মুক্তিযুদ্ধে নারী

জান্নাতুল ফেরদৌস অনন্যা
জান্নাতুল ফেরদৌস অনন্যা জান্নাতুল ফেরদৌস অনন্যা , ফিচার লেখক
প্রকাশিত: ০১:০৯ পিএম, ২৬ মার্চ ২০২৩

প্রাচীনকাল থেকেই বিভিন্ন যুদ্ধকালীন অবস্থায় নারীদের দুর্বল শ্রেণি হিসেবে অন্তর্ভুক্ত করা হয়ে এসেছে। সম্মুখসমরে যুদ্ধ করার জন্য পুরুষের অবদানকেই যুগে যুগে বেশি গুরুত্বের সঙ্গে দেখানো হয়েছে। অনেক ক্ষেত্রে অস্বীকারও করা হয়েছে নারীদের গুরুত্ব, সাহসিকতা এবং আত্মত্যাগকে। জাতি হিসেবে গর্ব করার মতো আমাদের বাঙালিদেরও আছে ১৯৭১ সালের মহান মুক্তিযুদ্ধের রক্তক্ষয়ী এক স্বর্ণালী ইতিহাস।

মুক্তিযুদ্ধ ছিল বাঙালির সর্বস্তরের জনসাধারণের অস্তিত্ব রক্ষার অপ্রতিরোধ্য সংগ্রাম, এ সংগ্রামে লিখিত এবং অলিখিতভাবে সামিল আছে দেশমাতৃকার অগণিত বীরঙ্গনাদের সাহসী এবং নিঃস্বার্থ অবদান। ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধ শুরুর আগে থেকেই বাঙালি সূর্যকন্যাদের দাপুটে এবং সক্রিয় অংশগ্রহণ ছিল বিভিন্ন রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডে, দাবি আদায়ের আন্দোলনে, তৃণমূল থেকে রাজপথে মিছিলের স্লোগানে।

jagonews24

মুক্তিযুদ্ধে নারীরা প্রত্যক্ষ-পরোক্ষভাবে অবদান রেখেছেন। চিকিৎসক হয়ে কখনও তারা যুদ্ধাহত মুক্তিযোদ্ধাদের সেবা দিয়েছেন তো কখনও রাঁধুনি হয়ে খাদ্য সরবরাহ করেছেন মুক্তিযোদ্ধাদের। পাক-হানাদার বাহিনীর হাতে ভুলক্রমে ধরা পড়লে মৃত্যু অনিবার্য জেনেও মুক্তিযোদ্ধাদের অস্ত্র লুকিয়ে রেখেছেন এবং গুরুত্বপূর্ণ সব খবর দেওয়ার অদম্য মাধ্যম হয়ে কাজ করেছেন অসীম সাহসিকতায়। নিজের জীবনবাজি রেখে বর্বর হানাদার বাহিনী থেকে মুক্তিযোদ্ধাদের লুকিয়ে রাখার যে ইতিহাস সেটিও আমাদের অজানা নয়। তারা সংগঠক হয়েছেন, আবার শব্দ সৈনিক রূপে গান, কবিতা, কথামালা দিয়ে নৈপথ্যে থেকেই জুগিয়ে গিয়েছেন যুদ্ধক্ষেত্রের মুক্তিযোদ্ধাদের সাহস ও মনোবল।

মুক্তিযুদ্ধে নারীর অকুণ্ঠ আত্মত্যাগের অবিস্মরণীয় বহিঃপ্রকাশ আমরা দেখি যখন জানতে পারি শত অজানা আশঙ্কাকে পাশ কাটিয়ে একজন মা তার বুকের মানিককে যুদ্ধে পাঠাতে এক মুহূর্ত দ্বিধাবোধ করেননি। আবার কখনো আমরা দেখি, এই নারীরাই প্রণয়িণী হয়ে সঙ্গীকে প্রেরণা যুগিয়েছেন রণক্ষেত্রে শত্রুসেনার সম্মুখীন হয়ে বিজয় ছিনিয়ে আনতে।

