ডিবির জ্যাকেটে ‘কিউআর কোড’, তবু থামছে না প্রতারকরা

তৌহিদুজ্জামান তন্ময়
তৌহিদুজ্জামান তন্ময় তৌহিদুজ্জামান তন্ময় , জ্যেষ্ঠ প্রতিবেদক
প্রকাশিত: ০২:৫৪ পিএম, ৩১ জানুয়ারি ২০২৩
ডিবির পুরাতন ও কিউআর কোড সম্বলিত নতুন জ্যাকেট/সংগৃহীত

গায়ে ডিবির জ্যাকেট। কোমরে অস্ত্র। হাতে ওয়াকিটকি আর হ্যান্ডকাফ। প্রথমে দেখে যে কেউ মনে করতে পারেন গোয়েন্দা (ডিবি) পুলিশের সদস্য। আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যদেরও সন্দেহ হবে না। এই ছদ্মবেশে নির্জন সড়কে ভুয়া চেকপোস্ট বসিয়ে হচ্ছে ছিনতাই ও ডাকাতি। কালো গ্লাসের মাইক্রোবাস ব্যবহার করেও ডিবি পরিচয়ে চলছে অপহরণ।

এই ‘বদনাম’ থেকে রেহাই পেতে প্রকৃত ডিবি কর্মকর্তাদের জ্যাকেটে বসানো হয়েছে ‘কুইক রেসপন্স কোড’ বা ‘কিউআর কোড’। কিন্তু প্রতারকরা পুরোনো নকল জ্যাকেট ব্যবহার করে ঠিকই চালিয়ে যাচ্ছে তাদের প্রতারণা।

জানা যায়, গত বছরের ১ আগস্ট ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা (ডিবি) পুলিশের জ্যাকেটে যুক্ত হয় অত্যাধুনিক প্রযুক্তিসম্পন্ন ‘কুইক রেসপন্স কোড’ বা ‘কিউআর কোড’। এ জ্যাকেটের কিউআর কোডে কর্মকর্তাদের তথ্য আগে থেকেই জমা থাকে ডিবির নিজস্ব সার্ভারে। মোবাইল অ্যাপ দিয়ে সদস্যের কিউআর কোড স্ক্যান করলেই তাদের পরিচয় দেখা যায়। এক্ষেত্রে যদি কোনো ভুয়া ডিবির পোশাকের কোড স্ক্যান করা হয় তাহলে ‘ইনভ্যালিড কিউআর কোড’ নামে একটি বার্তা দেখা যাবে।

আরও পড়ুন>> ডিবির পোশাক পরে অপরাধ, প্রযুক্তিতে খোঁজা হচ্ছে সমাধান

নতুন এই জ্যাকেটেও মিলছে না সমাধান। প্রতারকরা পুরোনো জ্যাকেট পরেই চালাচ্ছেন প্রতারণা। কিউআর কোড প্রযুক্তিসম্পন্ন জ্যাকেট দেওয়ার পরেও বেশকিছু অভিযানে ভুয়া ডিবি গ্রেফতার করেছে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী।

ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশ বলছে, তাদের পুরোনো জ্যাকেট বাতিল করে প্রায় পাঁচ মাস আগে কিউআর কোড সম্বলিত নতুন প্রযুক্তির জ্যাকেট দেওয়া হয়েছে। তবে প্রতারকরা আগের জ্যাকেটেই তাদের প্রতারণা চালিয়ে যাচ্ছে। এক্ষেত্রে সাধারণ মানুষকে সতর্ক থাকতে হবে। ডিবি বলে পরিচয় দিলেই ডিবির লোক ভেবে কোনো গাড়িতে কিংবা নির্জন স্থানে যাওয়া যাবে না।

ডিবির জ্যাকেটে ‘কিউআর কোড’, তবু থামছে না প্রতারকরা

অনুসন্ধানে জানা যায়, বুথ বা ব্যাংকের সামনে, যেখানে মোটা অঙ্কের লেনদেন হয় সেখানে প্রতারকদের সোর্স থাকে। আবার গার্মেন্টসে বেতন দেওয়ার সময় গাড়িতে করে টাকা আনা হয়। সেখানেও অপরাধীরা সোর্সের মাধ্যমে নজরদারি করে ডাকাতির চেষ্টা করে। দীর্ঘদিন ধরে এমন ঘটনা অহরহ ঘটছে। এসব ঘটনায় কখনো আসামি ধরা পড়লেও কিছু কিছু ক্ষেত্রে ধরা পড়ে না। কেউ কেউ আবার এসব অপরাধে কারাগার থেকে বেরিয়ে ফের একই অপরাধে জড়িয়ে পড়ছে।

