নীরব ঘাতক তামাক
তামাক থেকে মুক্তিতে ‘বাধা’ আইন
বিভিন্নভাবে সচেতনতামূলক কার্যক্রম চালিয়েও দেশে কমছে না তামাকের ব্যবহার। উল্টো তরুণদের মধ্যে সিগারেটের পাশাপাশি বাড়ছে ই-সিগারেটে আসক্তি। ধূমপান প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে প্রতিবছর কেড়ে নিচ্ছে দেড় লক্ষাধিক প্রাণ। তামাক চাষ গ্রাস করছে বনভূমি। চাষের ফলে উর্বরতা হারাচ্ছে জমি। দূষিত হচ্ছে পরিবেশ। এ অবস্থা থেকে উত্তরণে আইন সংশোধন করে তার কঠোর প্রয়োগে মুক্তি খুঁজছে সরকার ও তামাকবিরোধী সংগঠনগুলো।
জানা যায়, ২০০৫ সালে ধূমপান ও তামাকজাত দ্রব্য ব্যবহার (নিয়ন্ত্রণ) আইন প্রণয়ন এবং ২০১৩ সালে আইনে সংশোধনী আনা হয়। তারপরও নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব হয়নি। আইনের সঠিক প্রয়োগ না হওয়াও অন্যতম কারণ। ফলে প্রাণ ও পরিবেশ রক্ষায় নতুন করে আইন সংশোধন করে তা বাস্তবায়ন জরুরি বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা।
আরও পড়ুন>> রাজস্ব থেকে আয়ের চেয়ে বেশি তামাকজনিত স্বাস্থ্যব্যয়
বছরে ঝরছে দেড় লক্ষাধিক প্রাণ
ধোঁয়া ও ধোঁয়াবিহীন তামাকজাত পণ্য গ্রহণের ফলে হৃদরোগ, ক্যানসার, ফুসফুসে সংক্রমণসহ নানা ধরনের রোগে আক্রান্ত হচ্ছে মানুষ। টোব্যাকো অ্যাটলাস ২০১৮-এর প্রতিবেদন বলছে, বাংলাদেশে তামাকজনিত কারণে বিভিন্ন ব্যাধিতে আক্রান্ত হয়ে বছর প্রায় ১ লাখ ৬২ হাজার মানুষের মৃত্যু হয়। আর বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার তথ্যমতে, তামাক ব্যবহারকারীদের মধ্যে অর্ধেকই এর প্রভাবে অসংক্রামক রোগে মারা যান। বিশ্বে প্রতি বছর মারা যান ৮০ লাখের বেশি মানুষ।
ন্যাশনাল হার্ট ফাউন্ডেশন হাসপাতাল অ্যান্ড রিসার্চ ইনস্টিটিউটের রোগতত্ত্ব ও গবেষণা বিভাগের প্রধান অধ্যাপক সোহেল রেজা চৌধুরী জাগো নিউজকে বলেন, হৃদরোগ, স্ট্রোক, ক্যানসার, ফুসফুসে সংক্রমণসহ তামাকজনিত নানা রোগে বাংলাদেশে বছরে এক লাখ ৬১ হাজারের বেশি মানুষ মারা যান। এছাড়া তামাকের কারণে অসংক্রামকজাতীয় অনেক রোগে আক্রান্ত হচ্ছে মানুষ। বিশেষ করে তরুণদের মধ্যে হার্ট অ্যাটাকের সংখ্যা বেড়ে যাওয়ার মূল কারণ ধূমপান ও তামাকজাত দ্রব্য সেবন।
৩১ শতাংশ বন নিধনে দায়ী তামাক চাষ
তামাক উৎপাদনেও পরিবেশগত নানা নেতিবাচক প্রভাব দেখা যায়। বাংলাদেশের মতো মধ্যম আয়ের দেশে তামাক কোম্পানিগুলো তাদের ব্যবসার বড় বাজার হিসেবে নিয়েছে। ফলে এসব দেশে তামাক উৎপাদনেও তামাক কোম্পানিগুলোর নজর থাকে।
