জামালপুর
যমুনার ভাঙনে নিঃস্ব মানুষের মিছিল, সরকারি সহায়তা অপ্রতুল
যমুনা নদীর ভাঙনে ভিটে-মাটি হারাচ্ছেন জামালপুরের হাজারো মানুষ। চোখের সামনে নদী কেড়ে নিচ্ছে বসতবাড়ি, স্কুল, বাজারসহ বিভিন্ন স্থাপনা। সব হারিয়ে কেউ এলাকা ছাড়ছেন, কেউ অন্যের জমি ইজারা নিয়ে সেখানে থাকছেন অস্থায়ী ঘর তুলে। ভাঙনের শিকার এসব নিঃস্ব মানুষের সহায়তায় সরকারি সহায়তা খুবই অপ্রতুল। নদীশাসন কিংবা ভাঙন রোধে নেই তেমন কোনো সরকারি উদ্যোগ। যদিও উপজেলা প্রশাসনের দাবি, ভাঙনের শিকার পরিবারকে সরকারি ঘর ও খাসজমি বরাদ্দ দেওয়া হচ্ছে।
জামালপুরের দেওয়ানগঞ্জের চিকাজানী ইউনিয়নের নদীভাঙনের শিকার পরিবারগুলো জানায়, কিছু চাল সহায়তা ছাড়া তারা সরকারের কাছ থেকে কোনো সহায়তাই পাননি। আগামী বর্ষা মৌসুম সামনে রেখে এ ইউনিয়নসহ আশপাশের ইউনিয়নের বাসিন্দারা আতঙ্কে আছেন।
আরও পড়ুন>>ফসল চাষ-পশু পালনে ঘুরে দাঁড়াচ্ছেন নদীভাঙনে নিঃস্বরা
আর উপজেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে জানানো হয়েছে, সরকারি ঘর দিয়ে পুনর্বাসিত মানুষের মধ্যে নদীভাঙনের শিকার পরিবারও রয়েছে। এছাড়া আবেদন করলে নগদ অর্থ ও খাসজমি বরাদ্দ দিয়েও নদীভাঙনের শিকার মানুষদের সহায়তা করা হচ্ছে।
দেওয়ানগঞ্জে নদীভাঙন রোধে সরকার শিগগির কাজ শুরু করবে বলেও জানায় উপজেলা প্রশাসন।
স্থানীয়রা জানান, চিকাজানী ইউনিয়নের খোলাবাড়ি বাজার থেকে আরও দেড় থেকে দুই কিলোমিটার পর্যন্ত বসতবাড়ি ছিল। এখন ভাঙন এসে খোলাবাড়ি বাজারে এসে ঠেকেছে। চার-পাঁচবার ঘর ভেঙেছে এমন মানুষও আছেন এ ইউনিয়নে। খোলাবাড়ি হাইস্কুল ও প্রাথমিক বিদ্যালয় চলে গেছে নদীগর্ভে। এবার বর্ষায় বাজার টেকানো নিয়েও শঙ্কিত তারা।
চিকাজানী ইউনিয়নের চর মুগরীর মোসাম্মৎ আছিয়া খাতুনের ঘরবাড়ি চলে গেছে নদীতে। তিনি বলেন, ‘জমি ভাড়া নিয়ে আছি। প্রথমে পাঁচ বছরের অগ্রিম দিয়েছি। এখন প্রতি কাঠায় বছরে এক হাজার টাকা করে দিতে হয়। মোট আড়াই কাঠা জমি।’
আরও পড়ুন>>স্কুল যমুনাগর্ভে, আড়াই শতাধিক শিক্ষার্থীর পাঠদান অনিশ্চিত
‘নিজেদের আড়াই বিঘা জমি ছিল। সবই নদীতে চলে গেছে। সেটাও খোলাবাড়ির মধ্যেই ছিল, তবে পশ্চিম পাশে। ২০১৮ সালের ফেব্রুয়ারির শুরুতে ভেঙে গেছে। জমিগুলো যখন ভাঙছে তখন ফসল ছিল, পাট হয়েছিল। বাড়ির পেছনে একটা বাগান ছিল। আকাশমনি গাছ ছিল। চোখের সামনে সব নদীতে চলে গেলো।’
