বছরজুড়ে বিতর্ক-সমালোচনায় বিমান

মুসা আহমেদ
মুসা আহমেদ মুসা আহমেদ
প্রকাশিত: ০৮:২৫ পিএম, ২৬ ডিসেম্বর ২০২২

বছরজুড়ে বিতর্ক-সমালোচনায় ছিল বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইন্স। গ্রাউন্ড হ্যান্ডলিংয়ে অব্যবস্থাপনা, নিয়োগ পরীক্ষায় প্রশ্নফাঁস, সারচার্জ মওকুফে বাংলাদেশ বেসামরিক বিমান চলাচল কর্তৃপক্ষের কাছে (বেবিচক) আবেদন, বিমাননিরাপত্তা ছাড়পত্র ছাড়াই ভিভিআইপি ফ্লাইটে চার কর্মীর ডিউটি দিয়ে সমালোচনার মুখে পড়েছে সংস্থাটি।

এ ছাড়া ঢাকায় হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে হ্যাঙ্গারে ঢোকানোর সময় দুটো উড়োজাহাজের মধ্যে ধাক্কা, বোর্ডিং ব্রিজ না খুলে পার্কিংয়ে নিয়ে যাওয়ার চেষ্টা, ফ্লাইটে ওভার পাওয়ার ব্যবহার করে ইঞ্জিন বিকল, উইন্ডশিল্ডে ফাটল, উড্ডয়নের সময় ইন্ডিকেটরে ত্রুটি- এমন ঘটনাও ঘটেছে। কিন্তু এসব অব্যবস্থাপনা বা ত্রুটি রোধে তেমন কোনো পদক্ষেপ নেয়নি সংস্থাটি। ফলে কিছুদিন পরপরই দুর্ঘটনার শিকার হচ্ছে বিমান।

আরও পড়ুন>> ফের বিমানের দুই উড়োজাহাজে সংঘর্ষ, ডানা ক্ষতিগ্রস্ত

২০২২ সালের জানুয়ারি থেকে চলতি মাস (ডিসেম্বর) পর্যন্ত এমন অসংখ্য বিতর্কিত কর্মকাণ্ড ঘটেছে বিমানে। এখন ২০২৩ সাল সংস্থাটির জন্য কতটা শুভ হবে, তা নিয়েও আলোচনা-সমালোচনা করছেন অংশীজনরা। তবে, বিমানের প্রত্যাশা, ভুল থেকে শিক্ষা নিয়েছেন তারা। ভবিষ্যতে বিমানের সেবার মান বাড়িয়ে বিতর্কিত কর্মকাণ্ড কমিয়ে আনা হবে।

আরও পড়ুন>> বিমানের প্রশ্নফাঁস: গোয়েন্দা নজরদারিতে ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা

বিমানের প্রশ্নফাঁস
গত ২১ অক্টোবর বিকেল ৩টায় ১০ পদে জনবল নিয়োগের জন্য পরীক্ষার সময় নির্ধারণ করে বিমান। তবে পরীক্ষা শুরুর ঘণ্টাখানেক আগে প্রশ্নফাঁসের অভিযোগ ওঠে। তখন পরীক্ষা স্থগিত করতে বাধ্য হয় বিমান কর্তৃপক্ষ। পরে পরীক্ষা বাতিল হওয়ায় ক্ষুব্ধ হয়ে উত্তরায় পরীক্ষাকেন্দ্রের সামনে বিক্ষোভ করেন চাকরিপ্রার্থীরা। এ ঘটনায় ওইদিন রাতেই রাজধানীর বিভিন্ন এলাকায় অভিযান চালিয়ে প্রশ্নফাঁস চক্রের ১০ জনকে গ্রেফতার করে গোয়েন্দা পুলিশ। তাদের মধ্যে পাঁচজনকে চাকরিচ্যুত করে বিমান। এ ছাড়া বিমানের ব্যবস্থাপনা পরিচালক ও সিইওর গাড়িচালকসহ অন্তত ২০ জন পলাতক।

আরও পড়ুন>> দুই প্লেনের সংঘর্ষের ঘটনায় মন্ত্রণালয়ের তদন্ত কমিটি

প্রশ্নফাঁসের বিষয়ে গত ৩ নভেম্বর ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশের (ডিএমপি) মিডিয়া সেন্টারে সংবাদ সম্মেলন করেন গোয়েন্দা পুলিশের প্রধান মোহাম্মদ হারুন অর রশীদ। তিনি জানান, নিয়োগ পরীক্ষার প্রশ্নপত্র ফটোকপি করা হয় বিমান বাংলাদেশের ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) মো. যাহিদ হোসেনের কক্ষে। আর সেখান থেকেই ছবি তুলে প্রশ্নপত্র ফাঁস করা হয়। প্রশ্নপত্র প্রণয়নে নিরাপত্তা ত্রুটির কারণেই তা ফাঁস হয়েছে, যার দায়ভার এড়াতে পারেন না ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা।

