যাত্রী খরায় কমেছে আয়

রাইড শেয়ারিং ছাড়তে চাইছেন চালকরা

সাইফুল হক মিঠু
সাইফুল হক মিঠু সাইফুল হক মিঠু
প্রকাশিত: ০৮:৩৯ এএম, ২৯ নভেম্বর ২০২২

#প্রয়োজনের রাইড শেয়ারিং এখন বিলাসিতা
#দু’ বছরের মধ্যে হুমকির মুখে পড়বে এই খাত
#১৫০ থেকে ১৮০ টাকার মধ্যে গন্তব্যে যেতে চায় যাত্রীরা

তিন বছর আগে হিসাবরক্ষকের চাকরি ছেড়ে বেশি কামাইয়ের আশায় রাইড শেয়ারিং শুরু করেন শেরপুরের যুবক মুন্না তালুকদার। করোনায় যাত্রী কমে গেলেও শেয়ারিং প্রতিষ্ঠানগুলো কমিশন কমায়নি। অনেকটা ক্ষুব্ধ হয়েই রাইড শেয়ারিং অ্যাপ ব্যবহার বন্ধ করেন। জ্বালানির মূল্যবৃদ্ধির আগে ভাড়ায় মোটরসাইকেল চালিয়ে ২৫-৩০ হাজার টাকা আয় হতো। গত জুলাইয়ের পর এই আয় অর্ধেকে নেমেছে।

অন্যদিকে কয়েক দফায় বেড়েছে নিত্যপ্রয়োজনীয় সব পণ্যের দাম। খরচের যুদ্ধে টিকতে না পেরে প্রথমে পরিবারকে বাড়ি পাঠিয়েছেন। যাত্রী কমে যাওয়া, ট্রাফিক পুলিশের হয়রানি সর্বোপরি পণ্যের দামের লাগামহীন ঘোড়ায় পরাস্ত এই যুবক বলেন, রাইড শেয়ারিং ছেড়ে দিয়ে নতুন করে আবার চাকরিতে ফিরবেন। শেরপুরে যে অ্যাগ্রো ফার্মে তিনি কাজ করতেন সেখানে যোগদান করতে পারেন।

আরও পড়ুন  রাইড শেয়ারিং ও কুরিয়ারে খরচ বাড়ছে ২০ শতাংশ 

মুন্নার মতোই অবস্থা বেশিরভাগ ভাড়ায়চালিত মোটরসাইকেল চালকের। তারা বলছেন, যারা অফিস কিংবা ব্যবসা করেন তারা শখের বসে অ্যাপ ব্যবহার করে রাইড শেয়ারিং করেন। যারা জীবিকা নির্বাহ করেন তারা অ্যাপ ছাড়াই রাইড শেয়ারিং করেন।

উদাহরণ দিয়ে পল্টনের জামান টাওয়ারের রাইড শেয়ারিংচালক নুরুজ্জামান বলেন, দিনে ৩০০ টাকার তেল খরচ আছে একটা গাড়ির। পল্টন মোড় থেকে ফার্মগেট পর্যন্ত কেউ যদি রাইড নেয় তার আসে ১২০-১৫০ টাকার মতো। এর মধ্যে কাস্টমারের ডিসকাউন্ট, অ্যাপের কমিশন সবকিছু কেটেকুটে চালকের পকেটে ঢোকে ৫০ থেকে ৬০ ঢাকা। যানজটের কারণে সামান্য দূরত্বে অনেক সময় লেগে যায়। সারাদিনে চার-পাঁচটা রাইড পাওয়া যায়। অ্যাপে চালালে তেলের খরচও ওঠে না।

আরও পড়ুন: সর্বনিম্ন ১০০ টাকা ভাড়া চান উবার চালকরা 

তিনি বলেন, চালকরা প্রথমে অ্যাপে চালাতো। সেই সময় সুযোগ-সুবিধা বেশি ছিল। কিন্তু এখন চালকের জন্য কিছু নেই। যারা অন্যকিছু করেন তারা অ্যাপে রাইড শেয়ারিং করেন তেলের টাকাটা উঠানোর জন্য। এই অ্যাকাউন্ট বন্ধ, ওই পুলিশের মামলা এভাবে রাইড শেয়ারিং খুব খারাপ একটা জায়গায় চলে যাচ্ছে। অনেকেই এটা ছেড়ে দিচ্ছে।

