ঢাকায় অপহরণের ৯০ শতাংশই নারী-শিশু
রাজধানীর বাড্ডার সাঁতারকুল রোডে একটি পোশাক কারখানায় অপারেটর হিসেবে কাজ করতেন বীণা রানী মণ্ডল (ছদ্মনাম)। একই কারখানায় কাজ করতেন রাফিজুল মোল্লা নামের এক তরুণ। ঢাকায় স্ত্রী-সন্তান নিয়ে বসবাস করতেন রাফিজুল। এরপরও পোশাক কারখানায় যাওয়া-আসার পথে বীণা রানীকে কুপ্রস্তাব দিতেন তিনি। কিশোরী বীণা রানী এতে সাড়া না দেওয়ায় তাকে তুলে নিয়ে যাওয়ার হুমকি দেন রাফিজুল। গত বছরের (২০২২) ১৯ জুলাই দুপুরে বীণা রানী দুপুরের খাবার খেতে কারখানা থেকে বাসায় ফিরছিলেন। এসময় তাকে জোর করে অপহরণ করেন রাফিজুল। এ ঘটনায় বাড্ডা থানায় একটি সাধারণ ডায়েরি (জিডি) করেন বীণা রানীর মা। ঘটনার পাঁচদিন পর খুলনা থেকে বীণা রানী মণ্ডলকে উদ্ধার করে পুলিশ। এরপর অপহরণ মামলায় গ্রেফতার করা হয় রাফিজুলকে। পরে তিনি জামিনও পান।
গত বছরের ১৯ অক্টোবর রাজধানীর ডেমরা থেকে অষ্টম শ্রেণি পড়ুয়া এক কিশোরীকে (১৩) অপহরণ করেন মো. জিসান নামের এক তরুণ। অপহরণের কয়েকদিন পর ওই কিশোরীকে বামৈল এলাকা থেকে উদ্ধার করে পুলিশ। স্কুলে যাওয়া-আসার পথে প্রতিনিয়ত ওই কিশোরীকে প্রেমের প্রস্তাব দিয়ে উত্ত্যক্ত করতেন জিসান। বারবার ওই প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করায় জিসান ক্ষিপ্ত হন। এরপর পূর্ব পরিকল্পিতভাবে স্কুল থেকে বাড়ি ফেরার পথে ওই কিশোরীকে অপহরণ করেন জিসান।
আরও পড়ুন: প্রেম করে পালিয়ে যাওয়ার ঘটনায়ও হয় অপহরণ মামলা
রাজধানীতে অপহরণের শিকার এমন বেশিরভাগ ঘটনারই ভুক্তভোগী নারী ও শিশু। ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশের (ডিএমপি) তথ্য মতে, ২০২২ সালে রাজধানীতে ৪৯০ জনকে অপহরণ করা হয়। এর মধ্যে ২৪৭ জন নারী ও ১৯৪ জন শিশু। বাকি ৪৯ জন প্রাপ্তবয়স্ক পুরুষ অপহরণের শিকার হন। অর্থাৎ রাজধানীতে অপহরণের ৯০ শতাংশেরই ভুক্তভোগী নারী ও শিশু। এছাড়া গত পাঁচ বছরে শুধু ঢাকা মহানগরীতে নারী ও শিশু অপহরণের ঘটনায় দুই হাজার ৩৬৫টি মামলা হয়েছে। এর মধ্যে নারী অপহরণের ঘটনায় মামলা এক হাজার ৫১০টি ও শিশু অপহরণ মামলা ৮৫৫টি।
এসব অপহরণের মামলার মধ্যে প্রেমের সম্পর্কের জেরে পালিয়ে যাওয়ার ঘটনাও ছিল। গত বছর বাড্ডার আলাতুন্নেছা উচ্চ মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের দশম শ্রেণির আসমা খাতুন (ছদ্মনাম) তার সহপাঠীর সঙ্গে পালিয়ে যায়। এ ঘটনায় আসমার বাবা বাড্ডা থানায় একটি অপহরণ মামলা করেন।