আছিয়া বেগম আরও বলেন, ‘বাড়িঘর ভাঙার পর প্রথমে গিয়ে বাবার বাড়িতে উঠি। মাসখানেক অনেক কষ্ট করেছি। কিন্তু ১০ কেজি করে চাল ছাড়া সরকারের কাছ থেকে আর কোনো সাহায্য-সহযোগিতা পাইনি।’
রাহেলা খাতুনের বাড়িঘর যমুনায় ছয়বার ভেঙেছে বলে দাবি করেন। তিনি বলেন, ‘ইসলামপুরে বাড়ি বানাইছি, ভাইঙা গেছে। এরপর বেলগাছি, ফুটানিবাজার, খোলাবাড়ি যত জায়গায় বাড়ি বানাইছি নদীতে ভাইঙা গেছে। ছয়বার আমরা ঘরবাড়ি নিছে নদী।’
আরও পড়ুন>>যমুনায় বাড়ছে পানি, কমছে না আতঙ্ক
তিনি বলেন, ‘এখন আমি কই জামু। আমার অনেক দুঃখ। আমার কোনো ঠিকানা নাই, কোনো বসতবাড়ি নাই। সরকারের কাছে দাবি, আমি একটা আশ্রয় চাই। একটা ঘর চাই।’
‘আমার স্বামী ২০ বছর আগে মারা গেছেন। পাঁচটা সন্তান। আমি খাইটা মানুষের কাছে চাইয়া-চিন্তে সন্তানগুলারে মানুষ করছি। পোলারা বেকার। আমি সিজনে মরিচ উঠাই, কামলা দেই, কাঁথা সেলাই করি। এমনে কইরা বাইচ্চা (বেঁচে) আছি।’
রাহেলা খাতুন আরও বলেন, ‘বেড়িবান (বেড়িবাঁধ) চাই। আর যাইন (যেন) কারও বাড়িঘর না ভাঙে। মানুষ যাতে বসবাস করতে পারে।’
লুৎফর রহমান বলেন, ‘আমার বাড়ি ছিল খোলাবাড়ি পূর্ব পাড়ায়। ২০১৮ সালে বাড়ি-ঘর জমি-জিরাত সব যমুনায় নিছে। এখন চর মুগরীতে জমি ভাড়া নিয়ে ঘর কইরা থাহি (থাকি)। ১০ কেজি কইরা চাইল (চাল) ছাড়া আর কোনো সাহায্য পাই নাই।’
তিনি বলেন, ‘এ চর মুগরীর ৮০ শতাংশ মানুষ পরের জমিনে কট-বন্ধক নিয়ে থাকে। নদী ভাইঙা খালি পুব দিকে সইরাই আসতাছে। অনেকে গ্রামও ছাইড়া চইল্যা গেছে। বর্ষাকালে তো কষ্টের শ্যাষ থাহে না। এ ঘরবাড়িও পানিতে ডুইব্যা (ডুবে) যায়, রাস্তায় ছাপরা উডাইয়া থাহন (থাকা) লাগে।’
আরও পড়ুন>>২০৫০ সালের মধ্যে দেশের ১৭ শতাংশ এলাকা তলিয়ে যাবে
খোলাবাড়ি গ্রামে বাড়িঘর ছিল ছালমা বেগমের। ২০২০ সালে যমুনার ভাঙনে সব হারিয়ে নিঃস্ব হয়ে যান তিনি। ছালমা বেগমের স্বামী দিনমজুর। তার দুই মেয়ে, বড় মেয়ের বয়স ১৩ বছর, ছোট মেয়ে ৭ বছরের। তিনি বলেন, ‘আমরা সরকারের কোনো সাহায্য-সহযোগিতা পাই না। এখন ভাড়া জমিতে ঘর করে থাকি।’
খোলাবাড়ির চর মুগরীর নার্গিস বেগম বলেন, ‘খোলাবাড়ির পশ্চিম পাশে আমাদের বাড়ি ছিল, ২০১৮ সালে বাড়িঘর নদীতে ভাইঙা (ভেঙে) গেছে। সরকারি সাহায্য-সহযোগিতা পাই না আমরা। মাইনসের (মানুষের) ক্ষ্যাতে ঘর বানাইয়া থাকি। বছরে দুই হাজার টাকা দেওন (দেওয়া) লাগে।’
