‘ধর্মভিত্তিক দলকে সুযোগ দেওয়া সরকারের জন্য আত্মঘাতী হবে’

সায়েম সাবু
সায়েম সাবু সায়েম সাবু , জ্যেষ্ঠ প্রতিবেদক
প্রকাশিত: ০৯:১১ পিএম, ০৭ জানুয়ারি ২০২৩

শাহরিয়ার কবির। লেখক, সাংবাদিক, প্রামাণ্যচিত্র নির্মাতা। মানবাধিকার, সাম্যবাদ, মৌলবাদ, ইতিহাস এবং বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ কেন্দ্র করে ৭০টিরও বেশি বই লিখেছেন। ১৯৯৫ সালে তিনি বাংলা একাডেমি সাহিত্য পুরস্কার লাভ করেন। ঘাতক-দালাল নির্মূল কমিটির সভাপতির দায়িত্বও পালন করছেন।

সম্প্রতি রংপুর সিটি করপোরেশন নির্বাচনে ইসলামী শাসনতন্ত্রের প্রার্থীর প্রাপ্ত ভোট প্রসঙ্গে মুখোমুখি হন জাগো নিউজের। আলোচনা করেন ধর্মভিত্তিক রাজনীতির নানা দিক নিয়েও।

সাক্ষাৎকার নিয়েছেন সায়েম সাবু

জাগো নিউজ: রংপুর সিটি করপোরেশন নির্বাচনে ইসলামী আন্দোলনের প্রার্থী ৪৯ হাজার ৮৯২ ভোট পেল এবারে। আপনি ধর্মভিত্তিক রাজনীতির বিরোধিতা করে আসছেন সব সময়। ইসলামিক দলটির এই ফলাফল বাংলাদেশের রাজনীতির জন্য বিশেষ বার্তা দিচ্ছে কি না?

শাহরিয়ার কবির: রংপুর সিটি করপোরেশন নির্বাচনে বিএনপি ও জামায়াত অংশ নেয়নি। ইসলামী শাসনতন্ত্রের প্রার্থী যে ভোট পেয়েছেন তাতে জামায়াত-বিএনপির ভোটও আছে।

বিএনপিকে বাদ দিয়ে ধর্মভিত্তিক দলগুলোর ভোট কখনই ৪ শতাংশের বেশি নয়।

জাগো নিউজ: ১৯৯১ এবং ২০০১ সালে জামায়াতের প্রাপ্ত ভোট ১০ শতাংশের কাছে ছিল।

শাহরিয়ার কবির: ২০০১ সালে জামায়াত বিএনপির সঙ্গে জোটবদ্ধ হয়ে নির্বাচনে অংশ নিয়েছিল। জামায়াতের প্রার্থীরা বিএনপির ভোটও পেয়েছেন। জামায়াতের যারা নির্বাচিত হয়েছেন, সেখানে বিএনপি বা সমমনা দলের বড় একটি ভূমিকা আছে। জামায়াত ভোটের মাঠে কখনই ভালো করতে পারেনি এবং এটি পাকিস্তান আমল থেকেই হয়ে আসছে।

চরমোনাই পীরের স্বাধীনতাবিরোধী অবস্থান আছে। মুক্তিযুদ্ধের বিরুদ্ধে তার ভূমিকা প্রমাণিত। এই বিরোধিতা একটি আদর্শের ভিত্তিতে। বিএনপি-জামায়াতের প্রার্থী না থাকলে ভোট তো ইসলামী শাসনতন্ত্রের প্রার্থীকেই দিতে হবে। এখানে ওই প্রার্থী বা দলের কোনো কারিশমা আছে বলে মনে করি না।

ধর্মভিত্তিক দল বা মৌলবাদের বিস্তার ঘটছে কখনো বিএনপির মদতে আবার কখনো আওয়ামী লীগের মদতে। কিন্তু বিস্তার ঘটছে বলেই সাধারণ মানুষ নির্বাচনে তাদের ভোট দেবে তা মনে করার কোনো কারণ নেই।

বাংলাদেশের মানুষ ধর্ম মানে। কিন্তু ধর্মের নামে রাজনীতি পছন্দ করতে চায় না। এটি পাকিস্তান আমলেও করেনি, এখনো করছে না। ইসলামিক দলগুলোর অর্থ থাকতে পারে, সন্ত্রাস করার শক্তি থাকতে পারে কিন্তু ভোটের ফলাফলে তারা জনমানুষ থেকে বিচ্ছিন্ন।

