প্রবাসীদের এনআইডি বিতরণ নিয়ে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়-ইসি ‘রেষারেষি’
ফাইলবন্দি হয়ে পড়ে রয়েছে প্রবাসীদের জাতীয় পরিচয়পত্র (এনআইডি) দেওয়ার কার্যক্রম। ইসির প্রস্তাব অনুযায়ী কর্মকর্তারা প্রকল্পের আওতায় বিদেশে যেতে পারছেন না। এই কৃচ্ছ্রসাধনের সময় পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় থেকে এ বিষয়ে আপত্তি তোলা হয়েছে। পররাষ্ট্রমন্ত্রীও চান বিদেশের মিশনগুলোর কর্মকর্তারাই কাজটি সম্পন্ন করুক। বিদেশ যেতে পারা না পারার বিষয়ে কথা না বললেও জাতীয় পরিচয় নিবন্ধন (এনআইডি) অনুবিভাগের মহাপরিচালক বলছেন, পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সঙ্গে সমন্বয় হচ্ছে না। করোনার কারণেও প্রবাসীদের এনআইডি দেওয়া যায়নি। আর পররাষ্ট্রমন্ত্রী বলছেন, এ ব্যাপারে ইসিকে চিঠি দেওয়া হলেও কোনো উত্তর পাওয়া যাচ্ছে না।
পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত সংসদীয় স্থায়ী কমিটিতে উত্থাপিত মন্ত্রণালয়ের দেওয়া সবশেষ তথ্য থেকে জানা যায়, যুক্তরাষ্ট্র, লন্ডন, ইউএই ও কুয়ালালামপুরে প্রবাসীদের জাতীয় পরিচয়পত্র বিতরণের সিদ্ধান্তটি দ্রুত বাস্তবায়নের লক্ষ্যে সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়কে অনুরোধ জানানোর সুপারিশ করা হয়। কমিটির সিদ্ধান্ত বাস্তবায়নের ক্ষেত্রে অন্য মন্ত্রণালয় বা বিভাগের সম্পৃক্ততা থাকলেও তা সঠিকভাবে বাস্তবায়নের জন্য নিয়মিত ফলোআপ করার সুপারিশ করা হয় পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় থেকে। এ পরিপ্রেক্ষিতে সংসদীয় কমিটিতে প্রবাসীদের এনআইডি সংক্রান্ত তথ্য উপস্থাপন করে মন্ত্রণালয়।
বিভিন্ন দেশে দেড় কোটির মতো বাংলাদেশের নাগরিক বসবাস করছেন বলে অনেক প্রতিবেদনে উঠে এসেছে। এদের অধিকাংশেরই এনআইডি নেই। ফলে অনেকে জমিজমা কেনাবেচা, ছেলেমেয়েদের স্কুলে ভর্তি, ব্যাংক অ্যাকাউন্ট খোলা, পাসপোর্ট নবায়নসহ এ সংক্রান্ত যাবতীয় সেবা থেকে বঞ্চিত। কিন্তু বিভিন্ন সময় বিভিন্ন কমিশন তাদের এনআইডি দেওয়ার আশ্বাস দিলেও তা কার্যকর হয়নি। ঘটা করে কয়েকটি দেশে এনআইডি দেওয়ার কাজ শুরু হলেও বেশিদূর এগোতে পারেনি ইসি।
আরও পড়ুন: সবচেয়ে বেশি প্রবাসী যে ১০ জেলায়
যুক্তরাষ্ট্র প্রবাসী আনোয়ারুল কবির জাগো নিউজকে জানান, দীর্ঘদিন প্রবাসে থাকায় তার এনআইডি হয়নি। এজন্য অনেক বিড়ম্বনার মধ্যে পড়তে হচ্ছে। জমি কিনতে ও বেচতে পারেন না।