রাইড শেয়ারিং ছাড়তে চাইছেন চালকরা

রাইড শেয়ারিংয়ে আগ্রহ হারাচ্ছে মানুষ-ছবি জাগো নিউজ

বৈশ্বিক অর্থনৈতিক সংকট ও ইউরোপে যুদ্ধের অজুহাতে চলতি বছরের আগস্টে জ্বালানি তেলের দাম প্রায় ৫২ শতাংশ বাড়ানো হয়। কয়েকমাস পরে নামমাত্র কমানো হলেও নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিসের মূল্য দ্বিগুণের বেশি।

আরও পড়ুন: জ্বালানির মূল্যবৃদ্ধিতে দুশ্চিন্তায় উবার-পাঠাও চালকরা

সম্প্রতি গবেষণা প্রতিষ্ঠান সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগ (সিপিডি) বলছে, মূল্যস্ফীতি বেড়ে যাওয়ায় বর্তমানে নগরবাসীকে খাবার খেতে হিমশিম খেতে হচ্ছে। মাছ-মাংস না খেয়েও রাজধানীতে চার সদস্যের একটি পরিবারকে মাসে এখন খাবার কিনতে গড়ে ৯ হাজার ৫৯ টাকা খরচ করতে হয়। আর মাছ-মাংস খেলে ওই পরিবারের খাবারে খরচ হয় ২২ হাজার ৪২১ টাকা। এর প্রভাব পড়েছে মানুষের জীবনযাত্রায়। খাদ্য, বাসস্থান ও চিকিৎসার খরচ জুগিয়ে প্রয়োজনের রাইড শেয়ারিং এখন বিলাসিতা হয়ে গেছে।

বেসরকারি চাকরিজীবী নাজমুল হাসান বলেন, টিউশনিসহ বিভিন্ন কাজে আগে রাইড শেয়ারিংয়ে চলাচল করতাম। তবে এখন সরকারি চাকরির পরীক্ষার দিনে শুধু রাইড শেয়ারিং নেই, তাও পরীক্ষার ভেন্যু দূরে হলে।

তিনি বলেন, রাইড শেয়ারিং এখন আর প্রয়োজন না। অতিমাত্রায় প্রয়োজন হলেও ব্যবহার করা হয় না। অন্যান্য খরচ এতটা বেড়েছে যে, মোটরসাইকেলে না চড়ে এখন একটু হেঁটে কিংবা বাসে যাতায়াতের চেষ্টা করি।

jagonews24একটু হেঁটে কিংবা বাসে যাতায়াতের চেষ্টা করছে মানুষ-ছবি জাগো নিউজ

২০১৬ সালের শেষে যাত্রা শুরু করে বাংলাদেশের রাইড শেয়ারিং কোম্পানি পাঠাও। একই সময় যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক প্রতিষ্ঠান উবার বাংলাদেশে তাদের কার্যক্রম শুরু করে। বর্তমানে এ দুটো কোম্পানি সিংহভাগ বাজার দখল করে রেখেছে।

এছাড়া ওভাই, পিকমি, ডিজিটাল রাইড, সহজসহ ১০টির মতো রাইড শেয়ারিং প্রতিষ্ঠান আছে বাংলাদেশে। ট্রাফিক পুলিশের এক হিসাবে দেখা গেছে, রাজধানীতে রাইড শেয়ারিং করে মোটরসাইকেল চালাচ্ছেন চার লাখেরও বেশি চালক। কমিশন বেশি নেওয়া, অ্যাকাউন্ট বন্ধ করে দেওয়াসহ নানা অভিযোগে চালকরা অ্যাপে নয় খ্যাপে যেতে আগ্রহী। এ কারণে প্রধান সড়কের মোড়ে কিংবা চলতি পথে অনেক রাইড শেয়ারকারীকে যাত্রী তোলার আশায় দাঁড়িয়ে থাকতে দেখা যায়। চোখের ইশারায় কিংবা অনেকে পথচারীদের গন্তব্যে নিয়ে যাওয়ার আহ্বান করেন।

জানতে চাইলে অ্যাপ-বেইজড ড্রাইভারস ইউনিয়ন অব বাংলাদেশের (ডিআরডিইউ) সাধারণ সম্পাদক বেলাল আহমদ জাগো নিউজকে বলেন, ভালো নেই দেশের রাইড শেয়ারকারীরা। এটা আসলে রাইড শেয়ারিং নয়, রাইড হেলিং। সুবিধাবঞ্চিত রাখার জন্য এটাকে রাইডশেয়ারিং বলা হয়। চালকদের খাবারের টাকাই গোগাড় করা মুশকিল হয়ে গেছে, তারা গাড়ির মেইনটেইন কীভাবে করাবে। শারীরিকভাবে তারা ভেঙে পড়েছে। সড়ক থেকে মোটরসাইকেল কমেছে। এক-তৃতীয়াংশ ব্যক্তিগত গাড়ি কমে গেছে। হয়তো আগামী দু’ বছরের মধ্যে হুমকির মুখে পড়বে এই খাতটি।

