবুল চক্রবর্তী, পলাশী ফায়ার স্টেশনের সিনিয়র স্টেশন অফিসার, সংশ্লিষ্ট এলাকার ওয়্যারহাউজ ইন্সপেক্টর গোলাম মোস্তফা। তদন্ত কমিটির সদস্য সচিবের দায়িত্ব পালন করবেন জোন-১ এর উপ-সহকারী পরিচালক ফয়সালুর রহমান।
টিটি/এমএইচআর/এমএস