মামলার বিষয়ে জানতে চাইলে জাগো নিউজকে আসমার বাবা বলেন, আসলে আমার মেয়েকে খুঁজে পাচ্ছিলাম না। ঘটনার দুই মাস পর মেয়েকে ফিরে পেয়েছি। আমরা সন্দেহমূলকভাবে যেই ছেলের নামে মামলা দিয়েছিলাম তার পরিবারের সঙ্গে সমঝোতা হয়েছে। দুজনের সম্পর্কের কথা জানার পর দুই পক্ষ বিষয়টি মীমাংসা করেছি। বর্তমানে ছেলে-মেয়ে দুজনই তাদের নিজেদের পরিবারের সঙ্গে আছে। প্রাপ্তবয়স্ক হওয়ার পর তাদের বিয়ে দেওয়া হবে। আমরা এখন মামলা উঠিয়ে নেবো। উকিলের সঙ্গেও কথা হয়েছে।
আরও পড়ুন: নারীকে ফাঁদ বানিয়ে অপহরণ, এরপর চাঁদাবাজি
রাজধানীর বিভিন্ন থানায় কথা বলে জানা গেছে, নারী ও শিশু অপহরণের ঘটনা অধিকাংশই প্রেমঘটিত। এসব ঘটনায় ভুক্তভোগী ও অভিযুক্তদের অধিকাংশের বয়স ১৫ থেকে ২৫ বছরের মধ্যে। এরমধ্যে যারা ১৫ থেকে ১৭ বছর বয়সী তাদের ক্ষেত্রে নারী ও শিশু নির্যাতন আইন অনুযায়ী শিশু অপহরণ মামলা হয়। এসব ঘটনায় অভিভাবকরা সাধারণত অপহরণ মামলা করেন।
প্রেমের কারণে অপহরণ হওয়া মামলার বিষয়ে বাড্ডা থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) আবুল কালাম আজাদ জাগো নিউজকে বলেন, অপ্রাপ্ত বয়সে আবেগের বশে অনেক সময় প্রেমের সম্পর্কের কারণে কেউ কেউ পালিয়ে যায়। যেহেতু মেয়ে অপ্রাপ্তবয়স্ক, ফলে অভিভাবকরাও অপহরণ মামলা করেন। তবে যখন ওই মেয়ে ফিরে আসে তখন দুই পরিবার যদি মীমাংসা করতে চায় তো তখন মামলা তুলে নেয়।
রাজধানীতে বছরজুড়ে নারী ও শিশু অপহরণের পাশাপাশি প্রাপ্তবয়স্ক পুরুষ অপহরণের ঘটনা ঘটেছে অর্ধশত। ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশের (ডিএমপি) তথ্য মতে, ২০২২ সালে রাজধানীতে এ ধরনের ৪৯টি অপহরণের ঘটনা ঘটেছে। এরমধ্যে সবচেয়ে বেশি অপহরণের ঘটনা ঘটেছে ডিএমপির মিরপুর বিভাগে। এ এলাকায় গত বছর এজাতীয় ১০টি অপহরণের ঘটনা ঘটেছে। এছাড়া তেজগাঁও বিভাগে আটটি, মতিঝিল, ওয়ারী বিভাগে সাতটি করে, উত্তরায় ছয়টি, গুলশান, রমনায় পাঁচটি করে এবং লালবাগ বিভাগে একটি অপহরণের ঘটনা ঘটেছে। তবে এসব অপহরণের ঘটনা কতগুলো কী কারণে হয়েছে- এ সংক্রান্ত তথ্য পাওয়া যায়নি।
আরও পড়ুন: পালিয়ে বিয়ে, অপহরণ মামলা তুলে নিতে তরুণীর আত্মহত্যার হুমকি
রাজধানীর মিরপুরে চাচা শফি উদ্দিন আহম্মেদের বাসায় থেকে পড়ালেখা শেষে দেশের বাইরে যাওয়ার চেষ্টা করছিলেন নুরুল আমিন তপু। গত বছরের ২ জানুয়ারি নিখোঁজ হন তপু। এ ঘটনায় অজ্ঞাতদের আসামি করে অপহরণ মামলা করেন শফি উদ্দিন। নিখোঁজের দুদিন পর মিরপুর বেড়িবাঁধ এলাকায় তপুর মরদেহ উদ্ধার করা হয়। আসামিরাও গ্রেফতার হন।
এ বিষয়ে জাগো নিউজকে শফি উদ্দিন আহম্মেদ বলেন, ছোটবেলা থেকেই তপুকে আমার সঙ্গে রেখে পড়ালেখা করিয়েছি। টাকার লোভে তাকে অপহরণ করা হয়। অপহরণকারীরা চেয়েছিল তাকে অপহরণ করে আমার কাছ থেকে টাকা নেবে। কিন্তু তারা তপুকে নিয়ে মেরে ফেলেছে। অপহরণকারী তিনজন জেলে আছে। তাদের সর্বোচ্চ শাস্তি চাই।
