বিমানবন্দর-তেজগাঁও রেলস্টেশন
বিশ্রামাগারে আসন সংকট-দুর্গন্ধ, প্ল্যাটফর্ম নোংরা
প্ল্যাটফর্মে যাত্রীদের ভিড়। ট্রেনের অপেক্ষায় সবাই। কেউ ব্যাগ হাতে দাঁড়িয়ে আছেন, কেউ বসে আছেন প্ল্যাটফর্মের নোংরা মেঝেতে। তীব্র তাপে ঘাম ঝরছে সবার শরীর থেকে। বসার জন্য সেখানে নেই পর্যাপ্ত ব্যবস্থা। শোভন ও প্রথম শ্রেণির যাত্রীদের জন্য দুটি কক্ষ থাকলেও সেগুলো দুর্গন্ধ, ময়লা-আবর্জনায় ভরা। ভিআইপি বিশ্রামাগারটি বন্ধ। নেই বিশুদ্ধ পানির ব্যবস্থা। অপেক্ষমাণ যাত্রীরা এই পরিবেশে মানিয়ে নিতে রীতিমতো গলদঘর্ম।
রাজধানীর বিমানবন্দর রেলওয়ে স্টেশনের চিত্র এটি। তেজগাঁও রেলস্টেশনের অবস্থা আরও করুণ। সরেজমিনে এই দুটি স্টেশনের তুলনায় কমলাপুর ও ঢাকা ক্যান্টনমেন্ট রেলস্টেশনের পরিবেশ বা যাত্রী সুবিধা অনেকটাই ভালো দেখা যায়।
বিমানবন্দর ও তেজগাঁও রেলস্টেশন ব্যবহার করা যাত্রীদের অভিযোগ, প্রতিদিন এই দুটি রেলস্টেশন দিয়ে অসংখ্য যাত্রী দেশের বিভিন্ন প্রান্তে আসা-যাওয়া করেন। কিন্তু স্টেশন দুটিতে যাত্রীসেবা নেই বললেই চলে। প্ল্যাটফর্মের সীমানায় অসংখ্য ভাসমান লোকজনের বাস। রয়েছে হকারদের আনাগোনা। এর মধ্যে সবচেয়ে নাজুক তেজগাঁও রেলস্টেশনের পরিবেশ।
বিমানবন্দর-তেজগাঁও রেলস্টেশনের প্ল্যাটফর্মে অসংখ্য ভাসমান মানুষের বাস
বাংলাদেশ রেলওয়ের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা বলছেন, রেলস্টেশনগুলোতে যাত্রীসেবা বাড়াতে তারা আন্তরিক। এরই মধ্যে দেশের বিভিন্ন রেলস্টেশনের অবকাঠামো উন্নয়ন করা হয়েছে। বিমানবন্দর এবং তেজগাঁও রেলস্টেশনের অবকাঠামোও উন্নয়ন করা হবে।
বিমানবন্দর রেলস্টেশন
শুক্রবার (৯ সেপ্টেম্বর) সকাল ১০টায় গিয়ে দেখা যায়, প্রধান ফটকের সামনে রিকশা, সিএনজিচালিত অটোরিকশা, পিকআপসহ হকারদের ভিড়। ভেতরে ঢুকতেই চোখ পড়ে টিকিট কাউন্টারে। লাইনে দাঁড়িয়ে টিকিট কাটছেন যাত্রীরা। সেখানে পর্যাপ্ত আলো-বাতাস নেই। মাথার ওপরে বৈদ্যুতিক পাখাগুলোও ঘোরে না। প্ল্যাটফর্মে ঢুকতেই দেখা যায়, দেশের বিভিন্ন গন্তব্যের হাজারো যাত্রীর ভিড়। তাদের বিশ্রামের জন্য রয়েছে মাত্র দুটি বিশ্রামাগার। এর মধ্যে একটি শোভন শ্রেণির, আরেকটি প্রথম শ্রেণির যাত্রীদের।
আরও পড়ুন: ট্রেনের টিকিটের ‘চাহিদা বাড়লে বাড়তি দাম’ চায় রেলওয়ে