তিনি বলেন, চালকদের বাঁচাতে হলে রাইড শেয়ারিংকে একটা নীতিমালার মধ্যে আনতে হবে। চালকদের নিরাপত্তা ও আয়ের সামঞ্জস্য সেটা ঠিক করতে হবে।

কারওয়ান বাজার মোড়ে কথা হয় ভোলার সায়েমুজ্জামান সায়েমের সঙ্গে। তিনি বলেন, মানুষের পকেটে টাকা নেই তারা রাইড শেয়ারিংয়ে উঠতে চায় না। বেশিরভাগ যাত্রী ১৫০ থেকে ১৮০ টাকা রেঞ্জের মধ্যে গন্তব্যে যেতে চায়। যেখানে অ্যাপে ভাড়া দেখায় ৩০০ টাকা সেখানেও ২০০ টাকার কমে যেতে চায়।

আরও পড়ুন: কোম্পানি-চালক দ্বন্দ্বে জনপ্রিয়তা হারাচ্ছে রাইড শেয়ারিং 

তিনি বলেন, আগস্টের আগেও দিনে ১৪০০-১৫০০ টাকা থাকতো। সেটা এখন ৭০০ টাকায় এসে থেমেছে। আগে বাসা নিয়ে থাকতাম, আয় কমায় বাসা ছেড়ে দিয়েছি। এখন বোনের বাসায় থাকছি।

অন্য চালক সায়েমও চান রাইড শেয়ারিং ছেড়ে দিতে। চার বছর রাইড শেয়ারিং করে শারীরিক ও মানসিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে জানিয়ে তিনি বলেন, একটা কোম্পানির সেলসে কাজ করতাম। তখন যে টাকা বেতন পেতাম এখন সেই টাকা রাইড শেয়ারিং করে আয় করতে পারি না। শরীর খারাপ, এখন আর পাঁচ-ছয় ঘণ্টার বেশি মোটরসাইকেল চালাতে পারি না। জানুয়ারিতে এটা ছেড়ে দেব, মোটরসাইকেল বিক্রি করে ভোলায় ফিরে যাবো।

এসএম/এসএইচএস/জিকেএস

রাইড শেয়ারিং এখন আর প্রয়োজন না। অতিমাত্রায় প্রয়োজন হলেও ব্যবহার করা হয় না। অন্যান্য খরচ এতটা বেড়েছে যে, মোটরসাইকেলে না চড়ে এখন একটু হেঁটে কিংবা বাসে যাতায়াতের চেষ্টা করি।

মানুষের পকেটে টাকা নেই, তারা রাইড শেয়ারিংয়ে উঠতে চায় না। বেশিরভাগ যাত্রী ১৫০ থেকে ১৮০ টাকা এই রেঞ্জের মধ্যে গন্তব্যে যেতে চায়। যেখানে অ্যাপে ভাড়া দেখায় ৩০০ টাকা সেখানেও ২০০ টাকার কমে যেতে চায়।

দিনে ৩০০ টাকার তেল খরচ আছে একটা গাড়ির। পল্টন মোড় থেকে ফার্মগেট পর্যন্ত কেউ যদি রাইড নেয় তার আসে ১২০-১৫০ টাকার মতো। এর মধ্যে কাস্টমারের ডিসকাউন্ট, অ্যাপের কমিশন সবকিছু কেটেকুটে চালকের পকেটে ঢুকে ৫০ থেকে ৬০ ঢাকা। যানজটের কারণে সামান্য দূরত্বে অনেক সময় লেগে যায়। সারাদিনে ৪-৫টা রাইড পাওয়া যায়। অ্যাপে চালালে তেলের খরচও ওঠে না।

পাঠকপ্রিয় অনলাইন নিউজ পোর্টাল জাগোনিউজ২৪.কমে লিখতে পারেন আপনিও। লেখার বিষয় ফিচার, ভ্রমণ, লাইফস্টাইল, ক্যারিয়ার, তথ্যপ্রযুক্তি, কৃষি ও প্রকৃতি। আজই আপনার লেখাটি পাঠিয়ে দিন [email protected] ঠিকানায়।