২০২২ সালের ১ ডিসেম্বর সকালে রাজধানীর ভাটারা এলাকার বাসা থেকে কাজের জন্য বের হন মো. রবিউল ইসলাম লতিফ। দুপুরে গুলশান নতুন বাজার এলাকা থেকে অপহরণের শিকার হন তিনি। বিকেলে স্ত্রী নূর জাহান আক্তার লতার মোবাইল ফোনে একটি কল আসে। ফোনে অপহরণকারীরা জানান, তার স্বামীকে আটকে রাখা হয়েছে। অপহরণকারীরা লতার কাছে ৭ লাখ টাকা দাবি করেন। না দিলে তার স্বামীকে মেরে ফেলা হবে বলে হুমকি দেন। এরপর ৯৯৯ এ ফোন দিয়ে এ ঘটনা জানান লতা। পরে গুলশান থানার সহযোগিতা নেন তিনি। তবে অপহরণকারীরা বারবার অবস্থান পরিবর্তন করায় তাদের শনাক্ত করতে সমস্যা হচ্ছিল। একসময় তারা বুঝতে পারেন আইনশৃঙ্খলা বাহিনী তাদের গতিবিধি লক্ষ্য রাখছে। এরপর অনেকটা ভয়েই তারা লতিফকে নারায়ণগঞ্জের সোনারগাঁও থানায় নিয়ে যান। সেখান থেকে পুলিশ তাদের আটক করে।
আরও পড়ুন: মায়ের ‘অপহরণ’ সাজানো, নিয়মিত টাকা পাঠাতেন মরিয়ম
এ বিষয়ে নূর জাহান আক্তার লতা জাগো নিউজকে বলেন, পুলিশ আমাকে সহযোগিতা করে, পাশাপাশি অপহরণকারীদের সঙ্গে যোগাযোগ রাখি। একটা সময় অপহরণকারীরা ধারণা করেন যে আমরা বিষয়টি র্যাবকে জানিয়েছি। পরে ভয়ে তারা আমার স্বামীকে সোনারগাঁও থানায় নিয়ে যান। অপহরণকারীরা তখন গ্রেফতার হলেও এখন জামিনে মুক্ত। এখন নতুন করে হুমকি দিচ্ছেন তারা।
অর্থ ছিনিয়ে নেওয়ার জন্যও অনেক সময় অপহরণ এবং খুনের ঘটনা ঘটে। পুরান ঢাকার ইসলামবাগে প্লাস্টিকের ব্যবসা করতেন মো. জুয়েল শিকদার। গত বছরের ১৪ ডিসেম্বর দোকানের কর্মচারী মোর্শেদ আলমকে নিয়ে প্লাস্টিকের কাঁচামাল কেনার জন্য বের হন। এ সময় তার সঙ্গে ছিল ৫ লাখ ২০ হাজার টাকা। ওইদিন রাতে বাসায় না ফেরায় জুয়েল ও মোর্শেদকে ফোন করেন তাদের পরিবারের সদস্যরা। তবে তাদের ফোন বন্ধ ছিল। এ ঘটনায় জুয়েলের বাবা হাজি মো. আশরাফ অজ্ঞাতদের আসামি করে চকবাজার মডেল থানায় অপহরণ মামলা করেন। ঘটনার চারদিন পর ভোলা থেকে দুজনের মরদেহ উদ্ধার করে পুলিশ।
মামলার বিষয়ে হাজি মো. আশরাফ জাগো নিউজকে বলেন, ঘটনার পর চারজনকে গ্রেফতার করেছে পুলিশ। তবে এখনো মূল আসামিকে গ্রেফতার করতে পারেনি। অপহরণের সময় জুয়েলের কাছে যেই টাকা ছিল সেই টাকাও ফিরে পাওয়া যায়নি। মূল আসামি ধরা না পড়ায় মামলারও কোনো অগ্রগতি হচ্ছে না। পুলিশও এখন আর আগের মতো গুরুত্ব দেয় না।