প্রবাসীদের পরিচয়পত্র দিতে একটি প্রকল্প রয়েছে সরকারের। যেখানে বরাদ্দও আছে শতকোটি টাকা। অনলাইনে আবেদন করলেও প্রবাসীদের তথ্য যাচাই-বাছাইয়ের পর সেটি ঠিক থাকলে তাদের ফিঙ্গার প্রিন্ট ও চোখের আইরিশ নেওয়ার প্রয়োজন হবে। ২০২০ সালের ডিসেম্বর থেকে ২০২৫ সালের নভেম্বর মেয়াদে ‘আইডেন্টিফিকেশন সিস্টেম ফর এনহ্যান্সিং একসেস টু সার্ভিসেস (আইডিয়া) দ্বিতীয় পর্যায়’ শীর্ষক প্রকল্পটি হাতে নেয় নির্বাচন কমিশন। প্রকল্পের আওতায় প্রবাসে নিবন্ধন টিম পাঠানো ও বাংলাদেশি নাগরিকদের নিবন্ধন সংক্রান্ত ব্যয় হিসেবে একশ কোটি টাকা বরাদ্দও দেওয়া হয়েছে। কিন্তু প্রকল্প গ্রহণের প্রায় দুই বছরের বেশি সময় পার হলেও ফলাফল শূন্য।
নির্বাচন কমিশনের এনআইডি অনুবিভাগের পরিচালক (প্রশাসন ও অর্থ) মোহাম্মদ আজিজুল ইসলাম জাগো নিউজকে বলেন, প্রকল্প নেওয়ার আগেই ২০১৯ সালে নভেম্বরে অনলাইনে প্রবাসীদের ভোটার হওয়ার কার্যক্রম মালয়েশিয়া থেকে শুরু হয়েছে। মালয়েশিয়ায় বাংলাদেশ দূতাবাসে প্রবাসীকল্যাণমন্ত্রী ইমরান আহমেদ ও বাংলাদেশ প্রান্তে তৎকালীন প্রধান নির্বাচন কমিশনার কে এম নুরুল হুদা ভিডিও সম্মেলনের মাধ্যমে এ কার্যক্রম উদ্বোধন করেন।
পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় সংসদীয় কমিটিতে জানায়, এ লক্ষ্যে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়, নির্বাচন কমিশন সচিবালয় এবং সংশ্লিষ্ট বিদেশি মিশনগুলোর মধ্যে নিবিড় আলোচনা ও সমন্বয় চলমান। মিশনগুলো পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়কে জানিয়েছে যে, তাদের এ ব্যাপারে পূর্ণ প্রস্তুতি রয়েছে। নির্বাচন কমিশন সচিবালয়ও প্রস্তুত। প্রাথমিকভাবে নির্বাচন কমিশন সচিবালয় প্রস্তাব করেছিল, নির্বাচন কমিশন সচিবালয় থেকে প্রতিনিধিদল মিশনে গিয়ে প্রবাসী বাংলাদেশিদের বায়োমেট্রিক তথ্য নেবেন। পরে দেশে এসে প্রক্রিয়াকরণ ও প্রিন্ট করে বিতরণের জন্য সংশ্লিষ্ট মিশনে পাঠাবে।
আরও পড়ুন: এনআইডি সেবায় স্বরাষ্ট্রে হবে অনুবিভাগ, আইন যাচ্ছে মন্ত্রিপরিষদে
পরে পররাষ্ট্রমন্ত্রী একটি পর্যবেক্ষণ দেন। তিনি মনে করেন, নির্বাচন কমিশন সচিবালয় প্রস্তাবিত প্রতিনিধিদল মিশনে গিয়ে প্রবাসী বাংলাদেশিদের বায়োমেট্রিক তথ্য নেওয়ার পরিবর্তে মিশনের কর্মকর্তাদের মাধ্যমে বায়োমেট্রিক তথ্য গ্রহণ বর্তমান কৃচ্ছ্রসাধন নীতির আলোকে অধিকতর সমীচীন হবে। এজন্য নির্বাচন কমিশন সচিবালয় সংশ্লিষ্ট মিশনগুলোতে বায়োমেট্রিক তথ্য সংগ্রহের জন্য প্রয়োজনীয় যন্ত্রপাতি স্থাপন করতে পারে।
