অশ্লীলতা ছড়িয়ে ১০৮ কোটি টাকা হাতিয়েছে বিগো, পাচার ৭৯ কোটি

নিজস্ব প্রতিবেদক
নিজস্ব প্রতিবেদক নিজস্ব প্রতিবেদক
প্রকাশিত: ০৪:৩৪ পিএম, ০৫ অক্টোবর ২০২২
ছবি: সংগৃহীত

চীনভিত্তিক ভিডিও শেয়ারিং অ্যাপ বিগো টেকনোলজি লিমিটেড। বিগো বাংলা লিমিটেড নামে বাংলাদেশেও এ অ্যাপটি কার্যক্রম শুরু করে। সফটওয়্যার ডেভেলপমেন্ট প্রতিষ্ঠান হিসেবে ঘোষণা দিয়ে যাত্রা শুরু করলেও মূলত লাইভ চ্যাট ও ভিডিও চ্যাটভিত্তিক কার্যক্রম চালায় বিগো। অশ্লীলতা ছড়িয়ে এ প্রতিষ্ঠানটি বাংলাদেশি ব্যবহারকারীদের কাছ থেকে দেড় বছরে প্রতারণার মাধ্যমে ১০৮ কোটি টাকা হাতিয়ে নিয়েছে। এরমধ্যে ৭৯ কোটি টাকা সিঙ্গাপুরে পাচার করেছে বিগো।

পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগের (সিআইডি) অনুসন্ধানে এমন তথ্য উঠে এসেছে। পল্টন থানায় ডিজিটাল নিরাপত্তা ও পর্নোগ্রাফি নিয়ন্ত্রণ আইনে করা একটি মামলার তদন্তে নেমে এমন চাঞ্চল্যকর তথ্যপ্রমাণ পায় সিআইডি। এরপর বিগো টেকনোলজির ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) চীনা নাগরিক ইয়াও জিসহ পাঁচজনের বিরুদ্ধে মানিলন্ডারিং আইনে আরেকটি মামলা করেছে সিআইডি।

এ মামলার অন্য আসামিরা হলেন- বিগো বাংলা লিমিটেড, বিগো বাংলার কর্মী এস এম নাজমুল হক, আরিফ হোসেন, মুনসুন হোল্ডিং নামের প্রতিষ্ঠান।

সিআইডির করা দ্বিতীয় মামলায় চীন নাগরিক ও বিগোর এমডি ইয়াও জির বিরুদ্ধে ৭৯ কোটি টাকা বাংলাদেশ থেকে বিদেশে পাচারের অভিযোগ করা হয়েছে।

সিআইডি বলছে, পাচারের উদ্দেশ্যে এ অর্থ সংগ্রহে বিগো টেকনোলজিকে সহযোগিতা করেছে মুনসুন হোল্ডিং লিমিটেড। মূলত মুনসুন হোল্ডিংয়ের নামে নেওয়া পেমেন্ট গেটওয়ে ‘সূর্য পে’র সাহায্য নিয়ে বিপুল এ অর্থ আত্মসাৎ করে বিগো টেকনোলজি।

জানা গেছে, বিগো অ্যাপে লাইভ ভিডিওর মাধ্যমে অশ্লীলতা ছড়ানোর অভিযোগে গত বছরের জুনে চীনা নাগরিক ইয়াও জিসহ পাঁচজনকে গ্রেফতার করে সিআইডি। পরে তাদের বিরুদ্ধে পল্টন থানায় ডিজিটাল নিরাপত্তা ও পর্নোগ্রাফি নিয়ন্ত্রণ আইনে মামলা হয়।

jagonews24

ওই মামলার অন্য চার আসামি হলেন- বিগো বাংলার কর্মী মোস্তাফা সাইফ রেজা, আরিফ হোসেন, এস এম নাজমুল হক ও আসমা উল হুসনা সেজুতী। তারা সবাই এখন কারাগারে