jagonews24

‘বীর বাঙালি অস্ত্র ধরো, বাংলাদেশ স্বাধীন করো’ স্লোগানকে বুকে ধারণ করে নারীরা বিভিন্ন গেরিলা অপারেশনে নিজেদের প্রত্যক্ষভাবে যুক্ত করেছেন। এই গেরিলা অপারেশনগুলোতে দুর্দমনীয় নারী সৈনিকেরা তাদের প্রমাণ করেছেন যথেষ্ট চৌকষতা এবং নিপুণ দক্ষতার সঙ্গে। মুক্তিযুদ্ধের প্রথম গেরিলা স্কোয়াড গড়ে ওঠে বেগম ফোরকানের নেতৃত্বে। আবার অবিশ্বাস্য হলেও সত্য, মাত্র ১৫ বছর বয়সের কিশোরী আশালতা বৈদ্য মুক্তিযোদ্ধা কমান্ডার হিসেবে ৪৫ জনের নারী গেরিলা দলের নেতৃত্ব দেন। মুক্তিযুদ্ধের সময় অনেক নারী সশস্ত্র প্রশিক্ষণ গ্রহণ করেন প্রতিবেশী দেশ ভারতের বিভিন্ন রাজ্য যেমন পশ্চিমবঙ্গ, মেঘালয়, আসাম ও ত্রিপুরার ক্যাম্পে। পশ্চিমবঙ্গের গোবরা ক্যাম্প যার মধ্যে উল্লেখযোগ্য ছিল।

আমরা মুক্তিযুদ্ধে ভূয়সী অবদানের জন্য বীর প্রতীক তারামন বিবির কথা জানি, আরো জানি বীথিকা বিশ্বাস, রওশন আরা, কাঁকন বিবি, গীতা কর্মকার, আলেয়া বেগম, শিরিন বানু মিতিল, শিশির কণা, লাইলী পারভীন, গীতা কর, ও রমা চৌধুরীদের কথা। আরও কত নাম না জানা নারীদের অবদান দৃষ্টির অগোচরেই রয়ে গেছে। অথচ এত আত্মত্যাগের পরেও মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে প্রত্যক্ষ স্বীকৃতি পেতে তাদের অপেক্ষা করতে হয়েছে স্বাধীনতার পরে আরও ২৯ বছর। অবহেলায় কেটেছে তাদের বেশিরভাগের জীবন। বর্তমানে মুক্তিযোদ্ধার স্বীকৃতি পাওয়া বীরাঙ্গনার সংখ্যা ৪৪৮ জন এবং তিনজন বীর প্রতীক খেতাবপ্রাপ্ত নারী মুক্তিযোদ্ধা হলেন ক্যাপ্টেন সিতারা বেগম, তারামন বিবি এবং কাঁকন বিবি।

jagonews24

অনেকেই মনে করেন সবচেয়ে কম সময়ের মধ্যে সবচেয়ে বেশি ধর্ষণের ঘটনা আমাদের মুক্তিযুদ্ধের সময়ই ঘটেছে যেখানে নয় মাসের যুদ্ধে প্রায় দুই লাখ মা-বোন হারিয়েছেন তাদের সম্ভ্রম। প্রকৃতপক্ষে মুক্তিযুদ্ধে নারীর ভূমিকা এবং অবদান কোনো অংশেই পুরুষের চেয়ে কম নয়। একজন পুরুষ যুদ্ধ করেছেন নয় মাস। অথচ একজন ধর্ষিত নারী দেশ স্বাধীন হওয়ার পরেও যুদ্ধ চালিয়ে গেছেন এই সমাজের বিরুদ্ধে। যে সমাজ তাকে মেনে নেয়নি, দেয়নি আশ্রয় অথচ পদে পদে দিয়ে গেছে লাঞ্ছনা আর গঞ্জনা।

jagonews24

বলার অপেক্ষা রাখে না, মুক্তিযুদ্ধকালে নারীর আর্থ-সামাজিক-রাজনৈতিক অবস্থান ছিল অত্যন্ত সনাতন। পুরুষেরা যখন সংগ্রামরত ছিল পাকিস্তানি সৈনিকদের পরাস্ত করে স্বদেশকে মুক্ত করার জন্য, নারীকে তখন দেশমুক্তির পাশাপাশি নিজের অস্তিত্ব, মর্যাদা ও সম্ভ্রম রক্ষার জন্য লড়াই করতে হয়েছে। মুক্তিযুদ্ধের দিনগুলোর কথা আমরা শুনতে পাই সাহসী প্রতিরোধের পদধ্বনি, যা থেকে এই সত্য আরও পুঙ্খানুপুঙ্খভাবে স্পষ্ট হয় যে নারীসমাজের সাহায্য ছাড়া বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ এবং গেরিলা যুদ্ধ চালানো সম্ভব ছিল না।

এমআরএম/এমএস

পাঠকপ্রিয় অনলাইন নিউজ পোর্টাল জাগোনিউজ২৪.কমে লিখতে পারেন আপনিও। লেখার বিষয় ফিচার, ভ্রমণ, লাইফস্টাইল, ক্যারিয়ার, তথ্যপ্রযুক্তি, কৃষি ও প্রকৃতি। আজই আপনার লেখাটি পাঠিয়ে দিন [email protected] ঠিকানায়।