আরও পড়ুন>> জ্যাকেট স্ক্যান করে যেভাবে চিনবেন আসল-নকল ডিবি

গোয়েন্দা সূত্র বলছে, রাজধানীসহ সারাদেশে অনেকগুলো চক্র ডিবি পুলিশ সেজে প্রতারণা করছে। অনেক সময় তারা গাড়িতে ডিবি পুলিশ লিখে জোরপূর্বক ও ভয়ভীতি দেখিয়ে গাড়িতে তুলে টার্গেট ব্যক্তিদের কাছ থেকে লুটে নিচ্ছে সবকিছু। এদের মধ্যে কয়েকজন বিভিন্ন অপরাধে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর চাকরিচ্যুত সদস্য।

গত বছরের ১৩ ডিসেম্বর রাতে এক ভুক্তভোগী রিকশায় করে মতিঝিল সিটি সেন্টার পার হয়ে অলিম্পিয়া বেকারির দিকে যাচ্ছিলেন। এসময় একটি কালো রঙের নোয়াহ গাড়ি তার গতিরোধ করে। এরপর ডিবি পুলিশ পরিচয় দিয়ে তার কাছে অবৈধ মালামাল আছে বলে দুই হাতে হ্যান্ডকাফ পরিয়ে তাকে গাড়িতে তোলা হয়। সঙ্গে থাকা চার লাখ ৮৫ হাজার টাকা মূল্যের বিদেশি মুদ্রা ও মোবাইল ছিনিয়ে নেয় তারা। পরে ওই ব্যক্তিকে রাজধানীর শাপলা চত্বর, ধোলাইপাড় টোলপ্লাজা, ধলেশ্বরী টোলপ্লাজা কুচিয়ামারা ব্রিজ ঘুরিয়ে ঢাকা-মাওয়া সড়কে পিডিএল ক্যাম্পের সামনে নামিয়ে দিয়ে মাওয়ার দিকে চলে যায় মাইক্রোবাসটি।

আরও পড়ুন>> ডিবি পরিচয়ে চেকপোস্ট বসিয়ে ডাকাতি করতেন তারা

মামলার পর ১ জানুয়ারি রাজধানীর ঢাকেশ্বরী মন্দির এলাকা থেকে ভুয়া ডিবি চক্রের পাঁচ সদস্যকে গ্রেফতার করে গোয়েন্দা গুলশান বিভাগ। এসময় গ্রেফতারদের কাছ থেকে দুটি কালো রঙের নোয়াহ মাইক্রোবাস, একটি সাদা রঙের প্রভোক্স প্রাইভেটকার, দুটি পুলিশের রিফ্লেক্টিং ভেস্ট ও একটি হ্যান্ডকাফ জব্দ করা হয়।

ডিবির জ্যাকেটে ‘কিউআর কোড’, তবু থামছে না প্রতারকরা

তিন-চার বছর ধরে ঢাকা, নারায়ণগঞ্জ, কুমিল্লা, মাওয়া মহাসড়কসহ বিভিন্ন মহাসড়কে র‌্যাব-ডিবির ভুয়া জ্যাকেট পরে বাসের গতিরোধ করে ডাকাতি করতো কাউসার বাহিনী। যাত্রীবাহী বাস ছাড়াও গরু ও মালবাহী ট্রাক এবং বিভিন্ন মালামালের গুদামেও ডাকাতি করতো একটি চক্র। চক্রের চারজনকে গ্রেফতারের পর এ তথ্য বেরিয়ে আসে।

আরও পড়ুন>> ডিবি পরিচয়ে ডাকাতির প্রস্তুতি, গ্রেফতার ৩

রাসেল মোল্লা। পেশায় একজন গাড়িচালক। এই পেশার আড়ালে ডাকাতদলের গোয়েন্দা হিসেবে কাজ করতেন। রাসেল ডাকাত সরদার সবুজের আদেশ অনুযায়ী বিভিন্ন ব্যাংক ও জনবহুল এলাকায় অবস্থান করে ব্যাংক থেকে মোটা অঙ্কের টাকা উত্তোলনকারী ব্যক্তিদের শনাক্ত করে অনুসরণ করেন। পরে ভিকটিমের বর্ণনা ও অবস্থান সম্পর্কে তাদের সমন্বয়ক মিন্টুকে জানান। এরপর মিন্টু ও রাসেলের দেওয়া তথ্যে ভিকটিমের কাছে উপস্থিত হয়ে নিজেদের ডিবি পুলিশ পরিচয় দিয়ে মাইক্রোবাসে উঠিয়ে নিয়ে সর্বস্ব লুটে নিতো চক্রটি।

এভাবে বিভিন্ন ছদ্মবেশে, বিভিন্ন কৌশলে একের পর এক অপরাধ করে চলেছে কিছু চক্র। পদক্ষেপ নিয়েও কোনোভাবে থামাতে পারছে না আইনশৃঙ্খলা বাহিনী।

