জরুরি বিভাগ থেকে মর্গ: শঙ্কা আর আহাজারির করুণ দৃশ্য ঢাকা মেডিকেলে
বিকেল থেকে ছিল শঙ্কা। দিনের আলো শেষ হওয়ার পর সন্ধ্যার অন্ধকারে আকাশে জ্বলজ্বল করছে পূর্ণিমার চাঁদ। কিন্তু সে আলোতে যেন জীবনের অমানিশা দেখছেন গুলিস্তানে বিস্ফোরণের ঘটনায় প্রাণ হারানোদের স্বজনরা। তাদের আহাজারিতে ভারী হয়ে উঠেছে ঢাকা মেডিকেল কলেজ (ঢামেক) হাসপাতালের মর্গের করিডোর।
আবার স্বজনদের খোঁজে কেউ দিগ্বিদিক ছুটে বেড়াচ্ছেন। একবার জরুরি বিভাগ, আরেকবার মর্গে। আবার কেউ অপেক্ষা করছেন অ্যাম্বুলেন্স আসার।
মঙ্গলবার (৭ মার্চ) বিকেলে হওয়া বিস্ফোরণের পর থেকে সেখানে থাকা ব্যবসায়ী, কর্মচারীদের পরিবারের লোকজন উদ্বেগ-উৎকণ্ঠায় ছিলেন। কারো তাৎক্ষণিক খোঁজ মিলেছে। কারো এখনো মেলেনি। আর কারো খোঁজ মিললেও সাক্ষাতের সুযোগ হবে না কখনো।
মঙ্গলবার সন্ধ্যার পর থেকে রাত ১১টা পর্যন্ত ঢামেকে দেখা গেছে এ দৃশ্য।
দুই সপ্তাহ আগে কাতার থেকে বিয়ে করতে দেশে এসেছিলেন সুমন (২১)। আজ তার মা শবে বরাতের রোজা রেখেছিলেন। মায়ের জন্য ইফতার কিনতে এসেছিলেন সিদ্দিকবাজারে। গলিতে ইফতার কেনার সময়ে হঠাৎ বিস্ফোরণে আহত হন সুমন। তাকে তাৎক্ষণিক ঢাকা মেডিকেলে নিয়ে আসা হয়। সন্ধ্যার পর মারা যান তিনি। মর্গে রাখা অনেকগুলো লাশের মধ্যে শুধু তার বুকের উপরে লেখা ছিল নাম ও বয়স। মাথা থেতলে যাওয়া এ যুবকের পায়ে একজোড়া বেল্টের জুতা এখনো নতুন রয়েছে। জুতার বেল্ট এখনো খুলেনি।
হাসপাতালে একের পর এক তার স্বজনরা আসছেন। তার বন্ধুরা এসে ‘বন্ধু...’ বলে চিৎকার করছেন। কেউ আরেকটু বাড়িয়ে বলছেন, ‘বন্ধু কই গেলিরে...’। এভাবেই চলছে স্বজনদের আহাজারি। বোন এসেছিলেন মর্গে। ভাইয়ের মরদেহ দেখেই মূর্ছা যান তিনি। এসেছিলেন মা। শোকে পাথর মায়ের মুখ থেকে বেরোইনি কোনো কথা।
মানিকগঞ্জ বাড়ি বাবুল হোসেনের। তিনি গুলিস্তানে দুর্ঘটনাস্থলে তার বন্ধু বাশার মিয়ার দোকানে এসেছিলেন। বাশার মিয়া তার বন্ধুকে দোকানে রেখে বাইরে গিয়েছিলেন। বাইরে থেকে আসার আগেই বিস্ফোরণে নিখোঁজ হন বাবুল। সাড়ে আটটার দিকে ঢামেকের মর্গে তার মরদেহ শনাক্ত করেন শ্যালিকা নুরুন্নাহার বেগম। নুরুন্নাহার বেগম হাত দিয়ে দেখান। বাশার মিয়া কাছে গিয়ে তার বন্ধুকে দেখতে পান। এসময় দুইজনই কান্নায় ভেঙে পড়েন।
সেনেটারির দোকান ছিল নারায়ণগঞ্জের সোনারগাঁওয়ের ইসমাইলের। তার খোঁজে দোয়া ও মোনাজাত করেন তার ভাতিজা জোবায়ের। সন্ধান মেলেনি ইসমাইলের। সন্ধ্যার দিকে মর্গে ইসমাইলের মরদেহ পান বড় ভাই মো. হানিফ। হানিফকে দেখা যায় নির্বাক ঘুরতে। চোখ দিয়ে ঝরছিল পানি।
বিস্ফোরণ হওয়া মার্কেটের দোকানি মমিন উদ্দিন সুমনের মৃত্যুর কথা নিশ্চিত করেছে ফায়ার সার্ভিস। কিন্তু মৃত্যুর এ খবর এখনো মানেনি তার পরিবার। সুমন জীবিত বলে আশা পরিবারের লোকজনের। তাদের দাবি সে মরদেহ সুমনের নয়, দোকান কর্মচারী সম্রাটের।
এভাবেই ঢামেক এলাকায় অপেক্ষা করছেন শত শত মানুষ। রাত যত বাড়ছে, ততই বাড়ছে তাদের শঙ্কা আর আহাজারি।
আল-সাদী ভূঁইয়া/এমএইচআর