তবে অপহরণের ঘটনায় শুধু সাধারণ অপরাধীই নয়, আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যদের জড়িত থাকারও অভিযোগ রয়েছে। গত বছরের ১ নভেম্বর রাজধানীর ধানমন্ডি থেকে অপহরণের শিকার হন ব্যবসায়ী মোহাম্মদ মাহবুব আলী খান। ঘটনার দিন সন্ধ্যায় ১০-১২ জন সিআইডি পুলিশ পরিচয়ে মাহবুব আলীকে তুলে নেন। তার বিরুদ্ধে মামলা রয়েছে- এমন কথা বলে মাহবুবকে হাতকড়া পরিয়ে ধরে নিয়ে যান তারা। পরে পল্টনের ইসলাম টাওয়ারের আন্ডারগ্রাউন্ডে নিয়ে টাকা আদায়ের জন্য তাকে শারীরিকভাবে নির্যাতন করে টাকা আদায় করা হয়। এরপর ২ নভেম্বর শাহবাগ থানার পুরোনো একটি মামলায় মাহবুবকে গ্রেফতার দেখিয়ে আদালতে পাঠানো হয়। ৬ নভেম্বর জামিনে ছাড়া পান মাহবুব। এর তিনদিন পর ৯ নভেম্বর অপহরণে জড়িত তিন পুলিশ সদস্যসহ ছয়জনকে গ্রেফতার করে গোয়েন্দা পুলিশ (ডিবি)।
আরও পড়ুন: ‘মাহবুব আমাকে অপহরণ করেনি, আমরা বিয়ে করেছি’
অপহরণকে ধরা হয় মানবাধিকারের চরম লঙ্ঘন হিসেবে। ফলে অপহরণের ক্ষেত্রে প্রতিটি ঘটনাকে গুরুত্ব দিয়ে কঠোর ব্যবস্থা নেওয়া উচিত। একই সঙ্গে আইনের দ্রুত বাস্তবায়ন ও শাস্তি নিশ্চিত করা প্রয়োজন বলে মনে করেন মানবাধিকারকর্মীরা।
আইন ও সালিশ কেন্দ্রের (আসক) নির্বাহী পরিচালক মো. নূর খান লিটন জাগো নিউজকে বলেন, অপহরণের ঘটনা নতুন নয়। অপহরণেরও বিভিন্ন রকমফের রয়েছে। দুর্বৃত্তরা কখনো জিম্মি করে টাকা আদায় করে, কখনো মারধর করে। আবার কখনো এ ধরনের ক্ষেত্রে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যদের সম্পৃক্ত থাকার কথাও শোনা যায়। যেই ধরনের অপহরণই হোক না কেন, রাষ্ট্রের পক্ষ থেকে কঠোর ব্যবস্থা নেওয়া উচিত। অপহরণের মতো বর্বরোচিত ঘটনা মানবাধিকারের চরম লঙ্ঘন।
জাতীয় মানবাধিকার কমিশনের সদস্য ড. তানিয়া রহমান জাগো নিউজকে বলেন, আমরা দিনের পর দিন এমন জায়গায় গিয়ে পৌঁছেছি যে আমাদের সহ্য ক্ষমতা কমে যাচ্ছে। তা না হলে কীভাবে ইচ্ছে হলেই খুন, অপহরণ করছি! অপহরণ মামলাগুলো সহজভাবে দেখার কোনো কারণ নেই। পুলিশের আরও গুরুত্ব দিয়েই দেখা উচিত। কারণ আইন যথাযথভাবে দ্রুত প্রয়োগ করলে সেটা ভঙ্গ করতে গেলে অন্যরা আরও সতর্ক হবে। তখন এ ধরনের ঘটনাও কমে যাবে।
তবে পুলিশ বলছে, আইন যেভাবে আছে সেটা যত দ্রুত বাস্তবায়ন করা যায় সেই কাজটাই করছে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী।
ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশের (ডিএসপি) অতিরিক্ত পুলিশ কমিশনার ড. খ. মহিদ উদ্দিন জাগো নিউজকে বলেন, আইন যেভাবে আছে আমরা সেটা যত দ্রুত বাস্তবায়ন করা যায় সেই কাজটা করি। অপহরণের অধিকাংশ ঘটনাই আমরা শনাক্ত করেছি। অপহরণের মামলার ক্ষেত্রেও কোনো ঢিলেমির সুযোগ নেই।
আরএসএম/কেএসআর/এমএস