জ্যাকেট স্ক্যান করে যেভাবে চিনবেন আসল-নকল ডিবি

ডিবির জ্যাকেটের সামনে রয়েছে দুটি লোগো। বুকের বাম পাশে ঢাকা মহানগর (ডিএমপি) পুলিশের লোগো ও ডান পাশে ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা (ডিবি) পুলিশের লোগো। দুটি লোগোই রঙিন। এর নিচে কালো বর্ডারে সাদা হরফে ইংরেজিতে লেখা ‘DETECTIVE BRANCH’। এছাড়া ডান পাশে পকেটের নিচে রয়েছে সাদা রঙের কুইক রেসপন্স কোড বা কিউআর কোড। জ্যাকেটের পেছনে উপরের অংশে রয়েছে ডিবির লোগো আর নিচে কালো বর্ডারে সাদা হরফে লেখা ‘DETECTIVE BRANCH’।

যে কেউ মোবাইলে স্ক্যান করে আসল বা নকল ডিবির জ্যাকেট শনাক্ত করতে পারবেন। ডিবির জ্যাকেট পরা ব্যক্তিটি আদৌ ডিবি সদস্য কি না, নাকি ভুয়া সদস্য সেটিও স্ক্যানিংয়ের মাধ্যমে ভুক্তভোগীরা তাৎক্ষণিক জানতে পারবেন।

আরও পড়ুন>> ডিবির পোশাক পরে অপরাধ, প্রযুক্তিতে খোঁজা হচ্ছে সমাধান

ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশের (ডিবি) অতিরিক্ত কমিশনার মোহাম্মদ হারুন অর রশীদ জাগো নিউজকে বলেন, গত বছরের ১ আগস্ট ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা (ডিবি) পুলিশের জ্যাকেটে যুক্ত হয় অত্যাধুনিক প্রযুক্তিসম্পন্ন ‘কুইক রেসপন্স কোড’ বা ‘কিউআর কোড’। এ জ্যাকেটের কিউআর কোডে কর্মকর্তাদের তথ্য আগে থেকেই জমা থাকে ডিবির নিজস্ব সার্ভারে। মোবাইল অ্যাপ দিয়ে সদস্যের কিউআর কোড স্ক্যান করলেই তাদের পরিচয় দেখা যায়। কিন্তু একশ্রেণির অসাধু চক্র ডিবির পুরোনো জ্যাকেট পরেই প্রতারণা কিংবা অপহরণের মতো ঘটনা ঘটাচ্ছে, যা আমাদের দুশ্চিন্তায় ফেলে দিয়েছে।

ডিবির জ্যাকেটে ‘কিউআর কোড’, তবু থামছে না প্রতারকরা

সাধারণ মানুষকে সচেতন হওয়ার পরামর্শ দিয়ে হারুন অর রশীদ বলেন, কেউ যদি ডিবি পরিচয়ে ছিনতাই-অপহরণ করতে যায় তাহলে জাতীয় জরুরি সেবা ৯৯৯-এ ফোন করে আমাদের খবর দিলে পুলিশ তাৎক্ষণিকভাবে ঘটনাস্থলে পৌঁছে আসামিদের গ্রেফতার ও ভুক্তভোগীকে উদ্ধার করবে।

তিনি বলেন, ডিবি পরিচয়ে তুলে নেওয়ার ঘটনা এখন একটি আতঙ্ক। এভাবে কাউকে অপহরণ করা হয়। আবার কারও কাছ থেকে ছিনিয়ে নেওয়া হয় সব। কখনো কখনো ভুক্তভোগীদের খোঁজ মেলে, কখনো মেলে না। এসব ভুয়া ডিবি পুলিশের বিষয়ে সতর্ক থাকতে হবে।

ডিবি পরিচয় দিয়ে কাউকে গাড়িতে উঠতে বললেই তা করতে বারণ করেছেন হারুন অর রশীদ।

ডিবি পুলিশ সব সময় বা সব জায়গায় চেকপোস্ট বসায় না উল্লেখ করে ডিবি প্রধান বলেন, পুলিশ/ডিবি পরিচয়ে কেউ সবকিছু নিতে চাইলে ভেরিফাই করুন, আশপাশে পোশাকে অন ডিউটিতে থাকা অন্য পুলিশ সদস্যদের মাধ্যমে পরিচয় নিশ্চিত হোন। ভুয়া ডিবি পুলিশের অপতৎপরতা রোধে সবারই সচেতন হওয়া দরকার। গার্মেন্টস ব্যবসায়ী কিংবা যে কেউ যদি মোটা অঙ্কের টাকা লেনদেন করেন তাহলে পুলিশকে জানান, পুলিশের সহযোগিতা নিয়ে মানিস্কট সেবা নিন। মোটা অঙ্কের টাকার লেনদেনে গলিপথ এড়িয়ে চলুন, যেখানে সিসি ক্যামেরা আছে সেখানে বসে লেনদেন করুন।

টিটি/এএসএ/জেআইএম

পাঠকপ্রিয় অনলাইন নিউজ পোর্টাল জাগোনিউজ২৪.কমে লিখতে পারেন আপনিও। লেখার বিষয় ফিচার, ভ্রমণ, লাইফস্টাইল, ক্যারিয়ার, তথ্যপ্রযুক্তি, কৃষি ও প্রকৃতি। আজই আপনার লেখাটি পাঠিয়ে দিন [email protected] ঠিকানায়।