১১ কোটি টাকা নিয়ে যাওয়া গাড়ি কেন নির্জন রাস্তায়

তৌহিদুজ্জামান তন্ময়
তৌহিদুজ্জামান তন্ময় তৌহিদুজ্জামান তন্ময় , নিজস্ব প্রতিবেদক
প্রকাশিত: ১২:৫২ এএম, ১০ মার্চ ২০২৩
টাকা বহন করা গাড়ি

রাজধানীর মিরপুর ডিওএইচএসে মানি প্ল্যান্ট লিংক প্রাইভেট লিমিটেড নামের সিকিউরিটি কোম্পানির অফিস। সেখান থেকে সোয়া ১১ কোটি টাকা নিয়ে ঢাকা মেট্রো-চ-৫১-৬৫৭৯০ নম্বরের একটি গাড়িতে করে সাভারে ডাচ-বাংলা ব্যাংকের বুথে যাচ্ছিলেন দায়িত্বপ্রাপ্ত পাঁচজন। পথে উত্তরার ১৬ নম্বর সেক্টরে ১১ নম্বর ব্রিজ এলাকায় টাকা ছিনতাইয়ের ঘটনা ঘটে।

সংশ্লিষ্টরা জানিয়েছেন, ছিনতাইয়ের সময় ছিনতাইকারীদের হাতে ছিল না কোনো অস্ত্র। আবার সোয়া ১১ কোটি টাকা নিয়ে যারা যাচ্ছিলেন তাদের কাছেও ছিল না অস্ত্র। প্রশ্ন উঠেছে, এত টাকা নিয়ে যাওয়ার দায়িত্বে থাকা ব্যক্তিরা কেন অস্ত্র নেননি? কেন ছিনতাইকারীদের তারা ধরতে পারলেন না?

সিকিউরিটি কোম্পানিটির দাবি, টাকা থাকা গাড়িতে অস্ত্র না থাকলেও পেছনে থাকা আরেকটি গাড়িতে অস্ত্র ছিল। তবে সেটি আগেই সিগন্যালে আটকা পড়ে।

এতে প্রশ্ন উঠেছে, অস্ত্রের গাড়ি আটকা পড়ার পরও কেন টাকার গাড়ি পিছপা হলো না?

তদন্ত কর্মকর্তারা জানান, ছিনতাইয়ের ঘটনাটি পরিকল্পিত। বেশ কিছুদিন ধরেই ছিনইতাইকারীরা ওই সিকিউরিটি কোম্পানির লোকদের অনুসরণ করছিলেন। তারা সুযোগ খুঁজছিলেন। বৃহস্পতিবার সুযোগ বুঝে সিকিউরিটি কোম্পানির লোকদের মারধর করে সোয়া ১১ কোটি টাকা ছিনিয়ে নেয়। ৪টি বক্সে থাকা টাকা ছিনিয়ে নেওয়ার পর ছিনতাইকারীরাও বুঝতে পারছিল না, এত টাকা তারা কী করবে? তারাও বুঝতে পারেনি সোয়া ১১ কোটি টাকা ছিনতাই করেছে!

ডিবি জানায়, ছিনতাইয়ের প্রায় সাড়ে ৮ ঘণ্টা পর তথ্যপ্রযুক্তি, উত্তরা এলাকার বিভিন্ন স্থানের সিসি ক্যামেরার ফুটেজ ও বিভিন্ন সোর্স ব্যবহার করে ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা (ডিবি) পুলিশ রাজধানীর উত্তরায় অভিযান চালিয়ে ছিনতাইয়ের সঙ্গে জড়িত সাতজনকে আটক করে। তাদের মধ্যে রয়েছেন মানি প্ল্যান্ট লিংক প্রাইভেট লিমিটেড নামের সিকিউরিটি কোম্পানির দুজন পরিচালক ও গাড়িচালক। যে টাকা উদ্ধার হয়েছে তার পরিমাণ হতে পারে প্রায় ৯ কোটি। এ সময় পালিয়ে যায় আরও কয়েকজন। তাদের গ্রেফতার ও বাকি টাকা উদ্ধারেও কাজ চলমান রয়েছে।

