কার্যক্রম নিয়ে প্রশ্ন

‘কামান দাগা’ নিয়েও এডিস মশা নিয়ন্ত্রণে ‘ব্যর্থ’ দুই সিটি করপোরেশন

মুসা আহমেদ
মুসা আহমেদ মুসা আহমেদ
প্রকাশিত: ০২:১৪ পিএম, ২৬ অক্টোবর ২০২২
মশক নিধনে ডিএনসিসির ক্রাশ প্রোগ্রাম/ফাইল ফটো

এক বছর চিকুনগুনিয়া তো আরেক বছর ডেঙ্গু- কোনো না কোনোভাবে মশাবাহিত রোগ ভোগায় নগরবাসীকে। চলতি বছর বৃষ্টি তুলনামূলক কম হলেও প্রায় মহামারি আকার ধারণ করেছে ডেঙ্গুজ্বর। প্রতিদিন আক্রান্ত হচ্ছে কমবেশি এক হাজার মানুষ। মৃত্যু ছাড়িয়েছে শতাধিক। যার দায় সিটি করপোরেশনের বলছেন রাজধানীবাসী। মশক নিধনে চিরুনি অভিযান, ভ্রাম্যমাণ আদালত পরিচালনা বা জেল-জরিমানা করলেও মশা নিয়ন্ত্রণে আনতে পারছে না দুই সিটি করপোরেশন।

এমন পরিস্থিতিতে ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশন (ডিএনসিসি) ও ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের (ডিএসসিসি) মশক নিধন কার্যক্রম নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে। নাগরিকদের অভিযোগ, সিটি করপোরেশনের অদক্ষতার কারণেই নগরে এডিস মশার প্রকোপ বাড়ছে। মশক নিধন নিয়ে তাদের কার্যকর কোনো কর্মপরিকল্পনা নেই। ঠিকমতো মশার ওষুধও ছিটানো হয় না। বিভিন্ন কর্মসূচির নামে কামান দাগা নিয়ে বসে থাকলেও বাস্তবে এর কোনো ফলাফল নেই।

আরও পড়ুন>> বাড়ি বাড়ি জ্বর-ডেঙ্গু

তবে ডিএনসিসি ও ডিএসসিসির দাবি, সাধারণত এডিস মশা বাসাবাড়িতে অব্যবহৃত পাত্র বা জমে থাকা বৃষ্টির পানিতে জন্মায়। সেখানে সিটি করপোরেশনের ওষুধ ছিটানোর সুযোগ থাকে না। নিজ উদ্যোগেই সবাইকে বাড়ির চারপাশ পরিষ্কার রাখতে হবে, সচেতন হতে হবে নিজেদের। কারও বাড়িতে এডিসের লার্ভা পেলে জেল-জরিমানা করা হয়। এর বাইরে ড্রেন, নালা বা অন্য কোনো স্থাপনায় মশা জন্মালে তার দায় সিটি করপোরেশনের। সে অনুযায়ী তারা কাজ করছে।

আরও পড়ুন>> এখন থেকে ডিএনসিসির কোভিড হাসপাতালে হবে ডেঙ্গু চিকিৎসা

রাজধানীর কুড়িল এলাকার বাসিন্দা আবদুল কাদের জাগো নিউজকে বলেন, আমার বাসায় পানি জমার কোনো উৎস নেই। তবু পরিবারের চারজন সদস্য ডেঙ্গু আক্রান্ত হয়েছে। দুজনকে হাসপাতালে ভর্তি করতে হয়েছে। বিগত কয়েক মাসে সিটি করপোরেশন থেকে মশার ওষুধ ছিটাতে দেখিনি। এ দায় সিটি করপোরেশন এড়াতে পারে না।

jagonews24

বনশ্রী এলাকার বাসিন্দা ইমরোজ হাসান বলেন, আমরা ট্যাক্স দেই। সিটি করপোরেশন আমাদের কী সুযোগ-সুবিধা দেয়। কোনো বছর মশাই তো নিয়ন্ত্রণে আনতে পারে না। আমাদেরও সচেতন হওয়ার প্রয়োজন আছে। কিন্তু নিয়ন্ত্রণের দায়িত্ব তো তাদেরই। তারা শুধু অভিযান চালিয়ে জরিমানা করতে পারে। মশার ওষুধ ছিটানোর সময় তাদের খুঁজে পাওয়া যায় না। প্রতিদিন মৃত্যু হচ্ছে ডেঙ্গুতে। সিটি করপোরেশন অভিযানের নামে কামান দাগা নিয়ে ভয় দেখাতে পারে, মশা নিয়ন্ত্রণে আনতে পারে না।