মাদকদ্রব্য ও নেশা নিরোধ সংস্থা মানস-এর তথ্যমতে, দেশে ৩১ শতাংশ বন নিধনের ক্ষেত্রে তামাক চাষ দায়ী। আর বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার তথ্যমতে, ১৯৭০ সাল থেকে তামাকের কারণে বিশ্বব্যাপী (গ্রীষ্মমণ্ডলীয় অঞ্চলে) আনুমানিক দেড় বিলিয়ন হেক্টর বন বিলুপ্ত হয়েছে, যা ২০ শতাংশ বার্ষিক গ্রিনহাউজ গ্যাস বৃদ্ধির কারণ হিসেবে চিহ্নিত।
এছাড়া বিশ্বে বছরে ৩৫ লাখ হেক্টর জমি তামাক চাষে ধ্বংস হয়, যা বৈশ্বিক পাঁচ শতাংশ বনাঞ্চল ধ্বংসের জন্য দায়ী। তামাক পাতা প্রক্রিয়াজাত করতে চুল্লিতে প্রচুর পরিমাণে কাঠ পোড়ানো হয়। তিনশ সিগারেটের শলাকা তৈরি করতে প্রায় একটি সম্পূর্ণ গাছ প্রয়োজন হয়। একটি শলাকা তৈরি করতে কার্বন-ডাই-অক্সাইড তৈরি হয় ১৪ গ্রাম। তামাক উৎপাদনে বছরে প্রায় ৮৪ মিলিয়ন মেট্রিক টন কার্বন-ডাই-অক্সাইড নির্গমন হয়, যা মহাকাশে উৎক্ষেপণ করা ২ লাখ ৮০ হাজার রকেটের সমতুল্য।
আরও পড়ুন>> ই-সিগারেট নিষিদ্ধের প্রস্তাবে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের সায়
বায়ুমণ্ডলীয় দূষণ অধ্যয়ন কেন্দ্রের চেয়ারম্যান অধ্যাপক ড. আহমদ কামরুজ্জমান মজুমদার জাগো নিউজকে বলেন, অধিক মুনাফার জন্য তামাক চাষ করেন কৃষক। তামাক চাষে উদ্বুদ্ধ করছে তামাক কোম্পানিগুলো। অথচ তামাক চাষে জমির উর্বরতা নষ্ট হয়। জমিতে পরবর্তীসময়ে অন্যান্য ফসল উৎপাদনের জন্য দীর্ঘ সময় লেগে যায়। তাই তামাক উৎপাদন বন্ধ হওয়া প্রয়োজন। এছাড়া প্রতিদিন সারাদেশে তামাকের ধোঁয়ায় যে বায়ুদূষণ হয় তা পরিবেশের ওপর নেতিবাচক প্রভাব ফেলে।
তামাক নিয়ন্ত্রণে আইন
জেনেভায় অনুষ্ঠিত বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার ফ্রেমওয়ার্ক কনভেনশন অন টোব্যাকো কন্ট্রোলের (এফসিটিসি) আর্টিকেল ৬ ধারায় তামাকের চাহিদা কমাতে প্রতি দেশের সরকারকে একটি সহজ তামাক কর ও মূল্যনীতি প্রণয়ন এবং বাস্তবায়নের কথা বলা হয়েছে। আর অনুচ্ছেদ ১৭ ও ১৮-তে তামাকের বিকল্প ফসল চাষে কৃষকদের উদ্বুদ্ধকরণ, সহায়তা, তামাক চাষের ক্ষতি থেকে পরিবেশ ও জনস্বাস্থ্য রক্ষার্থে কার্যকর উদ্যোগ গ্রহণের নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে। বাংলাদেশ চুক্তিতে স্বাক্ষরকারী প্রথম দেশ হিসেবে তা মানার বাধ্যবাধকতা রয়েছে।
বিভিন্ন জনসমাগমস্থলে হরহামেশাই ধূমপান মানুষের জীবন, প্রকৃতি, প্রতিবেশের অপূরণীয় ক্ষতি করে চলেছে। অথচ জনসমাগমস্থলে ধূমপান বন্ধে ২০০৫ সালে ধূমপান ও তামাকজাত দ্রব্য ব্যবহার (নিয়ন্ত্রণ) আইন ও ২০১৩ সালের সংশোধিত আইনে শাস্তির বিধান ছিল। ২০১৬ সালে ঢাকায় ‘টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা অর্জন’ শীর্ষক সাউথ এশিয়ান স্পিকারস সামিটের সমাপনী অনুষ্ঠানে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ২০৪০ সালের মধ্যে তামাকমুক্ত বাংলাদেশ গড়ার ঘোষণা দেন।