ডিবি জানিয়েছে, এত টাকা ছিনতাইয়ের ঘটনায় বেশ কয়েকজনের নাম পাওয়া গেছে। আটকদের বিভিন্ন বিষয় নিয়ে জিজ্ঞাসাবাদ করা হবে। এছাড়া সাভারে টাকা নিয়ে যাওয়ার সময় কেন তারা অস্ত্র সঙ্গে নিলেন না, সেটিরও তদন্ত চলছে।

জানতে চাইলে ডিএমপির উত্তরা বিভাগের উপ-পুলিশ কমিশনার (ডিসি) মোর্শেদ আলম জাগো নিউজকে বলেন, ছিনতাই করতে আসা গাড়িটিতে ১০ থেকে ১২ জন ছিলেন বলে ভুক্তভোগীরা জানিয়েছেন। তবে তাদের হাতে কোনো অস্ত্র ছিল না। ছিনতাইকারীরা নিজেদের ডিবি বলে পরিচয় দেয়।

ছিনতাইয়ের এ ঘটনা পূর্বপরিকল্পিত দাবি করে তিনি বলেন, এতগুলো টাকা ওদিক দিয়ে যাবে ছিনতাইকারীরা তা জানবে কী করে? নিশ্চয়ই পূর্বপরিকল্পনা ছিল। কারণ দিনের বেলায় ঢাকায় ছিনতাই ও ডাকাতির এত বড় ঘটনা ঘটার মতো পরিস্থিতি নেই। যা ঘটে ছোটখাটো, মধ্য রাতে। সকালবেলায় এ ধরনের ছিনতাই নিশ্চয় পূর্বপরিকল্পিত।

আরও পড়ুন: তিন বক্স টাকা উদ্ধার, সিকিউরিটি কোম্পানির দুই পরিচালকসহ আটক ৭

প্রতিষ্ঠানটির কোনো সদস্য এ ঘটনায় জড়িত কি না সেটিও আমরা খতিয়ে দেখবো। আমরা সবকিছু বিবেচনায় তদন্ত করছি, যোগ করেন উত্তরার ডিসি।

বেশি পরিমাণ টাকা স্থানান্তরের ক্ষেত্রে পুলিশকে জানানোর জন্য ডিএমপি বারবার অনুরোধ করেছে। অথচ এতগুলা টাকা সকালবেলায় এমন নির্জন স্থান দিয়ে সাভার নেওয়া হচ্ছিল! পুলিশকে জানানো হয়েছিল কি না, পুলিশের নিরাপত্তা নজরদারির ঘাটতি ছিল কি না জানতে চাইলে ডিসি মোর্শেদ আলম বলেন, না, তারা আগে থেকে পুলিশকে কিছু জানায়নি। ৫ থেকে ১০ লাখের বেশি হলে টাকা স্থানান্তরের ক্ষেত্রে পুলিশকে জানানোর নিয়ম। কিন্তু তারা সেটি করেননি। এখানে পুলিশের কোনো অবহেলা দেখার সুযোগ নেই।

ডিএমপির সাইবার অ্যান্ড স্পেশাল ক্রাইম গোয়েন্দা-উত্তর বিভাগের যুগ্ম পুলিশ কমিশনার খোন্দকার নুরুন্নবী জাগো নিউজকে বলেন, তথ্য-প্রযুক্তি, উত্তরা এলাকার বিভিন্ন স্থানের সিসি ক্যামেরার ফুটেজ ও বিভিন্ন সোর্স ব্যবহার করে ঘটনার কয়েক ঘণ্টার মধ্যে তিন বক্স টাকা উদ্ধার (মোট চার বক্স ছিল) ও ৭ জনকে জিজ্ঞাসাবাদের জন্য আটক করা হয়েছে। তবে অভিযানের সময় বাকি টাকাসহ আরও কয়েকজন পালিয়ে যায়। তাদেরসহ ছিনতাই হওয়া টাকা উদ্ধারে আমরা কাজ করছি।

ডিএমপির গোয়েন্দা বিভাগের প্রধান, অতিরিক্ত পুলিশ কমিশনার মোহাম্মদ হারুন অর রশীদ বলেন, ডাচ্-বাংলা ব্যাংক লিমিটেডের ছিনতাই হওয়া ১১ কোটি ২০ লাখ টাকার মধ্যে তিন বক্স (প্রায় ৯ কোটি) টাকা উদ্ধার করেছে ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা (ডিবি) পুলিশ। এসময় মানি প্ল্যান্ট লিংক সিকিউরিটিজ কোম্পানি লিমিটেডের দুজন পরিচালকসহ সাতজনকে আটক করা হয়েছে। এটি পরিকল্পিত ঘটনা। ছিনতাইকারীরা অনেক আগে থেকে টাকা ছিনিয়ে নেওয়ার পরিকল্পনা করছিলেন।