জাগো নিউজ: জামায়াতের সঙ্গে ইসলামী শাসনতন্ত্রের আকিদা বা বিশ্বাসগত দ্বন্দ্ব আছে। রংপুর নির্বাচনের ফলাফলের পর ইসলামী শাসনতন্ত্রের প্রার্থীও বলেছেন জামায়াত-বিএনপি তাকে ভোট দেয়নি।

শাহরিয়ার কবির: এই দ্বন্দ্ব হচ্ছে মানুষকে ধোঁকা দেওয়ার। দেখতে হবে তারা বাংলাদেশে শরিয়া আইন কায়েম করতে চায় কি না? ইসলামি রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করতে চায় কি না?

কীভাবে তারা শরিয়া আইন বাস্তবায়ন করবে তা নিয়ে বিতর্ক থাকতে পারে। কথা হচ্ছে, তারা সবাই শরিয়া আইন চায়।

আফগানিস্তানে তালেবানদের সঙ্গে পাকিস্তানের জামায়াতের দ্বন্দ্ব পুরোনো। কিন্তু তালেবানরা ক্ষমতায় এলে পাকিস্তান-বাংলাদেশে জামায়াত-তালেবানদের নিয়ে উল্লাস প্রকাশ করে। সব রসুনের গোড়া এক জায়গায়, এটি বুঝতে হবে।

জাগো নিউজ: কিন্তু প্রচলিত একটি ধারণা আছে, ইসলামী শাসতন্ত্রের মতো দল আওয়ামী লীগের সঙ্গে জোট করতে পারে, কিন্তু জামায়াতের সঙ্গে জোট করবে না।

শাহরিয়ার কবির: এটি একটি প্রতারণামূলক ধারণা এবং আপনারা প্রতারিত হচ্ছেন। জামায়াত কখনো কখনো বলছে চরমোনাইয়ের সঙ্গে তাদের কোনো সম্পর্ক নেই, কখনো বলছে হেফাজতের সঙ্গে তাদের কোনো সম্পর্ক নেই। পাকিস্তান আমলেও জামায়াত বলেছিল নেজাম-ই-ইসলামির সঙ্গে কোনো সম্পর্ক নেই। ১৯৭০ সালে এই দুটি দল আলাদা করে নির্বাচনে অংশ নেয়। কিন্তু মুক্তিযুদ্ধের সময় দুটি দলই এক হয়ে পাকিস্তানের পক্ষ নিলো এবং স্বাধীনতার বিরোধিতা করলো। এমন পরিস্থিতি দাঁড়ালে চরমোনাই, হেফাজত, জামায়াতের মধ্যে কোনো ভেদাভেদ থাকবে না। সব এক হয়ে যাবে।

জাগো নিউজ: তার মানে ইসলামি দলগুলোর মধ্যে ঐক্যবদ্ধ হওয়ার সম্ভাবনা আছে বলছেন?

শাহরিয়ার কবির: তারা তো ঐক্যবদ্ধই আছে। যে বিভক্তি আছে, তা লোক দেখানো। জামায়াত থেকে বেরিয়ে গিয়ে নতুন করে নিবন্ধন চাইছে দুটি দল। নির্বাচন কমিশন, সরকারের লোকেরা বলছে শর্ত পূরণ করলে আপত্তি নেই। এখানে শর্তের কী আছে? এটি তো জামায়াতের আরেক নাম। জামায়াত যতই নাম বদলাক, মূলে এক।

সরকার মনে করে হেফাজত আর জামায়াত পরস্পরবিরোধী। আমাদের তিনটি শ্বেতপত্র আছে। সেখানে কোনো বিরোধিতা পাবেন না। তাদের লক্ষ্য, উদ্দেশ্য এক। হেফাজতের ১৩ দফা মূলত জামায়াতেরই দাবি।

হেফাজত কাদিয়ানিদের কাফের ঘোষণার দাবি করছে। জামায়াত, চরমোনাইও তাই দাবি করে আসছে। এই প্রশ্নে তারা এক। শাহরিয়ার কবিরকে জবাই করতে হবে, এই প্রশ্নে তারা একাট্টা। বাইরে তারা যতই দ্বিমত পোষণ করুক।