আরও পড়ুন>> ডেঙ্গু হলে রক্তের প্লাটিলেট বাড়াতে যেসব খাবার খাবেন

কীট বিশেষজ্ঞরা জানান, অব্যবস্থাপনা, অদক্ষতা, কর্মপরিকল্পনা না থাকাসহ নানা কারণে এডিস মশা নিয়ন্ত্রণে রাখতে পারছে না সিটি করপোরেশন। ফলে প্রতি বছর বর্ষা মৌসুমে এডিস মশার উপদ্রব বাড়ছে। হাজার হাজার মানুষ ডেঙ্গু আক্রান্ত হচ্ছে, মারা যাচ্ছে। এর থেকে মুক্তি পেতে হলে সিটি করপোরেশনকে বছরব্যাপী কার্যক্রম হাতে নিতে হবে।

স্বাস্থ্য অধিদপ্তর সূত্র জানায়, ২০১৮ সালে ঢাকায় এডিস মশার উপদ্রব বাড়ে। ওই বছর ঢাকায় রোগীর সংখ্যা ছিল ৩ হাজার ৮৭ জন। ডেঙ্গুতে মারা গিয়েছিলেন ২৬ জন। পরের বছর ২০১৯ সালে ডেঙ্গু মহামারি আকার ধারণ করে। ওই বছর মোট আক্রান্ত রোগী ছিল ৫২ হাজার ৬৩৬ জন। মারা যান ১৭৯ জন। ২০২০ সালে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আসে। তখন ডেঙ্গু আক্রান্ত হয়েছিলেন ৫৪৬ জন। মারা যান সাতজন। ২০২১ সালে ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হন মোট ৭ হাজার ৮৪১ জন। এর মধ্যে মারা যান ১০৫ জন। ২০২২ সালের ২০ অক্টোবর পর্যন্ত ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়েছেন ১০ হাজার ৮৫৩ জন। এখন পর্যন্ত মারা গেছেন ১০৬ জন। যদিও চলতি বছরের এখনো আড়াই মাস বাকি। এই সময়ে আগের অন্যান্য বছরের সব পরিসংখ্যান ছাড়িয়ে যেতে পারে ডেঙ্গু পরিস্থিতি।

আরও পড়ুন >> ডেঙ্গু থেকে বাঁচতে এ সময় যা করা জরুরি

কাজে আসছে না মশা নিধন কর্মসূচি
বর্ষা মৌসুমের আগ থেকেই ঢাকা শহরে এডিস মশার উপদ্রব বাড়তে থাকে। তখন থেকেই ডিএসসিসি ও ডিএনসিসি মশক নিধনে চিরুনি অভিযান, ভ্রাম্যমাণ আদালতের মাধ্যমে জরিমানা করা শুরু করেন। কিন্তু নগরবাসীকে ডেঙ্গুর হাত থেকে রক্ষা করতে পারেনি তারা। এর মধ্যে ডিএনসিসির কার্যক্রমগুলো দৃশ্যমান হলেও ডিএসসিসি অনেকটাই পিছিয়ে। তবে যেসব বাড়িতে ডেঙ্গুরোগী পাওয়া যাচ্ছে, ওই বাড়ির আশপাশের স্থাপনার কোথাও এডিস মশার লার্ভা আছে কি না- তা পর্যবেক্ষণ করছে তারা।

গত ১৮ অক্টোবর থেকে এডিস মশা নিধনে বিশেষ অভিযান বা ক্রাশ প্রোগ্রাম শুরু করেছে ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশন (ডিএসসিসি)। পরদিন মগবাজার থেকে আনুষ্ঠানিকভাবে এই কার্যক্রম চলছে। ২৫ অক্টোবর পর্যন্ত প্রায় প্রতিটি ওয়ার্ডে এই অভিযান চলবে। এর মধ্যে যাদের বাড়িতে বা স্থাপনায় এডিসের লার্ভা পাওয়া যাচ্ছে, তাদেরই মোটা অংকের টাকা জরিমানা বা জেল দেওয়া হচ্ছে।

jagonews24

২০ অক্টোবর এডিস মশা নিধনে তৃতীয় দিনের মতো মিরপুরের পূর্ব মনিপুরে অভিযান চালায় ডিএনসিসি। এসময় ডেঙ্গুবিরোধী অভিযানে এয়ারলাইন্স বিল্ডার্স লিমিটেডের একটি নির্মাণাধীন বাড়ির মালিককে দুই লাখ টাকা জরিমানা করেন ভ্রাম্যমাণন আদালত। এর আগের দিনও ২০টি মামলায় ছয় লাখ ৬৩ হাজার টাকা জরিমানা করে সংস্থাটি।

