সাংবাদিকতায় চাই সোনালী অতীত


প্রকাশিত: ০৭:৫৭ এএম, ০৬ ডিসেম্বর ২০১৪

রাফে সাদনান আদেল, সংবাদকর্মী

সাংবাদিকতা কি আসলেই কোনো চাকরি? সাংবাদিকতাকে চাকরি মানতে অন্তত আমি নারাজ। খুব অল্প সময়ে সাংবাদিকতার যতগুলো মাধ্যম হতে পারে প্রিন্ট, ইলেকট্রনিক ও অনলাইনে কাজ করার সৌভাগ্য আমার হয়েছে। আর সেই অভিজ্ঞতার ওপর ভর করেই দুটো কথা লেখার স্পর্ধা করছি।

গত সাড়ে ছয় বছরে দেশের গণমাধ্যমের অন্তত গোটা পাঁচেক বিনিয়োগকে ঘিরে হাজারো গণমাধ্যমকর্মীর স্বপ্ন। আর সেই স্বপ্নকে বাস্তব করার জন্য যে যুদ্ধ তা কাছ থেকে দেখেছি। বলতে দ্বিধা নেই বেশিরভাগ সময়ই হতাশ হয়েছি। চাতক পাখির মতো নির্বোধে চুপ করে তাকিয়ে না থেকে চড়ুই পাখির মতো ছটফট করে ঘুরে বেড়িয়েছি। তাতে হয়ত প্রতিনিয়ত সমৃদ্ধ হয়েছি, কেননা আমি আশাবাদীদের একজন।

কিন্তু কি করছি আমরা, কার জন্যই বা করছি! এর নাম কি সাংবাদিকতা? একটা সময় ছিল সকালের শিশির সিক্ত ফ্লোরে পরে থাকা আঁধো ভেঁজা সংবাদপত্রই ঠিক করে দিত দিনের বাকিটা সময়ে আড্ডার বিষয়। সংবাদপত্রের লিড নিয়ে চলতো চায়ের কাপে তুমুল ঝড়। কোনো কোনো পত্রিকা যেন নিজের কথাই বলতো আর তা সবার সাথে মিশে যেত, কখনো কখনো সেই পত্রিকার সম্পাদকীয় নীতিই রচনা করতো আগামীর ইতিহাস। কোনো অনুসন্ধানী প্রতিবেদন পড়ে মনটা চাইতো সেই সাহসী মানুষটার সাথে যদি একবেলা সময় কাটানো যেত! তারপর প্রযুক্তির ঝনঝনাতিতে আমাদের চোখ চলে গেল বোকাবাক্সের দিকে! সে কী বোকাবাক্সেও তো আমাদের কথা বলে। আবার যখন যেখানে যা ঘটছে আমাদের সব ঘটনা আমরাই তো হা করে দেখছি এই বোকাবাক্সেই! মোবাইল ফোনে অনলাইন থেকে আসা এসএমএস এলেই রিনঝিন শব্দ, ব্রেকিং নিউজ, তথ্যের মাঝেই ভেসছি যেন।  

কী লিখছি এসব কিছুই তো নতুন নয়। ভণিতা করলাম ক্ষণিকক্ষণ। আসল প্রসঙ্গে আসবো একটা ছোট্ট গল্প বলেই। টেলিভিশনে রাজউকের কয়েকজন কর্মকর্তার ঘুষ নেয়া গোপন ক্যামেরায় দেখিয়ে আমার রিপোর্ট প্রচার হলো কোন এক বেসরকারি টেলিভিশনে। অনেকদিন পর কাজে ফিরে এমন রিপোর্টের পর কতো এসএমএস, কতো ফোন কল, এমনকি নিজ প্রতিষ্ঠানের কর্তাব্যক্তিরও ফোন কল আর তাতে অপ্রত্যাশিত প্রশংসার ঝুলি! প্রসঙ্গ নিজের ঢোল পেটানো নয়। প্রসঙ্গ হলো মাস দুই পরে সেই রাজউক অফিসে গিয়ে দেখলাম সেই ব্যক্তি এখনো ঘুষ নিচ্ছেন, এখন বড়ং লাজ লজ্জার বালাই নাই, নিজ কানেই তাকে বলতে শুনলাম, `মান ইজ্জত যা যাওনের গেসে গা কামায়া লই!` তাহলে বিষয়টা কি দাড়ালো? আমার করা সেই তুমুল প্রশংসিত রিপোর্টের ফলাফল কি শূন্য? কেন শূন্য, কি কমতি ছিল তাতে? এমন হাজারো হতাশার কথা উঠে আসে আমারই চারপাশে সহকর্মীদের মুখে। কতো শতো ভালো ভালো অনুসন্ধানী রিপোর্ট মুখ থুবড়ে পরে এভাবেই। সাংবাদিকতা মানে তো ইনহাউজ প্রশংসা নয়। সাংবাদিকতা তো করি সমাজে পরিবর্তন আনার জন্য। আমার সহকর্মীরা এমনই বলেন।