জাগো নিউজ: ইসলামী শাসনতন্ত্রের এক অনুষ্ঠানে যোগ দিয়ে সরকারের এক মন্ত্রী মুসলিম বিশ্বের এক হওয়ার গুরুত্ব তুলে ধরেন। যেখানে শরিয়া আইনও গুরুত্ব পায়।

শাহরিয়ার কবির: সরকার এদের নানাভাবে প্রশ্রয় দিচ্ছে। সরকার মনে করে চরমোনাই জামায়াতবিরোধী। জামায়াতকে ঠেকাতে হলে এদের সুযোগ দেওয়া দরকার বলে সরকার মনে করে। আমরা তা মনে করি না।

জাগো নিউজ: এই সুযোগ দেওয়ার ফল কী হতে পারে?

শাহরিয়ার কবির: এর ফল খুবই খারাপ। ধর্মভিত্তিক দলকে সুযোগ দেওয়া সরকারের জন্য আত্মঘাতী হবে। এরা সবাই পাকিস্তানের আইএসআইয়ের নির্দেশে চলে। পাকিস্তানের আইএসআইয়ের একমাত্র লক্ষ্য হচ্ছে ১৯৭১ সালে পরাজয়ের প্রতিশোধ নেওয়া এবং বাংলাদেশকে দ্বিতীয় পাকিস্তান বানানো।

জাগো নিউজ: তার মানে আপনি শঙ্কিত?

শাহরিয়ার কবির: শঙ্কা তো অবশ্যই আছে। আমরা তথ্য দিয়ে শঙ্কা প্রকাশ করছি।

জাগো নিউজ: সরকার এটি বুঝতে পারে?

শাহরিয়ার কবির: আমি তো সব সময় বলে আসছি, আওয়ামী লীগের প্রশ্রয় না পেলে হেফাজত আজকের অবস্থানে আসতে পারতো না।

জাগো নিউজ: নির্বাচন ঘনিয়ে আসছে। সামনে হেফাজত আরও গুরুত্ব পেতে পারে কি না?

শাহরিয়ার কবির: সময় বলে দেবে।

জাগো নিউজ: পুলিশের ওপর জামায়াত-শিবিরের ফের হামলা। কী দেখছেন সামনে?

শাহরিয়ার কবির: জামায়াত আছেই। বিভিন্নভাবে আছে। তারা সুযোগের সন্ধানে থাকে। সামনে আরও ভয়ঙ্কর হয়ে উঠতে পারে।

জাগো নিউজ: জামায়াতকে নিষিদ্ধের দাবি করে আসছেন বহু আগে থেকে। সরকার করছে না। এখন কী বলবেন?

শাহরিয়ার কবির: জামায়াতকে নিষিদ্ধ করছে না বিভিন্ন কারণে। সরকার মনে করে নিষিদ্ধ করলে চ্যালেঞ্জ আরও বাড়বে। বাইরের চাপ আছে নিষিদ্ধ না করার। মধ্যপ্রাচ্যের চাপ আছে। যুক্তরাষ্ট্র মনে করে জামায়াত একটি মডারেট ইসলামিক দল। তাদের নিষিদ্ধ করা ঠিক হবে না। বহুবার দেশটির স্টেট ডিপার্টমেন্টের সঙ্গে কথা হয়েছে আমার।

জাগো নিউজ: পশ্চিমারা তো জামায়াত-শিবিরের রাজনীতিবিরোধী অবস্থানে আছে বলে মনে করা হয়?

শাহরিয়ার কবির: ব্যক্তি বা বিশেষজ্ঞ পর্যায়ে এমন বিরোধিতা আছে। পশ্চিমা রাষ্ট্রের সরকারগুলোর মধ্যে কোনো বিরোধিতা নেই। আমরা বহুবার আমেরিকাকে জামায়াত-শিবির সম্পর্কে ধারণা দিয়েছি। তারা আমাদের কথা শোনেনি। ব্রিটিশ সরকারের সমর্থন নিয়ে জামায়াতের প্রতিষ্ঠা করেছিলেন আবুল আলা মওদুদী।

জাগো নিউজ: জামায়াতের এই শক্তির প্রকাশ মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের শক্তির ব্যর্থতা কি না?