বিদেশের বাংলাদেশ মিশনগুলোতে প্রবাসী বাংলাদেশিদের পাসপোর্ট আবেদনের ক্ষেত্রে মিশন আবেদনকারীর বায়োমেট্রিক তথ্য সংগ্রহ করে আবেদনগুলো ইমিগ্রেশন ও পাসপোর্ট অধিদপ্তরে যাচাই-বাছাই এবং পাসপোর্ট প্রিন্টের জন্য পাঠায়। প্রবাসী বাংলাদেশিদের পাসপোর্ট প্রিন্ট করার পর ইমিগ্রেশন ও পাসপোর্ট অধিদপ্তর সেগুলো বিতরণ করার জন্য মিশনগুলোতে ডাকযোগে পাঠায়। স্মার্ট জাতীয় পরিচয়পত্র দেওয়ার ক্ষেত্রেও একই পদ্ধতি অনুসরণ টেকসই, বাস্তবসম্মত, সাশ্রয়ী ও অধিক প্রবাসীবান্ধব হবে বলে মনে করছে সরকার।
পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় আরও জানায়, এ ব্যাপারে পররাষ্ট্রমন্ত্রীর তরফ থেকে প্রধান নির্বাচন কমিশনার বরাবর একটি চিঠি পাঠানো হয়েছে। চিঠিটি নির্বাচন কমিশন সচিবালয়ের বিবেচনাধীন। তাদের কাছ থেকে উত্তর পাওয়া গেলে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়, নির্বাচন কমিশন সচিবালয় এবং মিশনগুলো একযোগে কাজ করবে। পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় এ ব্যাপারে নির্বাচন কমিশন সচিবালয়ের সঙ্গে নিয়মিত ফলোআপ ও সমন্বয় করে পরবর্তী প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেবে।
পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের একটি সূত্র জানায়, ইসির কর্মকর্তারা বিদেশ যেতে না পেরে চিঠির কোনো উত্তর দিচ্ছেন না। আর এ ব্যাপারে কোনো অগ্রগতিও হচ্ছে না। নতুন কমিশন আসার পরও চিঠি দেওয়া হয়েছে। কিন্তু কোনো উত্তর পাওয়া যাচ্ছে না।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে জাতীয় পরিচয় নিবন্ধন (এনআইডি) অনুবিভাগের মহাপরিচালক এ কে এম হুমায়ূন কবীর জাগো নিউজকে বলেন, আমরা প্রস্তুত, কিন্তু পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সঙ্গে সমন্বয় হচ্ছে না। আর করোনার কারণেও এনআইডি দেওয়া বন্ধ ছিল।
তবে এটি অস্বীকার করে পররাষ্ট্রমন্ত্রী এ কে আব্দুল মোমেন জাগো নিউজকে বলেন, প্রাথমিকভাবে নির্বাচন কমিশন সচিবালয় প্রস্তাব করেছিল যে, তারা প্রতিনিধিদল মিশনে পাঠিয়ে প্রবাসী বাংলাদেশিদের বায়োমেট্রিক তথ্য নিয়ে তা দেশে এসে প্রক্রিয়াকরণ এবং প্রিন্ট করে বিতরণের জন্য সংশ্লিষ্ট মিশনে পাঠাবে। কিন্তু এটি ব্যয়বহুল। সরকারের অনেক টাকা নষ্ট হবে। তাই আমরা বলেছি, মিশনের কর্মকর্তাদের মাধ্যমে বায়োমেট্রিক তথ্য গ্রহণ করা বর্তমান কৃচ্ছ্রসাধন নীতির আলোকে অধিকতর সমীচীন। এ ব্যাপারে ইসিকে চিঠি দেওয়া হলেও কোনো উত্তর পাওয়া যাচ্ছে না।
এইচএস/এএসএ/জিকেএস