এর সঙ্গে তামাক নিয়ন্ত্রণ আইনকে এফসিটিসির সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ করে সংশোধন করার কথাও বলেন তিনি। ফলে ধূমপান বন্ধ নিশ্চিতে তামাকবিরোধী বিভিন্ন সংগঠন থেকে বেশকিছু প্রস্তাবও দেওয়া হয়। সেসব প্রস্তাবসহ নতুন করে ২০২২ সালে ১৮টি ধারায় বেশ কিছু সংশোধনী করে বর্তমানে সেই খসড়া আইনটি জনমত যাচাই চলছে। স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ে এটা পাস হয়ে মন্ত্রিপরিষদ তারপর সংসদে যাবে। সেখানে পাস হলেই পাওয়া যাবে নতুন তামাক নিয়ন্ত্রণ আইন।
আরও পড়ুন>> তামাক নিয়ন্ত্রণ আইন: সংশোধিত খসড়া পাস হলে সেবনকারীর সংখ্যা কমবে
নতুন সংশোধিত আইনের খসড়ায় ১৮টি ধারা রয়েছে। ধারা-৪ এ বলা হয়েছে, কোনো ব্যক্তি পাবলিক প্লেস এবং পাবলিক পরিবহনে ধূমপান ও তামাকজাত দ্রব্য ব্যবহার করতে পারবে না। এই আইন ভঙ্গ করলে এক হাজার টাকা জরিমানা করা হবে। ধারা-৫ এ বলা হয়েছে, ‘নাটক, সিনেমা, প্রামাণ্য চিত্রে তামাকজাত দ্রব্য ও ই-সিগারেট ব্যবহারের কোনো দৃশ্য টেলিভিশন, রেডিও, ইন্টারনেট, অনুষ্ঠানে, গণমাধ্যমে প্রচার, প্রদর্শন বা বর্ণনা করা যাবে না। তামাকজাত দ্রব্যের মোড়ক, প্যাকেট বা কৌটার অনুরূপ কোনো দ্রব্য বিক্রয় বা বিতরণ করা যাবে না এবং বিক্রয়স্থলে তামাকজাত দ্রব্যের মোড়ক, প্যাকেট বা কৌটা, খালি কৌটা প্রদর্শন করা যাবে না। বিক্রির সময় ব্যতীত দৃষ্টির আড়ালে রাখতে হবে। এছাড়া তামাকজাত দ্রব্যের উৎপাদনকারী ও ব্যবসায় নিয়োজিত ব্যক্তি সরাসরি বা অন্য কোনো প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে সামাজিক দায়বদ্ধতা কর্মসূচিতে অংশ নিতে পারবে না।’ এসব বিষয় না মানলে ৫ লাখ টাকা জরিমানার বিধান রাখা হয়েছে।
আরও পড়ুন>> সিগারেটের চেয়ে ক্ষতিকর ই-সিগারেট, দেশে বাড়ছে আসক্তি
নতুন সংশোধিত প্রস্তাবিত আইনের ধারা-৬ এ বলা হয়েছে, ‘কোনো ব্যক্তি ভ্রাম্যমাণ দোকান বা ফেরি করে এবং শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, হাসপাতাল, ক্লিনিক, খেলাধুলার স্থান ও শিশু পার্কের সীমানার ১০০ মিটারের মধ্যে তামাক ও তামাকজাত দ্রব্য বিক্রি করতে পারবে না, যা অমান্য করলে অনধিক পাঁচ হাজার টাকা জরিমানা এবং দ্বিতীয়বার বা তার অধিক হলে পর্যায়ক্রমিকভাবে দ্বিগুণ হারে জরিমানা করা হবে। এছাড়া ইমার্জিং টোব্যাকো প্রোডাক্ট অর্থাৎ ই-সিগারেটসহ সব ভ্যাপিং এবং হিটেড তামাকপণ্যের উৎপাদন, আমদানি, বিক্রি ও বাজারজাতকরণ করা যাবে না। এটি অমান্য করলে অনূর্ধ্ব ছয় মাসের কারাদণ্ড বা দুই লাখ টাকা অর্থদণ্ড বা উভয় দণ্ডে দণ্ডিত হবে। দ্বিতীয়বার বা তার অধিক হলে পর্যায়ক্রমিকভাবে দ্বিগুণ হারে দণ্ডিত করা হবে।