শাহরিয়ার কবির: আওয়ামী লীগের দুর্বলতা তো আছেই। কিন্তু ১৯৭৫ সালে বঙ্গবন্ধু হত্যার পর জিয়াউর রহমান জামায়াতকে প্রতিষ্ঠা করেন সংবিধান সংশোধন করে। আর খালেদা জিয়া জামায়াতকে নিয়ে সরকার গঠন করেন। মূলত জামায়াত বিভিন্ন সময়ে সবারই সমর্থন পেয়েছে।

জাগো নিউজ: জামায়াতের রাজনৈতিক ভবিষ্যৎ কী দেখছেন?

শাহরিয়ার কবির: রাজনীতিতে জামায়াতের কোনো ভবিষ্যৎ নেই। জামায়াত টিকে আছে পরগাছার মতো। বিএনপি জামায়াতকে ত্যাগ করলে তারা শুকিয়ে মরবে।

আমি আগেই বলেছি বাংলাদেশের মানুষ ধর্মে বিশ্বাসী। কিন্তু ধর্মের নামে রাজনীতি, নির্বাচন পছন্দ করে না। মানুষ ওয়াজ-মাহফিলের জন্য চাঁদা দেবে। প্রচুর মানুষ আসে মাহফিলে। কিন্তু এখানকার মানুষ আর ভোটের মানুষ এক নয়।

হুসেইন মুহাম্মদ এরশাদের সময় আটরশি পিরের বাড়ন্ত রাজনীতি। এরশাদ সেখানে প্রেম দিলো। জাকের পার্টি প্রতিষ্ঠার সময় তারা বললো, বাংলাদেশে তাদের তিন কোটি অনুসারী আছে। তারা ৩শ আসনেই প্রার্থী দিলো। সব আসনেই জামানত বাজেয়াপ্ত হলো। পিরের কাছে গেলেই তাকে ভোট দেবে এমন মনে করার কোনো কারণ নেই। মানুষ এগুলো পছন্দ করে না।

জামায়াতকে ছাড়লেই বিএনপির লাভ। ২০১৮ সালের নির্বাচনের আগে বলেছিলাম বিএনপি জামায়াতকে ছেড়ে নির্বাচনে অংশ নিলে আওয়ামী লীগের ক্ষমতায় যাওয়া কঠিন ছিল। কারণ যারা আওয়ামী লীগকে পছন্দ করে না, তারা বিএনপিকে ভোট দিতে চায়। কিন্তু জামায়াতের কারণে তারা বিএনপিকে পছন্দ করে না।

এএসএস/এএসএ/জেআইএম

বাংলাদেশের মানুষ ধর্ম মানে। কিন্তু ধর্মের নামে রাজনীতি পছন্দ করতে চায় না। এটি পাকিস্তান আমলেও করেনি, এখনো করছে না। ইসলামিক দলগুলোর অর্থ থাকতে পারে, সন্ত্রাস করার শক্তি থাকতে পারে কিন্তু ভোটের ফলাফলে তারা জনমানুষ থেকে বিচ্ছিন্ন।

ধর্মভিত্তিক দলকে সুযোগ দেওয়া সরকারের জন্য আত্মঘাতী হবে। এরা সবাই পাকিস্তানের আইএসআইয়ের নির্দেশে চলে। পাকিস্তানের আইএসআইয়ের একমাত্র লক্ষ্য হচ্ছে ১৯৭১ সালে পরাজয়ের প্রতিশোধ নেওয়া এবং বাংলাদেশকে দ্বিতীয় পাকিস্তান বানানো।

রাজনীতিতে জামায়াতের কোনো ভবিষ্যৎ নেই। জামায়াত টিকে আছে পরগাছার মতো। বিএনপি জামায়াতকে ত্যাগ করলে তারা শুকিয়ে মরবে।

পাঠকপ্রিয় অনলাইন নিউজ পোর্টাল জাগোনিউজ২৪.কমে লিখতে পারেন আপনিও। লেখার বিষয় ফিচার, ভ্রমণ, লাইফস্টাইল, ক্যারিয়ার, তথ্যপ্রযুক্তি, কৃষি ও প্রকৃতি। আজই আপনার লেখাটি পাঠিয়ে দিন [email protected] ঠিকানায়।