দুদকের আলোচিত কর্মকর্তা শরীফ এখন দোকানি

ইকবাল হোসেন
ইকবাল হোসেন ইকবাল হোসেন , নিজস্ব প্রতিবেদক, চট্টগ্রাম চট্টগ্রাম
প্রকাশিত: ০৭:১৭ পিএম, ০৬ নভেম্বর ২০২২
দুদকের চাকরিচ্যুত কর্মকর্তা শরীফ

মো. শরীফ উদ্দিন। দুর্নীতি দমন কমিশনের (দুদক) চাকরিচ্যুত উপ-সহকারী পরিচালক। চাকরি হারিয়ে সাবেক এই দুদক কর্মকর্তা সংসার চালানোর জন্য হয়েছেন কনফেকশনারি দোকানি। চট্টগ্রামের ষোলশহর রেলওয়ে স্টেশনের প্ল্যাটফর্মে ‘ওমর কফি শপ’ নামের দোকানটিতে নিয়মিত বসেন। নতুন পেশায় যুক্ত হওয়ার পর বেশিরভাগ মানুষ তাকে সাধুবাদ জানালেও শরীফ বলছেন, ‘জীবন তো বাঁচাতে হবে। তাই দোকানে বসেছি।’

তিনি জানান, চাকরি হারিয়ে যখন মানসিক অবসাদে ভুগছিলেন, যখন পরিচিত মুখগুলো ধীরে ধীরে সরে যাচ্ছিলেন, তখন সংসার চালানোর তাগিদে এই ওমর কফি শপ নামের কনফেকশনারিতে দোকানদারি শুরু করেন শরীফ উদ্দিন। দোকানটি তার ভাইয়ের।

২০২১ সালের ১৬ জুন তাকে চট্টগ্রাম থেকে পটুয়াখালীতে বদলি করা হয়। পরে চলতি বছরের ১৬ ফেব্রুয়ারি দুদকের চাকরি বিধিমালা ৫৪ এর ২ ধারায় কমিশনের চেয়ারম্যানের একক ক্ষমতাবলে শরীফ উদ্দিনকে চাকরিচ্যুত করা হয়।

আরও পড়ুন: যে কোনো সময় গুম হয়ে যেতে পারি: চাকরিচ্যুত দুদক কর্মকর্তা

দুদকের চাকরি বিধিমালা ৫৪ এর ২ ধারায় বলা আছে, ‘এই বিধিমালায় ভিন্নরূপ যাহা কিছুই থাকুক না কেন, উপযুক্ত কর্তৃপক্ষ কোনো কারণ না দর্শাইয়া কোনো কর্মচারীকে নব্বই দিনের নোটিশ প্রদান করিয়া অথবা নব্বই দিনের বেতন নগদ পরিশোধ করিয়া তাহাকে চাকরি হইতে অপসারণ করিতে পারিবে।’

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক দুদকের মাঠ পর্যায়ের একাধিক কর্মকর্তা বলেন, শরীফের দেওয়া অভিযোগপত্র অনুমোদন দেওয়া হয়নি, উল্টো কোনো আইন না মেনে ওইসব মামলা পুনরায় তদন্ত কর্মকর্তা নিয়োগ দিয়ে তদন্ত করে বড় বড় আমলা ও পুলিশ কর্মকর্তাদের দায়মুক্তি দেওয়ার চেষ্টা চলছে।

এদিকে নতুন পেশা শুরুর পর রোববার (৬ নভেম্বর) দুপুরে ষোলশহর রেলস্টেশনের প্ল্যাটফর্মে ওমর কফি শপে কথা হয় শরীফ উদ্দিনের সঙ্গে। তিনি জাগো নিউজকে বলেন, ‘এক মাস ধরে দোকানে বসছি। আমাকে অপসারণের পর দুদকসহ বিভিন্ন সরকারি সংস্থা আমার স্থায়ী-অস্থায়ী সবগুলো বিষয় নিয়ে অনুসন্ধান করেছে। অপসারণের পর বেনামি একটি অভিযোগ করা হয়েছে। তাতে উল্লেখ করা হয়েছে, আমি নাকি হাজার কোটি টাকার মালিক, আমার ৩৭টি বাড়ি আছে, সিঙ্গাপুরে নাকি ৪টি বাড়ি আছে। এগুলো কই?’

jagonews24

এখন সংসার কীভাবে চলছে জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘জীবনের মৌলিক চাহিদা মেটানোর জন্য যা না করলে নয়, তাই করতে হচ্ছে। আগে সরকারি চাকরি করতাম, প্রতি মাসে বেতন আসতো। তাতে সংসার চলতো। এখন কোনো কাজ নেই, সংসারের খরচ চালাতে হিমশিম খেতে হচ্ছে। পরিবারের খরচ, বাচ্চাদের পড়ালেখার খরচ, মায়ের ওষুধ- কোনোটাই তো বন্ধ নেই। অপসারণের পর ছোটখাটো হলেও একটি চাকরি নিতে অনেক শুভাকাঙ্ক্ষীর কাছে গিয়েছি, যাতে আমার পরিবারের খরচটা চালাতে পারি। কিন্তু দুদকের ভয়ে কেউ চাকরি দিতে চায় না। কিছু একটা তো করতে হবে, জীবন তো বাঁচাতে হবে। তাই দোকানে বসেছি।’