আরও পড়ুন>> ২ বিমানের সংঘর্ষের ঘটনায় ৩ কর্মকর্তা বরখাস্ত

জানতে চাইলে বিমানের সিইও মো. যাহিদ হোসেন জাগো নিউজকে বলেন, প্রশ্নফাঁসের ঘটনা গোয়েন্দা সংস্থা তদন্ত করছে। আমরা তাদের সহযোগিতা করছি। ঘটনার সঙ্গে যেই জড়িত হোক, তদন্তে উঠে আসবে। এছাড়া বিমানের তদন্ত সুষ্ঠুভাবে চলছে।

বিমানের যত অঘটন
গত এক বছরে বিমানের উড়োজাহাজে বেশ কয়েকটি অঘটন ঘটেছে। বিমানবন্দরে একাধিকবার এক উড়োজাহাজের সঙ্গে আরেক উড়োজাহাজের ধাক্কা। এতে একাধিক উড়োজাহাজের ডানা ভাঙার ঘটনা ঘটে। অথচ এটির রক্ষণাবেক্ষণ খুব সাবধানতার সঙ্গে করার কথা। হ্যাঙ্গারে ধাক্কা লেগে উড়োজাহাজ ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ার মতো ঘটনাও বিশ্বে বিরল।

আরও পড়ুন>> দরজা বন্ধ না করেই পুশব্যাক, দুর্ঘটনার কবলে ড্রিমলাইনার

এমন অঘটন দায়িত্ব অবহেলা নাকি অদক্ষতা, তা নিয়ে খোদ বিমানবন্দর সংশ্লিষ্টরাই পাইলট, প্রকৌশলীসহ সংশ্লিষ্টদের দক্ষতা নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন। এ ছাড়া ঢাকার হযরত শাজজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের নিরাপত্তা নিয়েও নানা মহলে প্রশ্ন উঠেছে। তবে বিমান কর্তৃপক্ষের দাবি, তারা প্রতিটি ঘটনার পরপরই দায়ীদের বিরুদ্ধে যথাযথ ব্যবস্থা নিয়েছে। অনেককেই চাকরিচ্যুত করা হয়েছে।

গত ১ ফেব্রুয়ারি বিমানের ড্যাশ-৮ কিউ ৪০০ উড়োজাহাজ আকাশতরীর ফ্লাইটে ওভার পাওয়ার ব্যবহার করেন পাইলট। এতে আকাশতরীর দুটি ইঞ্জিন ক্ষতিগ্রস্ত হয়। একই মাসে মালয়েশিয়া থেকে বাংলাদেশে ফেরার সময় বোয়িং ৭৩৭ এর উইন্ডশিল্ডে ফাটল দেখা দেয়।

আরও পড়ুন>> শাহজালালে বিমানের উড়োজাহাজে ইউএস-বাংলা’র ট্রলির ধাক্কা!

গত ১০ এপ্রিল হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের হ্যাঙ্গারে (উড়োজাহাজ রক্ষণাবেক্ষণের স্থান) একটি বোয়িং ৭৩৭ উড়োজাহাজ বের করার সময় আগে থেকে সেখানে থাকা আরেকটি বোয়িং ৭৭৭ উড়োজাহাজকে ধাক্কা দেয়। এ সময় দুটি উড়োজাহাজই বেশ ক্ষতিগ্রস্ত হয়। এর মধ্যে বোয়িং ৭৭৭ উড়োজাহাজের সামনের অংশে থাকা আবহাওয়া বার্তা ধরার যন্ত্র ভেঙে যায়। বোয়িং ৭৩৭ উড়োজাহাজের লেজের হরাইজন্টাল স্ট্যাবিলাইজার ভেঙে যায়।

এর আগে গত ৪ জুন রাতে পার্কিংয়ে দাঁড়িয়ে থাকা বিমানের একটি বোয়িং ৭৩৭ উড়োজাহাজকে ধাক্কা দেয় ইউএস-বাংলা এয়ারলাইন্সের একটি গ্রাউন্ড সাপোর্ট ইকুইপমেন্ট (জিএসই)। ওই ধাক্কার পর বিমানের উড়োজাহাজটির উড্ডয়ন বন্ধ রাখা হয়।

আরও পড়ুন>> শাহজালালে হ্যাঙ্গারে ঢোকানোর সময় ধাক্কা খেলো দুই বিমান

গত ১৬ জুন বিমানবন্দরে বোয়িং ৭৮৭ ড্রিমলাইনার দুর্ঘটনার শিকার হয়। ওই উড়োজাহাজটি দরজা বন্ধ না করেই এবং বোর্ডিং ব্রিজের সঙ্গে সংযোগ বিচ্ছিন্ন না করে পুশব্যাক শুরু করেন পাইলট। এতে উড়োজাহাজের দরজার সঙ্গে বোর্ডিং ব্রিজের টান লাগে। এ ছাড়া গত ৩ জুলাই রাতে হ্যাঙ্গারে বিমানের দুটি উড়োজাহাজের ধাক্কা লাগে। এতে ৭৮৭ উড়োজাহাজের ডান পাশের ডানা এবং ৭৩৭ উড়োজাহাজের বাঁ পাশের ডানা ক্ষতিগ্রস্ত হয়।

