উদাসীন সিটি করপোরেশন

সুফল মিলছে না দৃষ্টিপ্রতিবন্ধীদের চলাচল সহায়ক হলুদ টাইলসের

মুসা আহমেদ
মুসা আহমেদ মুসা আহমেদ
প্রকাশিত: ১০:৪৯ এএম, ০৩ এপ্রিল ২০২৩
দৃষ্টিপ্রতিবন্ধী সহায়ক ফুটপাতগুলো অধিকাংশই ভাঙা-চোরা কিংবা হকারদের দখলে/মাহবুব আলম

#দৃষ্টিপ্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের হাঁটার সুবিধার কথা বিবেচনায় রেখে ফুটপাতে লাল রঙের টাইলসের মাঝে হলুদ রঙের টাইলস বসিয়েছে ঢাকার দুই সিটি করপোরেশন।

#এখন ফুটপাতে হকার, বৈদ্যুতিক খুঁটি, গাছ, টাইলস ভাঙার কারণে চলাচলে সমস্যা হচ্ছে।

রাজধানী ঢাকার গুলশান-১ নম্বর থেকে বাড্ডা লিংক রোড যাতায়াতের সড়কটির দুই পাশেই চওড়া ফুটপাত। গুদারাঘাট থেকে হাতিরঝিলের দিকে চলে যাওয়া ফুটপাতটিও চওড়া। তবে অবস্থা করুণ। কোথাও ভাঙা, কোথাও ফুটপাতের মাঝ বরাবর বৈদ্যুতিক খুঁটি, কোনো জায়গা আবার দখলে হকারদের। এই ফুটপাতে বসে প্রতিদিন ভিক্ষা করেন দৃষ্টিপ্রতিবন্ধী আসগর আলী। হাঁটাচলা করেন না। ফুটপাতে নির্বিঘ্নে চলাচলের জন্য হলুদ টাইলসের লেন থাকলেও সেটার দিশা পান না তিনি। অথচ আসগর আলীর মতো মানুষের জন্যই রাজধানীর অধিকাংশ ফুটপাতে বসানো বিশেষ এ টাইলস।

ঢাকার দুই সিটি করপোরেশন এলাকার প্রায় সব প্রধান ফুটপাতে দুই ধরনের টাইলস বসানো। লাল টাইলসের মাঝে ঢেউ খেলানো হলুদ টাইলসের লেন। নগরীর সৌন্দর্য বৃদ্ধির পাশাপাশি ফুটপাত দৃষ্টিপ্রতিবন্ধীবান্ধব করতে প্রথমে এ উদ্যোগ নেয় ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশন (ডিএনসিসি)। পরে ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনও (ডিএসসিসি) এ প্রকল্প চালু করে। এই হলুদ টাইলস ধরে যেন দৃষ্টিপ্রতিবন্ধীরা সহজে ফুটপাতে হাঁটতে পারেন তার জন্যই এ ব্যবস্থা।

আরও পড়ুন>> ফুটপাতে স্বাচ্ছন্দ্যে হাঁটতে পারবেন দৃষ্টিপ্রতিবন্ধীরা

কিন্তু সরেজমিনে রাজধানীর অধিকাংশ ফুটপাত দেখা যায় ভাঙাচোরা অথবা পণ্যের পসরা সাজিয়ে বসেছেন হকাররা। বৈদ্যুতিক খুঁটি, টেলিফোন যন্ত্রের বক্স, যানবাহন পার্কিং করে রাখাও নৈমিত্তিক ব্যাপার। ফলে যে উদ্দেশ্যে এ ধরনের টাইলস বসানো হয়েছে তার সুফল মিলছে না। ফুটপাত দখলমুক্ত রাখতে সিটি করপোরেশনও তেমন কোনো ভূমিকা রাখছে না বলে অভিযোগ নাগরিকদের।

ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশন (ডিএনসিসি) ও ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের (ডিএসসিসি) সংশ্লিষ্টদের দাবি, দৃষ্টিপ্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের হাঁটার সুবিধার কথা বিবেচনায় রেখে ফুটপাতে লাল রঙের টাইলসের মাঝে হলুদ রঙের টাইলস বসানো হয়। নগরের প্রধান সড়কের ফুটপাতগুলোতে এ ধরনের টাইলস বেশি দেখা মিলবে। এখন দৃষ্টিপ্রতিবন্ধীরা এ টাইলসের সুবিধা পাচ্ছেন। যেসব ফুটপাতে প্রতিবন্ধকতা রয়েছে সেগুলো অপসারণ করা হবে।

জানতে চাইলে ডিএনসিসি মেয়র আতিকুল ইসলাম জাগো নিউজকে বলেন, ফুটপাতে লাল রঙের টাইলসের মাঝে হলুদ রঙের টাইলসগুলোকে অনেকেই নান্দনিক ডিজাইন মনে করছে। এ টাইলসের গুরুত্ব নগরের অধিকাংশ লোকজন জানে না। তবে প্রতিবন্ধী ব্যক্তিরা এসব টাইলসের সুবিধা পাচ্ছেন। যেসব স্থানে প্রতিবন্ধকতা তৈরি হয়, সেগুলো অপসারণ করছি। এখন জনসচেতনতা বাড়াতে প্রচারের ব্যবস্থা করবো। যাতে প্রতিবন্ধীরা নির্বিঘ্নে গন্তব্যে পৌঁছাতে পারেন।

আরও পড়ুন>> ফুটপাতে দোকান, সড়কে গাড়ি, বিপাকে পথচারী

ডিএনসিসি ও ডিএসসিসি সূত্র জানায়, ২০১৫ সালে এই বিশেষ টাইলস ফুটপাতে বসানোর উদ্যোগ নেয় ডিএনসিসি। পরে ডিএসসিসিও একই ধরনের টাইলস বসানো শুরু করে। এখনো এ প্রকল্প চলমান।

ফুটপাতে লাল রঙের টাইলসের মাঝে হলুদ রঙের টাইলসগুলো অমসৃণ এবং ঢেউ খেলানো। এর উঁচু ধার (রিলিফ) দিয়ে দৃষ্টিপ্রতিবন্ধীরা স্পর্শের অনুভূতির সাহায্যে এ টাইলস বরাবর হেঁটে যেতে পারেন। আবার ফুটপাত যেখানে ঢালু, সেখানে টাইলসে ঢেউ খেলানো রিলিফের বদলে গোলাকার বৃত্তের রিলিফ রয়েছে। এটি থাকলে একজন দৃষ্টিপ্রতিবন্ধী বুঝতে পারেন, এখানে ফুটপাত নেমে গেছে। এতে তিনি সেখান থেকে সিদ্ধান্ত নিয়ে বা অন্যের সাহায্য নিয়ে গন্তব্য ঠিক করবেন।

সুফল মিলছে না দৃষ্টিপ্রতিবন্ধীদের চলাচল সহায়ক হলুদ টাইলসের

গুলশান-১ থেকে বাড্ডা যেতে হাতিরঝিলে একটি ঘাট আছে। এটি গুদারাঘাট নামে পরিচিত। সারা বছরই এ জায়গায় দৃষ্টিপ্রতিবন্ধীদের অনেককে ভিক্ষা করতে দেখা যায়। ২৮ মার্চ বিকেলে এই ঘাটে ভিক্ষুক আজগর আলী বলেন, এ টাইলস ধরে বেশি দূর হাঁটতে পারি না। বিভিন্ন জায়গায় হোঁচট খাই। তাই ফুটপাতে বসেই ভিক্ষা করি।

মাজিদ হোসেন (২৯) জন্ম থেকে দৃষ্টিপ্রতিবন্ধী। স্ত্রী ও দুই সন্তান নিয়ে থাকেন মিরপুর-১০ নম্বরে। ঢাকার একটি কলেজ থেকে স্নাতক পাস করেছেন। এখন চাকরির জন্য চেষ্টা করছেন। মাজিদ বলেন, নগরে ফুটপাতে টাইলস বসানোয় আমাদের উপকার হয়েছে। তবে অনেক জায়গায় ফুটপাত ভাঙা, রাস্তায় গাছপালা আর হকারের দৌরাত্ম্য বেড়েছে। তাই পরিচিত জায়গার বাইরে গেলে পড়ে যাই, হাত-পা ছিঁড়ে যায়।