তিনি বলেন, বৃহস্পতিবার সকালে গাড়িটি মিরপুর-১২ নম্বর থেকে রওনা দেয়। উত্তরায় যাওয়ার পথে ছিনতাইকারীরা গাড়িটি থামায়। ওই গাড়িতে টাকা নিয়ে যাওয়ার কাজে নিয়োজিত ছিলেন মোট ছয়জন। ছিনতাইকারীরা তাদের মারধর করে গাড়ি ও টাকার চারটি বক্স নিয়ে পালিয়ে যায়। চার বক্সে মোট ১১ কোটি ২০ লাখ টাকা ছিল।

ডিবিপ্রধান বলেন, খবর পেয়ে ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশের টিম সঙ্গে সঙ্গে ঘটনাস্থলে যায়। দ্রুত রাজধানীর বিভিন্ন জায়গায় টহল বসানো হয়। বিভিন্ন থানা পুলিশের সহযোগিতায় ডিবির সদস্যরা টাকা উদ্ধার ও ছিনতাইকারীদের ধরতে কাজ শুরু করেন। একপর্যায়ে উত্তরা এলাকা থেকে পালানোর সময় তিনটি বক্সসহ সাতজনকে আটক করা হয়।

এই গাড়ি থেকে উদ্ধার হয় তিন বক্স টাকা 

টাকা ছিনতাইয়ের ঘটনা পরিকল্পিত জানিয়ে হারুন অর রশীদ বলেন, মানি প্ল্যান্ট লিংক সিকিউরিটিজ কোম্পানি লিমিটেডের টাকা আনা-নেওয়ার বিষয়টি ছিনতাইকারীরা অনেক দিন ধরে ফলো (অনুসরণ) করছিলেন। দুর্ভাগ্যজনক হলেও সত্য ছিনতাইকারীদের হাতে কোনো অস্ত্র ছিল না।

তিনি বলেন, এ ঘটনায় আমরা বেশ কয়েকজনের নাম পেয়েছি। মানি প্ল্যান্ট লিংক সিকিউরিটিজ কোম্পানি লিমিটেডের দুজন পরিচালসহ সাতজনকে আটক করা হয়েছে। তাদের জিজ্ঞাসাবাদের পর বিস্তারিত বলা যাবে।

হারুন অর রশীদ বলেন, যারা এতগুলা টাকা একসঙ্গে নিয়ে যাচ্ছিলেন তাদের কারো কাছে অস্ত্র ছিল না। তারা কেন ছিনতাইকারীদের ধরতে পারলেন না, কেন পিছপা হলো না। এসব বিষয় জিজ্ঞাবাদ করা হবে।

এতগুলো টাকা নিয়ে যাওয়ার সময় গাড়িতে কেন অস্ত্র ছিল না জানতে চাইলে মানি প্ল্যান্ট লিংক প্রাইভেট লিমিটেডের ম্যানেজার রুবেল হোসেন জাগো নিউজকে বলেন, টাকা থাকা গাড়িতে অস্ত্র না থাকলেও পেছনের গাড়িতে অস্ত্র ছিল। তবে ট্রাফিক সিগন্যালে আটকে পড়ায় অস্ত্র থাকা গাড়িটি পেছনে পড়ে যায়।

অস্ত্র থাকা গাড়িটি পেছনে পড়ে গেলেও সকালে নির্জন রাস্তায় টাকা থাকা গাড়িটি কেন সামনের দিকে এগিয়ে গেলো, এমন প্রশ্নের পর তিনি কোনো উত্তর না দিয়ে ফোন কেটে দেন।

টিটি/এমএইচআর

পাঠকপ্রিয় অনলাইন নিউজ পোর্টাল জাগোনিউজ২৪.কমে লিখতে পারেন আপনিও। লেখার বিষয় ফিচার, ভ্রমণ, লাইফস্টাইল, ক্যারিয়ার, তথ্যপ্রযুক্তি, কৃষি ও প্রকৃতি। আজই আপনার লেখাটি পাঠিয়ে দিন [email protected] ঠিকানায়।