সবশেষ ১৮ জুলাই রাত ৮টা ৩৫ মিনিটে ভারতের কলকাতার নেতাজি সুভাষ চন্দ্র বোস আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে উড্ডয়নের সময় বিজি-৩৯৬ ফ্লাইটের উড়োজাহাজে যান্ত্রিক ত্রুটি ধরা পড়ে। এতে প্রায় চার ঘণ্টা উড়োজাহাজটি রানওয়েতে আটকে ছিল। এ সময় শীতাতপ নিয়ন্ত্রণ যন্ত্র (এসি) বন্ধ হয়ে যাওয়ায় গরমে অসুস্থ হয়ে পড়েন উড়োজাহাজে থাকা ১৫৮ যাত্রী।

আরও পড়ুন>> কলকাতায় বিমানের ফ্লাইটে ত্রুটি, ৪ ঘণ্টা ভেতরে আটকা ১৮৫ যাত্রী

এ বিষয়ে জানতে চাওয়া হলে বিমানের মহাব্যবস্থাপক (জনসংযোগ) তাহেরা খন্দকার বলেন, বিমানের দায়িত্ব অবহেলার সুযোগ নেই। যে কয়েকটি ঘটনা ঘটেছে, এগুলো দুর্ঘটনা। প্রতি ঘটনাই বিমান তদন্ত করে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিয়েছে।

তবে নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক বিমানের এক কর্মকর্তা বলেন, এখন বিমানে ২১টি উড়োজাহাজ রয়েছে। এসব উড়োজাহাজ পরিচালনায় জনবল সংকট ও কর্মীদের প্রশিক্ষণের অভাব রয়েছে।

আরও পড়ুন>> ঢাকায় পৌঁছালো কলকাতায় যান্ত্রিক ত্রুটিতে পড়া বিমান

সারচার্জ মওকুফ চেয়ে বিমানের আবেদন নিয়ে সমালোচনা
বিমানের কাছে বেসামরিক বিমান চলাচল কর্তৃপক্ষের (বেবিচক) পাওনা প্রায় ৮ হাজার কোটি টাকা। এর মধ্যে বকেয়া আরোপিত সারচার্জ ৩ হাজার ৪৪৯ কোটি টাকা। এ সারচার্জ মওকুফের জন্য গত ১৫ সেপ্টেম্বর পর্যটন মন্ত্রণালয়ে চিঠি দিয়েছে বিমান। পরে এ আবেদন বিবেচনা করতে বেবিচককে সুপারিশ করে মন্ত্রণালয়। কিন্তু বেবিচক জানিয়েছে, সারচার্জ মওকুফের এখতিয়ার তাদের নেই। এটা অর্থ মন্ত্রণালয়ের কাজ। বিমানের এমন আবেদনে নানা মহলে সমালোচনার জন্ম দিয়েছে।

বিমানের ওই চিঠিতে বলা হয়, কোম্পানি হিসেবে প্রতিষ্ঠা প্রাপ্তির পর জ্বালানি তেলের দাম ঊর্ধ্বগতি, অসম প্রতিযোগিতা, উড়োজাহাজের স্বল্পতা, পুরোনো উড়োজাহাজ বহর থেকে সরানো ইত্যাদি কারণে আগের বকেয়া অর্থ বেবিচককে পরিশোধ করা বিমানের পক্ষে সম্ভব হয়নি। ২০১৬ সাল থেকে বেবিচকের সবধরনের ল্যান্ডিং, পার্কিং, রুট নেভিগেশন বিল নিয়মিত পরিশোধ করছে বিমান।

আরও পড়ুন>> বিমানে একের পর এক অঘটন, অবহেলা নাকি অদক্ষতা?

জানতে চাইলে বেসামরিক বিমান পরিবহন ও পর্যটন প্রতিমন্ত্রী মাহবুব আলী বলেন, বিমান বিগত বছরের তুলনায় বর্তমানে লাভে আছে। তবে, আগে যেসব বকেয়া ছিল, সেগুলোর সারচার্জ মওকুফের বিষয়ে অর্থ মন্ত্রণালয়ের সঙ্গে কথা বলবো।

এমএমএ/এমএএইচ/এএসএম

টাইমলাইন  

পাঠকপ্রিয় অনলাইন নিউজ পোর্টাল জাগোনিউজ২৪.কমে লিখতে পারেন আপনিও। লেখার বিষয় ফিচার, ভ্রমণ, লাইফস্টাইল, ক্যারিয়ার, তথ্যপ্রযুক্তি, কৃষি ও প্রকৃতি। আজই আপনার লেখাটি পাঠিয়ে দিন [email protected] ঠিকানায়।