আরও পড়ুন: দুদকে রিভিউ আবেদন করবেন চাকরিচ্যুত শরীফ

পরোক্ষভাবে অনেক হুমকি পাওয়ার কথাও জানান দুদকের এই আলোচিত কর্মকর্তা। যখন তার সঙ্গে কথা হয় তখন তিনি দোকানের ক্যাশ সামলাচ্ছিলেন। ক্রেতাদের জিনিসপত্র দিচ্ছিলেন, আর দাম নিয়ে ক্যাশবাক্সে রাখছিলেন।

কাজের ফাঁকে ফাঁকে তিনি জাগো নিউজকে বলেন, ‘আমাকে রাস্তার ফকির বানাবে। রাস্তায় রাস্তায় ঘুরাবে। দেশান্তরি করবে-এমন হুমকি দেওয়া হচ্ছিল অনেক দিন থেকে।’

 

তিনি বলেন, ‘আমি দেশের জন্য কাজ করেছি। ক্রিমিনাল ইনটেনশন (অপরাধ প্রবণতা) নিয়ে কোনো কাজ করিনি। গুড ফেইথ (বিশ্বস্ততা) নিয়ে কাজ করেছি। আমার ভুল হতে পারে, কারণ যারা কাজ করেন, তাদের ভুল হবে। যাদের কাজ নেই, তাদের ভুলও নেই। দুদক আমাকে সুযোগ দিতে পারতো।’

jagonews24

‘দুর্নীতিবাজ চক্রগুলো আমার বিরুদ্ধে এখনো বেনামি চিঠি দিয়ে যাচ্ছে। আমি নাকি ইয়াবাখোর, গাঁজাখোর। আমি জীবনে কখনো সিগারেট খাইনি। হাতও দেইনি। এই দোকানে বসে ক্রেতাদের দেওয়ার জন্য হাতে সিগারেট ধরেছি। তাও কাস্টমারদের দেওয়ার জন্য। আমি একজন ভেটেরিনারি চিকিৎসক। ধূমপান ক্ষতিকর, সেটা আমার জানা আছে।’ যোগ করেন তিনি।

নতুন জায়গায় কাজ শুরুর অনুভূতি জানতে চাইলে তিনি খ্যাতির বিড়ম্বনার কথা জানান। বলেন, ‘দেশের মানুষ আমাকে ভালোবাসেন, সেই ভালোবাসার কারণে আমি এখনো টিকে আছি। চাকরি হারানোর পর এই ৯ মাসে আমার প্রতি গণমাধ্যমের যে ভালোবাসা, তাতে আমি অভিভূত।’

আরও পড়ুন: শরীফকে দুদকের চাকরিতে ফেরানোর দাবিতে চট্টগ্রামে মানববন্ধন

সাধারণ মানুষের অভিব্যক্তি সম্পর্কে শরীফ বলেন, ‘যারাই আমাকে চেনেন, তারা আমাকে এখন অভিনন্দন জানাচ্ছেন। বলছেন, আপনি হালাল ব্যবসা করছেন। অনেকে দেশের টাকা চুরি করে বিদেশে পাচার করে। আপনি সেই পথে না গিয়ে হালাল একটি ব্যবসা করছেন। এটাই সবার জন্য শিক্ষা হওয়া উচিত।’

পরিবারের সাপোর্ট পাচ্ছেন কি না জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘আমি ভেটেরিনারি ডাক্তার ছিলাম। আমি চাইলেই তো আগের মতো চলতে পারবো না। আমার ফ্যামিলি আমার দিকটা বিবেচনা করে। বাচ্চাদের আমি মুখ দেখাতে পারি না। আগে বিভিন্ন অনুসন্ধান নিয়ে রাতের পর রাত কক্সবাজারে থাকতাম। এখন বাসায় বসে থাকি। এখন সন্তানরা প্রশ্ন করে, বাবা তুমি এখন কক্সবাজার যাও না? যখন কয়েকজন লোক আমার বাসায় এসে আমাকে হুমকি দিয়ে গেলো, বিষয়টি জানাজানি হওয়ার পর আবার বাচ্চা আমাকে জিজ্ঞেস করে, বাবা তোমাকে মারতে আসছে কেন? তুমি কাঁদো কেন? আসলে এগুলোর কোনো উত্তর নেই।’

ইকবাল হোসেন/ইএ/জিকেএস

পাঠকপ্রিয় অনলাইন নিউজ পোর্টাল জাগোনিউজ২৪.কমে লিখতে পারেন আপনিও। লেখার বিষয় ফিচার, ভ্রমণ, লাইফস্টাইল, ক্যারিয়ার, তথ্যপ্রযুক্তি, কৃষি ও প্রকৃতি। আজই আপনার লেখাটি পাঠিয়ে দিন [email protected] ঠিকানায়।