অন্যদিকে ডিএসসিসি ক্রাশ প্রোগ্রাম না নিলেও তারা মশক নিধনে গুরুত্ব দিয়ে নিয়মিত কাজ করছে। বিশেষ করে যেসব বাসাবাড়িতে ডেঙ্গু মশা আছে, সে বাসাগুলো এবং আশপাশের বাসাবাড়িতে অভিযান চালিয়ে মশার লার্ভা ধ্বংস করছে ডিএসসিসি।

ডিএসসিসির স্বাস্থ্য বিভাগের এক কর্মকর্তা বলেন, এডিস মশা নিধনে ডিএসসিসি মেয়র শেখ ফজলে নূর তাপসের কঠোর নির্দেশনা রয়েছে। সে অনুযায়ী কাজ করছে ডিএসসিসি। কিন্তু মশা নিয়ন্ত্রণে না আসায় সবার মধ্যেই হতাশা কাজ করছে।

জানতে চাইলে ডিএনসিসির প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা মো. সেলিম রেজা জাগো নিউজকে বলেন, জলবায়ু পরিবর্তনজনিত কারণে অক্টোবর মাসেও থেমে থেমে বৃষ্টি হচ্ছে, কিছুক্ষণ পরেই আবার রোদ হচ্ছে। এসব কারণেও ডেঙ্গু রোগের বাহক এডিস মশা বাড়ছে। এজন্য সবাইকে এডিস মশা নিধনে সচেতন হতে হবে। সিটি করপোরেশন নিয়মিত মশা নিধনে কাজ করছে। নগরবাসীকেও দায়িত্ব নিতে হবে।

তিনি আরও বলেন, যেহেতু এডিস মশা বাড়ির আঙিনায় জন্মায়, তাই কারও বাড়িতে এডিসের লার্ভা পেলে আইনানুগ ব্যবস্থা নেওয়া হবে। জনগণের সহযোগিতা পেলে ডেঙ্গু সম্পূর্ণ নিয়ন্ত্রণে রাখা সম্ভব।

কীটতত্ত্ববিদ ও জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক কবিরুল বাশার জাগো নিউজকে বলেন, ঢাকার দুই সিটি করপোরেশন যে পদ্ধতিতে মশা নিয়ন্ত্রণ করছে, এভাবে কখনোই মশা নিয়ন্ত্রণে আসবে না। মশা নিয়ন্ত্রণে প্রথমত চারপাশের পরিবেশ পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন রাখতে হবে। পাশাপাশি ঢাকার প্রতিটি ওয়ার্ডে যেখানে মশা বেশি, কোন ধরনের মশার উপদ্রব বেশি এবং এ মশার জন্য কোন ওষুধ কতটুকু ছিটাতে হবে তা নির্ণয় করে ওই জায়গায় ওষুধ প্রয়োগ করতে হবে। তা হলে মশার প্রজনন কম হবে। এ পরিকল্পনাগুলো বছরের শুরু থেকেই কার্যকর করলে মশা নিয়ে আর কারও কথা থাকবে না।

বৃহস্পতিবার (২০ অক্টোবর) ঢাকার শিশু হাসপাতালে দেশের ডেঙ্গু পরিস্থিতি নিয়ে সাংবাদিকদদের সঙ্গে কথা বলেন স্বাস্থ্য ও পরিবারকল্যাণ মন্ত্রী জাহিদ মালেক। তিনি মশা মারার কাজ স্বাস্থ্যখাতের নয় জানিয়ে বলেন, সিটি করপোরেশন ও পৌরসভার প্রতিনিধিদের তাগিদ দেওয়া হয়েছে। তবে ডেঙ্গুরোগী আরও বাড়লে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় তার চিকিৎসা দিতে যথেষ্ট প্রস্তুতি নিয়ে রেখেছে। ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশন হাসপাতাল, বিএসএমএমইউ’র নতুন হাসপাতাল ইউনিট এবং লালকুঠি হাসপাতাল প্রস্তুত রাখা হয়েছে।

এমএমএ/এএসএ/এমএস

টাইমলাইন  

পাঠকপ্রিয় অনলাইন নিউজ পোর্টাল জাগোনিউজ২৪.কমে লিখতে পারেন আপনিও। লেখার বিষয় ফিচার, ভ্রমণ, লাইফস্টাইল, ক্যারিয়ার, তথ্যপ্রযুক্তি, কৃষি ও প্রকৃতি। আজই আপনার লেখাটি পাঠিয়ে দিন [email protected] ঠিকানায়।