এ মামলার তদন্তসংশ্লিষ্টরা জানান, সফটওয়্যার ডেভেলপমেন্ট প্রতিষ্ঠান হিসেবে ঘোষণা দিলেও বিগো লাইভ মূলত লাইভ চ্যাট ও ভিডিও চ্যাটভিত্তিক কার্যক্রম পরিচালনা শুরু করে। কিছুদিন পরই প্রতিষ্ঠানটি ভার্চুয়াল ডায়মন্ড ও বিনস বিক্রির মাধ্যমে ব্যবহারকারীদের অর্থ হাতিয়ে নিতে শুরু করে। এরপর শুরু হয় বিগো ও লাইকির অ্যাপ ব্যবহারকারীদের কাছ থেকে অর্থ আত্মসাৎ। এক্ষেত্রে এমএফএস, ব্যাংক অ্যাকাউন্ট ব্যবহারের পর সবশেষে সূর্য পে নামের পেমেন্ট গেটওয়ে সার্ভিস ব্যবহার করা হয়। সব মিলিয়ে দেড় বছরে তারা হাতিয়ে নেয় ১০৮ কোটি টাকা।

রাজধানীর পল্টন থানার পর্নোগ্রাফি নিয়ন্ত্রণ আইনের একটি মামলার তদন্তে নেমে অর্থ আত্মসাৎ ও পরবর্তীসময়ে সেই অর্থ সিঙ্গাপুরে সরিয়ে নেওয়ার তথ্য পায় পুলিশ।

পরে মামলাটি তদন্ত শুরু করে সিআইডির সাইবার পুলিশ সেন্টার। দীর্ঘ তদন্ত শেষে পরিকল্পিতভাবে অর্থ আত্মসাৎ ও পাচারের অভিযোগে মানিলন্ডারিং প্রতিরোধ আইনে মামলা করেন তদন্ত কর্মকর্তা উপ-পুলিশ পরিদর্শক (এসআই) সোহেল রানা।

মামলার এজাহারে বলা হয়েছে, ২০১৯ সালের জানুয়ারি থেকে ২০২১ সালের জুলাই পর্যন্ত ভার্চুয়াল ডায়মন্ড ও বিনস বিক্রির বিপরীতে অ্যাপটির বাংলাদেশি ব্যবহারকারীদের কাছ থেকে এক কোটি ২৬ লাখ ৮০ হাজার ৮০৬ টাকা আয় করে বিগো লাইভ টেকনোলজি। এ অর্থ জমা হয় একটি বেসরকারি ব্যাংকের গাজীপুর শাখার হিসাব নম্বরে, যা বর্তমানে আদালতের নির্দেশে ফ্রিজ করে রাখা হয়েছে।

ওই ব্যাংক হিসাবে স্থিতি রয়েছে এক লাখ ৩৪ হাজার ৪৭০ টাকা। বাকি এক কোটি ২৫ লাখ ৪৬ হাজার ৩৩৬ টাকা বিনস রিসেলার নাজমুল হক দেন চীনা নাগরিক ইয়াও জিকে। একই সময়ের মধ্যে আরও দুটি বেসরকারি ব্যাংকের হিসাবের মাধ্যমে বিগো বাংলা লিমিটেড ৪৩ কোটি ৫০ লাখ ৫০ হাজার ৭৬ টাকা সংগ্রহ করে।

এছাড়া ডায়মন্ড ও বিনস রিসেলার এস এম নাজমুল হকের ১২টি ব্যাংক হিসাবের মাধ্যমে ৪৭ কোটি ৮ লাখ ১০ হাজার ৮১২ টাকা সংগ্রহ করে বিগো বাংলা লিমিটেড।

প্রতিষ্ঠানটিকে ‘সূর্য পে’ তাদের গেটওয়ে সেবা সরবরাহ করেছে বলে মামলার এজাহারে উল্লেখ করেন তদন্ত কর্মকর্তা এসআই সোহেল রানা।

তিনি বলেন, ব্যাংক হিসাবের মাধ্যমে অর্থ সংগ্রহের ক্ষেত্রে পেমেন্ট গেটওয়ে সুবিধাও নেয় বিগো বাংলা লিমিটেড। এক্ষেত্রে তাদের সূর্য পে নামের সূর্যমুখী লিমিটেডের পেমেন্ট গেটওয়ে পাইয়ে দেয় দেশি প্রতিষ্ঠান মুনসুন হোল্ডিং লিমিটেড। তারা মূলত নিজেদের নামে পেমেন্ট গেটওয়ে সার্ভিস নিয়ে সেটি বিগো বাংলা লিমিটেডকে ব্যবহারের সুযোগ করে দেয়। পেমেন্ট গেটওয়ে ব্যবহারের সুযোগ করে দেওয়ার মাধ্যমে অর্থ আত্মসাৎ ও পাচারে সহযোগী হয়ে উঠেছে মুনসুন হোল্ডিং লিমিটেড।