খোলাবাড়ির বাসিন্দা আব্দুল গণি বলেন, ‘খোলাবাড়ির খুদু পাগলার বাড়ির দিকে কমপক্ষে ৫শ বাড়ি ছিল, যেগুলো সব যমুনার প্যাটে চইল্যা গ্যাছে।’
চিকাজানী ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান মো. আশরাফুল ইসলাম আক্কাস জাগো নিউজকে বলেন, ‘এখন আমাদের এখানে মানুষের খাবারের অভাব নেই। এখন আমাদের মূল সমস্যা হচ্ছে নদীভাঙন। চিকাজানী ইউনিয়নের চারটি গুচ্ছগ্রাম ভেঙে গেছে। এতে অনেক ক্ষতি হয়েছে। পাঁচ কিলোমিটারের মতো জায়গা-জমি নদীগর্ভে চলে গেছে। আনুমানিক এক হাজারের মতো পরিবার নদীভাঙনে বসতভিটা হারিয়েছে। আমরা প্রতি বছরই ভাঙনের কবলে পড়ি।’
তিনি বলেন, ‘সরকারের কাছ থেকে যে ধরনের সাহায্য-সহযোগিতা আসে, সেটা আমরা দেই। উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তার কার্যালয় নদীভাঙনে ঘরবাড়ি হারানো ব্যক্তিদের তালিকা করেছে। তারা বসতবাড়ি হারানোদের সরকারি ঘর দেবেন বলে আমরা আশা করি।’
দেওয়ানগঞ্জের উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) কামরুন্নাহার শেফা জাগো নিউজকে বলেন, ‘নদীভাঙনে যারা ঘরবাড়ি হারাচ্ছে তাদের কাউকে কাউকে আমরা ঘর দিচ্ছি। মুজিববর্ষে আমরা মোট তিনশ গৃহহীন মানুষকে ঘর দিয়েছি। এর মধ্যে অনেকেই নদীভাঙনের শিকার। এ কার্যক্রম চলমান। এখনো ভূমিহীন ও গৃহহীনদের জন্য ঘর তৈরি হচ্ছে।’
তিনি বলেন, ‘যাদের ঘরের জমি নদীতে চলে গেছে, কিন্তু ঘরটা নিয়ে অন্য কোথাও আশ্রয় নিয়ে, তারা যখন আমাদের কাছে আবেদন করে আমরা তাদের খাসজমি বন্দোবস্ত দিচ্ছি। নগদ অর্থ দিচ্ছি। তবে কেউ কেউ আমাদের জানাশোনার বাইরে থাকতে পারে।’
ভূমিহীন ও গৃহহীন মানুষের হালনাগাদ তালিকায় ৩৪০ জনের নাম রয়েছে জানিয়ে ইউএনও বলেন, ‘তাদের সবাইকে আমরা পুনর্বাসন করবো। আরও অনেকের আবেদন যাচাই-বাছাই করা হচ্ছে।’
কামরুন্নাহার শেফা বলেন, ‘দেওয়ানগঞ্জ একটি নদীভাঙনপ্রবণ এলাকা। নদীভাঙন রোধে কাজ করে পানি উন্নয়ন বোর্ড। আমরা সব সময় তাদের সঙ্গে কথা বলি। যখনই যে জায়গাটা রিস্ক হয় আমরা তাদের রিপোর্ট করি। সেটা অব্যাহত আছে।’
‘আমরা আশা করছি, নদীভাঙনের ঝুঁকিপূর্ণ জায়গাগুলোতে শিগগির কাজ শুরু হবে। বিষয়টি প্রক্রিয়াধীন। নদীশাসন ও ভাঙন রোধে আরও ভালো কাজ করার চেষ্টা আমাদের রয়েছে। সেই যোগাযোগটা আমরা করছি’ বলেন ইউএনও।
আরএমএম/এএসএ/জিকেএস