ধারা-১০ এ বলা হয়েছে, কোনো ব্যক্তি সম্পূর্ণ প্যাকেট, মোড়ক বা কৌটা ছাড়া খুচরা বা খোলা তামাকজাত দ্রব্য বিক্রি করতে পারবে না, যা ভঙ্গ করলে দোকানদারকে অনূর্ধ্ব এক মাস বিনাশ্রম কারাদণ্ড বা অনধিক পাঁচ হাজার টাকা জরিমানা বা উভয় দণ্ডে দণ্ডিত হবে। আর কোম্পানির ক্ষেত্রে অনধিক দুই লাখ টাকা জরিমানা করা হবে। দ্বিতীয়বার বা তার অধিক হলে পর্যায়ক্রমিকভাবে দ্বিগুণ হারে দণ্ডিত করা হবে।’
বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর ও তামাক নিয়ন্ত্রণ নিয়ে কাজ করা বেসরকারি গবেষণা সংস্থা উন্নয়ন সমন্বয়-এর সভাপতি অর্থনীতিবিদ অধ্যাপক ড. আতিউর রহমান জাগো নিউজকে বলেন, তামাকবিরোধী আইনের রূপান্তরের পথে নানা প্রতিবন্ধকতা উপেক্ষা করে দ্রুততম সময়ের মধ্যে প্রস্তাবিত খসড়াটি আইন হিসেবে সংসদে পাস করিয়ে আনতে হবে। তাহলে প্রধানমন্ত্রী ২০৪০ সালের মধ্যে দেশকে তামাকমুক্ত করার যে ঘোষণা দিয়েছেন তা বাস্তবায়ন করা সম্ভব হবে।
তামাক নিয়ন্ত্রণ আইন বিষয়ে সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগের সিনিয়র আইনজীবী অ্যাডভোকেট মনজিল মোরসেদ জাগো নিউজকে বলেন, বিশ্বব্যাপী এখন তামাক নিয়ন্ত্রণের জন্য গুরুত্ব দেওয়া হচ্ছে। আমাদের দেশে যে আইনটা রয়েছে সেটা কার্যকর করা হয়নি। আইন করলেই হবে না, আইনটা শক্তিশালী হওয়া দরকার। এদিক দিয়ে ভালো একটি শক্তিশালী আইন হচ্ছে। শক্তিশালী হওয়ার পর আইনটা কার্যকর করতে হবে। তামাকের যে বিস্তার সেটি বন্ধ করতে হবে। নতুন আইনটি করার মাধ্যমে বাস্তবায়ন করতে পারলে তামাক নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব হবে।
জাতীয় তামাক নিয়ন্ত্রণ সেলের সমন্বয়কারী ও অতিরিক্ত সচিব হোসেন আলী খোন্দকার জাগো নিউজকে বলেন, প্রধানমন্ত্রী ২০১৬ সালে ঘোষণা দিয়েছিলেন, তামাক নিয়ন্ত্রণের প্রচলিত আইনকে যুগোপযোগী করতে হবে। ২০০৫ সালে যখন আইন হয় তখনকার প্রেক্ষাপট ও এখনকার প্রেক্ষাপট ভিন্ন। এছাড়া আশপাশের দেশ অনেক শক্ত আইন করেছে। যেহেতু আমরাও এফসিটিসি স্বাক্ষর করেছি, তাই আশপাশের দেশের সঙ্গেও সামঞ্জস্য রক্ষার জন্য শক্ত আইন দরকার। সংবিধানেও জনস্বার্থ রক্ষা সরকারের দায়িত্ব বলা রয়েছে।
তিনি আরও বলেন, অসংক্রামক রোগের জন্য প্রধানত তামাক দায়ী। এজন্য এই আইনটি যাতে আরও শক্তভাবে করা হয় তার জন্য শিক্ষাবিদ, সুশীল সমাজ, সংসদ সদস্যসহ সবার পক্ষ থেকেই দাবি উঠেছে। যার পরিপ্রেক্ষিতেই অন্য দেশের সঙ্গে সামঞ্জস্য এবং প্রধানমন্ত্রীর ঘোষণার বিষয় লক্ষ্য রেখেই ২০৪০ সালের মধ্যে দেশকে তামাকমুক্ত করতে শক্তিশালী আইন করা হয়েছে। অন্য দেশে যেভাবে বাস্তবায়ন করছে আমরাও সেভাবে বাস্তবায়ন করতে পারবো।
আরএসএম/এএসএ/এমএস