আসলে, কমতি নয় বরং আধিক্যের জন্যই পাত্তা পায়না এখন আর সাংবাদিকদের কোনো কিছুই। ব্যর্থ হয় সব কষ্ট। পত্রিকা আছে লাখ খানেক (আনুমানিক), অনলাইনের সংখ্যা গোণার সাহস করে কে! টেলিভিশন তাও তো গোটা পচিঁশ, রেডিও গোটা পনের আসছে আরো, যুক্ত হচ্ছে কমিউনিটি রেডিও। এসব কি আসলেই অবাধ তথ্য নিশ্চিত করে, নাকি অন্য কিছু। ঢালাওভাবে গণমাধ্যমের বন্যা কি পলি মাটি জমানোর মতো সময় পাচ্ছে আদৌ? রাস্তায় বেরুলে অর্ধেক যানবাহনের বুকেই প্রেস শব্দ আঁটা। সাংবাদিকের এক বিরাট জমজমাট হাটে পরিণত হয়েছে বাংলাদেশ। একটা সময় ছিল মানুষ ঘড়ি ধরে বিশেষ কোনো চ্যানেলের সংবাদ দেখতো। আর আজ সময় কোথায়! হাজারো চ্যানেল। কখন কোনটা দেখে কে, তার নাই ঠিক।

যতো বড়ই সংবাদ মাধ্যম হোক না কেন, জনপ্রিয় না হলে কি লাভ তার। আর হাতে তো আছেই রিমোট। এতো চ্যানেলের ভিড়ে যাচ্ছে ভালো ভালো রিপোর্ট। এদিকে, হাজারো অনলাইনে কপি আর পেস্ট করা নিউজ, হিট বাড়াতে অশ্লীলতার ছড়াছড়ি, রেডিও তো ব্যাক টু ব্যাক গান, যেকটায় নিউজ ছিল সাংবাদিকতার সবচেয়ে দ্রুত মাধ্যমে তাতেও বাধ সেধেঁছে গবেষণার ফল। তারা বলছে রেডিও মাধ্যমে সংবাদ জনপ্রিয় নয় ! কি আশ্চর্য এখনো মানুষ সময় করে বিবিসি শোনে! আর সেই দেশের মানুষকে আপনি খবর দিতে পারছেন না রেডিওতে! অভাব গ্রহণযোগ্যতা গড়ে তুলবার প্রশ্নে। অনলাইন আর টেলিভিশনও তাই।

এভাবেই কী তাহলে শেষ হলো আমাদের গ্রহণযোগ্যতা। আর হবেই বা না কেন? এর দায় তো নিতে হবে আমাদেরই। অতীতের সাংবাদিকদের অনেক অর্থ কষ্ট করতে হয়েছে। কিন্তু সেই দিন কি আর আছে দিন বদলাচ্ছে না। এখন আর দশটা কর্পোরেট চাকরির মতো লাখ টাকা বেতনের সাথে গাড়িও হাকায় সিনিয়র সাংবাদিকরা। নিঃসন্দেহে ভালো উন্নতি, কিন্তু এতে করে তো গুটিকয় ভালো আছে। আর তারা পুরো পেশাটাকেই ফেলে দিয়েছেন তুমুল ঝুঁকির মাঝে।

একবারও কি ভেবেছেন এভাবে? চাহিদার চাইতেও বেশী মিডিয়া হাউজ দিয়ে সরকার বলছে, গণমাধ্যমে তাদের এনে দেয়ার জোয়াড়ের বুলি। আর এই জোয়াড়ে যে তিলতিল করে গড়ে ওঠা সাংবাদিকতার শক্তি কমে গেল, কমে গেল তার প্রভাব তাতে কার কিই বা যায় আসে যায়। কেননা তারা তো ভালো আছেন! ভালো আছি আমরাও! আমি শুধু বলতে চাই, এই ভালো থাকা বড্ড সাময়িক। সামনের দিন ভালো কিছু দেবে না বলেই আমার আশঙ্কা। এই পেশা এখন চাকরি হয়ে গেছে। এই পেশা এখন পুজিঁপতিদের হাতে চলে গেছে, আমরা কী তাদের গোলাম হয়ে যাচ্ছি প্রতিনিয়ত।

ব্যাঙের ছাতার মতো মিডিয়া হাউজ গুড়িয়ে দিচ্ছে সাংবাদিকতা, গুড়িয়ে দিচ্ছে পেশাদারিত্ব; আমরা সাংবাদিক থেকে বনে যাচ্ছি জ্বি হুজুর সম্প্রদায়ের জীবে। এর নাম সাংবাদিকতা নয়। আর আমার মতো চুনোপুঁটি সাংবাদিক এই অবস্থার কোনোই পরিবর্তন করতে পারবে না। দায়িত্ব নিতে হবে আপনাদেরই। প্রশিক্ষণ সেন্টার কিংবা পুর্ণবাসন নয়, গড়ে উঠুক পেশাদারিত্বপূর্ণ সাংবাদিকতার আবাসস্থল। সাংবাদিকতা ফিরে আসুক আগের আভাঁয়। অনুসন্ধানী রিপোর্ট ফিরে পাক পুরোনো শক্তি। আর নিপাত যাক শখের বসে গড়ে ওঠা গণমাধ্যমগুলো, হারিয়ে যাক শখের বসে শুধুমাত্র দর্শনধারী তারকা হবার স্বপ্ন নিয়ে গণমাধ্যমে আসা তথাকথিত সাংবাদিকরা।

পাঠকপ্রিয় অনলাইন নিউজ পোর্টাল জাগোনিউজ২৪.কমে লিখতে পারেন আপনিও। লেখার বিষয় ফিচার, ভ্রমণ, লাইফস্টাইল, ক্যারিয়ার, তথ্যপ্রযুক্তি, কৃষি ও প্রকৃতি। আজই আপনার লেখাটি পাঠিয়ে দিন [email protected] ঠিকানায়।