বিগোর বিবৃতি
এদিকে এসব অভিযোগ নিয়ে বিবৃতি দিয়েছে বিগো টেকনোলজি লিমিটেড (বিগো)। এতে বলা হয়েছে, প্রতিষ্ঠান সম্পর্কিত অভিযোগ নিয়ে সম্প্রতি গণমাধ্যমে প্রকাশিত সংবাদ আমাদের নজরে এসেছে। প্রাথমিক তদন্ত প্রতিবেদনে যে অভিযোগ উঠেছে তা আমাদের বিস্মিত করেছে। বিগোর বৈশ্বিক নীতি অনুযায়ী আমরা কঠোরভাবে ও দৃঢ়তার সঙ্গে স্থানীয় আইন মেনে ব্যবসায়িক কার্যক্রম পরিচালনা করি। এছাড়া বিগো অপরাধ ও প্রতারণা সংশ্লিষ্ট সব কার্যক্রমের বিরুদ্ধে কঠোরভাবে শূন্য সহনশীলতা নীতি মেনে চলে। পাশাপাশি বাংলাদেশের আইন ও বিধির ওপর আমাদের পূর্ণ আস্থা আছে এবং প্রাসঙ্গিক সব আইনি কর্তৃপক্ষকে আমরা সর্বাত্মকভাবে সহযোগিতা প্রদান করা অব্যাহত রাখবো।

বিবৃতিতে দাবি করা হয়েছে, স্থানীয় আইন মেনে চলে ব্যবসায়িক কার্যক্রম পরিচালনা করার বৈশ্বিক নীতি অনুসরণ করে বিগো। সবাই যেন সুরক্ষিতভাবে ও নিরাপদ উপায়ে সারাবিশ্বের সঙ্গে কানেক্টেড থেকে তাদের সুন্দর মুহূর্তগুলো একে অন্যের সঙ্গে শেয়ার করতে পারেন, তা নিশ্চিতে আমরা নিরলস কাজ করে যাচ্ছি। কনটেন্ট ম্যানেজমেন্টের ক্ষেত্রে নিরাপদ কমিউনিটি নিশ্চিতে বিগোর দক্ষ ও কার্যকর কনটেন্ট মডারেশন মেকানিজম রয়েছে। এ ব্যাপারে আমাদের নির্দিষ্ট কমিউনিটি গাইডলাইন রয়েছে, যা আমরা কঠোরভাবে মেনে চলি। পাশাপাশি আমরা স্বয়ংক্রিয় প্রযুক্তি ব্যবহার করি। অশ্লীলতাসহ অপ্রাসঙ্গিক কনটেন্ট মডারেশনে আমাদের বাংলাদেশের কর্মীসহ দক্ষ টিম রয়েছে। আইনসম্মত চুক্তির মাধ্যমে বিগো সব অংশীদারের সঙ্গে চুক্তি সম্পন্ন করে। এক্ষেত্রে সব অংশীদারের ক্ষেত্রে চুক্তির মাধ্যমে প্রাসঙ্গিক আইন ও বিধি মেনে চলার বাধ্যবাধকতা নিশ্চিত করা হয়। বাংলাদেশে সবার জন্য নিরাপদ পরিবেশ নিশ্চিতে যে কোনো অবৈধ কার্যক্রমের বিরুদ্ধে পদক্ষেপ গ্রহণে স্থানীয় কর্তৃপক্ষের সঙ্গে আমরা ঘনিষ্ঠভাবে কাজ করে যাবো। পাশাপাশি আমাদের নীতিমালা অনুযায়ী কার্যক্রম পরিচালনা করা হচ্ছে, তা নিশ্চিতে আমরা আমাদের অভ্যন্তরীণ তদন্ত পরিচালনা করবো।

টিটি/এএএইচ/জিকেএস

পাঠকপ্রিয় অনলাইন নিউজ পোর্টাল জাগোনিউজ২৪.কমে লিখতে পারেন আপনিও। লেখার বিষয় ফিচার, ভ্রমণ, লাইফস্টাইল, ক্যারিয়ার, তথ্যপ্রযুক্তি, কৃষি ও প্রকৃতি। আজই আপনার লেখাটি পাঠিয়ে দিন [email protected] ঠিকানায়।