পুরান ঢাকার বাহাদুর শাহ পার্কে দিন-রাত মানুষের আনাগোনা থাকে। এখানে পার্কের চারপাশে ফুটপাতে ঘুরে ভিক্ষা করেন মজিদ মিয়া। তবে পার্কের উত্তর পাশে ফুটপাতে পথচারীদের অনেকে মলমূত্র ত্যাগ করেন। এতে এ পাশ দিয়ে কেউ হেঁটে যায় না। ভিক্ষুক মজিদ বলেন, পার্কের চারপাশে ফুটপাতে প্রতিবন্ধীদের জন্য বিশেষ টাইলস বসানোয় খুবই ভালো হয়েছে। একাই ঘুরে ঘুরে ভিক্ষা করতে পারি। তবে পার্কের উত্তর পাশে ফুটপাতে মলমূত্র থাকায় সে পাশ দিয়ে হাঁটা যায় না। সিটি করপোরেশনকে বিষয়টি গুরুত্ব দেওয়া উচিত।

আরও পড়ুন>> কাঁচাবাজারে অব্যস্থাপনায় নিয়ন্ত্রণহীন গরুর মাংসের দাম

গুলিস্তানে জাতীয় গ্রন্থাগারের পশ্চিম পাশের ফুটপাতটি প্রায় ১০ ফুট চওড়া। কিন্তু টাইলস বসানো এ ফুটপাতও হকারদের দখলে। জানতে চাইলে হকার রবিন মিয়া জানান, গুলিস্তানের সব টাইলস করা ফুটপাতেই হকার বসছে। দীর্ঘদিন ধরে তারা এখানেই ব্যবসা করছেন।

এসময় তাকে হলুদ টাইলসের বিষয়ে প্রশ্ন করলে কোনো উত্তর দিতে পারেননি।

সুফল মিলছে না দৃষ্টিপ্রতিবন্ধীদের চলাচল সহায়ক হলুদ টাইলসের

ইঞ্জিনিয়ার্স ইনস্টিটিউট অব বাংলাদেশ থেকে শাহবাগ মোড় পর্যন্ত ফুটপাতেও হলুদ টাইলস বসানো। এর মধ্যে শিশুপার্কের সামনে আলাদা চারটি স্থানে স্টিলের অনেকগুলো খুঁটি পোতা রয়েছে। খুঁটিগুলো তিন ফুট উঁচু। এতে একজন স্বাভাবিক দৃষ্টির মানুষেরও চলতে সমস্যা হয়।

শাহবাগের ফুলের দোকানি মহসিন কবির জাগো নিউজকে বলেন, শাহবাগ মোড়ে প্রায় দিনই যানজট হয়। তখন অনেক মোটরসাইকেল তড়িঘড়ি করে যাওয়ার জন্য ফুটপাতে মোটরসাইকেল উঠিয়ে দেন। এতে পথচারীদের চলাচলে সমস্যা হয়। প্রতিবন্ধীদের চলার সুযোগ নেই বললেই চলে। তাই ফুটপাতে মোটরসাইকেল ওঠা বন্ধে ট্রাফিক পুলিশ এসব খুঁটি বসিয়েছে।

দৃষ্টিপ্রতিবন্ধীদের নিরাপদে পথচলার ব্যাপারে সচেতনতা বাড়াতে প্রতিবছর ১৫ অক্টোবর বিশ্বের অন্য দেশের মতো বাংলাদেশেও পালন হয় বিশ্ব সাদাছড়ি দিবস। দৃষ্টিপ্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের প্রতিষ্ঠান ভিজুয়ালি ইম্পেয়ার্ড পিপলস সোসাইটির (ভিপস) সাধারণ সম্পাদক জাহাঙ্গীর আলম সম্প্রতি জাগো নিউজকে বলেন, ২০১৫ সালে ডিএনসিসির প্রয়াত মেয়র আনিসুল হকের কাছে দৃষ্টিপ্রতিবন্ধীদের জন্য বেশ কিছু প্রস্তাব দিয়েছিলাম। তার মধ্যে ফুটপাতে নির্বিঘ্ন চলাচলের ব্যবস্থার দাবিও ছিল। সে অনুযায়ী এ উদ্যোগটা নেওয়া হয়।

আরও পড়ুন>> মশা মারতে ‘কামান দাগা’ বন্ধ করবে ডিএনসিসি

তিনি বলেন, আমরা যারা দৃষ্টিপ্রতিবন্ধী তারা ফুটপাতের সাইড দিয়ে যাবো, নাকি মাঝ দিয়ে যাবো, কোথায় থামবো- এ টাইলস আমাদের একটা গাইডলাইন দেয়। কিন্তু আমরা জানি ড্রেনের ওপর দিয়েই ফুটপাত করেছে সিটি করপোরেশন। এই ড্রেনের ঢাকনার ওপর কোনো টাইলস নেই। অনেক জায়গায় ঢাকনা ফাঁকা। এই ফাঁকে অনেক দৃষ্টিপ্রতিবন্ধী ব্যক্তির পা ঢুকে গিয়ে স্যান্ডেল ছিঁড়ে যায়। অনেকে পড়ে গিয়ে ব্যথা পান, অনেকে সামনে উঁচু-নিচু দেখে আতঙ্কিত হন।

সুফল মিলছে না দৃষ্টিপ্রতিবন্ধীদের চলাচল সহায়ক হলুদ টাইলসের

এছাড়া অনেক জায়গায় ড্রেনের ঢাকনার মুখ খোলা থাকে। অনেক জায়গায় আবার প্রতিবন্ধীদের হাঁটার লাইনে গাছ। অনেক সড়কে মোটরসাইকেল ঠেকানোর জন্য মাঝখানে রড বসিয়ে দিয়েছে। এসব প্রতিবন্ধকতা তুলে দিতে হবে।

জানতে চাইলে ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের প্রধান প্রকৌশলী সালেহ আহম্মেদ জাগো নিউজকে বলেন, ডিএসসিসির অবকাঠামো উন্নয়ন প্রকল্পের আওতায় প্রতিবন্ধী ফুটপাতে বিশেষ টাইলস বসানোর কাজটিও করা হচ্ছে। এখন পর্যন্ত প্রায় ১০০ কিলোমিটারের বেশি ফুটপাতে টাইলস স্থাপন করা হয়েছে। আরও অনেক নতুন রাস্তায় এসব টাইলস বসানোর কাজ চলছে। যেসব জায়গায় টাইলস ভেঙে গেছে বা ড্রেনের কাজ করতে গিয়ে টাইলস ওঠানো হয়েছে, সেগুলো নতুন করে ঠিক করা হচ্ছে।

একই বিষয়ে ডিএনসিসির প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা সেলিম রেজা জাগো নিউজকে বলেন, ২০১৫ সালের পর থেকে যেখানেই আমরা রাস্তাঘাটে উন্নয়নের কাজ করি, সেখানেই দৃষ্টিপ্রতিবন্ধীদের জন্য বিশেষ টাইলস বসানো হয়। তবে কিছু ফুটপাতে প্রতিবন্ধকতা যেন না হয়, সে নির্দেশনা দেওয়া আছে। ডিএনসিসির কোনো ম্যানহোলের ঢাকনা খোলা থাকে না।

এমএমএ/এএসএ/জেআইএম

পাঠকপ্রিয় অনলাইন নিউজ পোর্টাল জাগোনিউজ২৪.কমে লিখতে পারেন আপনিও। লেখার বিষয় ফিচার, ভ্রমণ, লাইফস্টাইল, ক্যারিয়ার, তথ্যপ্রযুক্তি, কৃষি ও প্রকৃতি। আজই আপনার লেখাটি পাঠিয়ে দিন [email protected] ঠিকানায়।