শোভন শ্রেণির বিশ্রামাগারে স্টিলের কাঠামোর আটটি বড় চেয়ার রয়েছে। এর মধ্যেই গাদাগাদি করে বসে আছেন যাত্রীরা। ভেতরে নারী-পুরুষের জন্য রয়েছে দুটি টয়লেট। এসব টয়লেটের দুর্গন্ধ ছড়িয়ে পড়েছে পুরো রুমে। যাত্রীদের পানি পানের জন্য কোনো ব্যবস্থা রাখা হয়নি সেখানে। এই কক্ষটির দক্ষিণ পাশেই প্রথম শ্রেণির যাত্রীদের বিশ্রামাগার। এখানে ছয়টি সোফায় ১৬ জন যাত্রী বসে আছেন। দুটি এসি থাকলেও সেগুলো অকেজো। ব্রেস্ট ফিডিং (মাতৃদুগ্ধ পান) কর্নার থাকলেও ভেতরে ফ্যান নেই। পুরো বিশ্রামাগারের ফ্লোরে ময়লা-আবর্জনা ছড়িয়ে আছে। দেওয়ালে পানের পিক।
বিশ্রামাগারের টয়লেট ব্যবহারের উপযোগী নয়
প্রথম শ্রেণির বিশ্রামাগারে জামালপুরগামী ট্রেনের জন্য অপেক্ষা করছিলেন আলাউদ্দিন মিয়াজি। তিনি জানান, ট্রেন আসার নির্ধারিত সময়ের ৪৫ মিনিট আগে তিনি স্টেশনে এসেছেন। প্ল্যাটফর্মে বসার জায়গা নেই। গরমও খুব বেশি। তাই বিশ্রামাগারে বসে অপেক্ষা করছেন।
জাগো নিউজকে আলাউদ্দিন বলেন, এই বিশ্রামাগারে বসে টয়লেটের দুর্গন্ধে দম বন্ধ হয়ে যাওয়ার মতো অবস্থা। হাজারো যাত্রীর জন্য মাত্র দুটি টয়লেট। আবার টয়লেটগুলো রুমের ভেতর হওয়ায় দুর্গন্ধ বাইরে যেতে পারে না। খুব বেশি জরুরি না হলে এই বিশ্রামাগারগুলো যাত্রীরা ব্যবহার করেন না।
বিমানবন্দরে স্টেশনমাস্টারের রুমের পাশে ভিআইপি বিশ্রামাগার। সেখানে গিয়ে দেখা যায়, সেটি তালা লাগানো। দরজার সামনে ফ্লোরে বসে আছেন দুই যাত্রী। বসার জায়গা নেই। বিশুদ্ধ পানি পানের কোনো ব্যবস্থাও দেখা যায়নি এই প্ল্যাটফর্মে।
পরিবারের চার সদস্যসহ প্ল্যাটফর্মে দাঁড়িয়ে ট্রেনের জন্য অপেক্ষা করছিলেন ময়মনসিংহের আবুল কালাম। আলাপকালে তিনি বলেন, দিন যত যাচ্ছে, রেলওয়ের সেবার মান ততই কমছে। অথচ রেলের উন্নয়নের নামে হাজার হাজার কোটি টাকা ব্যয় করছে সরকার।
তিনি বলেন, বিমানবন্দর রেলস্টেশনটি অনেক গুরুত্বপূর্ণ। প্রতিদিন হাজার হাজার যাত্রী এই স্টেশনের প্ল্যাটফর্ম ব্যবহার করেন। অথচ এখানে দাঁড়ানোর পরিবেশও নেই। যাত্রীসেবার দিকে রেলওয়ে কর্তৃপক্ষেরও কোনো গুরুত্ব নেই।
প্লাটফর্মে হকারদের আনাগোনা লেগেই থাকে
আরও পড়ুন: দেশের ৮২ শতাংশ রেলক্রসিং অরক্ষিত, দায় আছে নাগরিকেরও
দিনে ৫৪ জোড়া ট্রেনের যাত্রী এই প্ল্যাটফর্ম ব্যবহার করেন জানিয়ে বিমানবন্দর স্টেশনমাস্টার মো. হালিমুজ্জামান জাগো নিউজকে বলেন, যাত্রীচাহিদা অনুযায়ী সুযোগ-সুবিধা কম, এটা সত্য। তবে প্ল্যাটফর্মে বসার পর্যাপ্ত জায়গা আছে। সমস্যা হয়ে যায় যখন কাছাকাছি সময়ে দুটি ট্রেন প্ল্যাটফর্মে আসে। বিমানবন্দর রেলস্টেশনের অবকাঠামো উন্নয়নে প্রস্তাব দেওয়া আছে। এই স্টেশনের সামনে ডাবল লাইন হবে। তারপর প্ল্যাটফর্মের উন্নয়ন কাজ শুরু হবে।
তেজগাঁও রেলস্টেশন
তেজগাঁও রেলক্রসিং বা ফার্মগেট চৌরাস্তা থেকে তেজগাঁও রেলস্টেশনে যেতে হয়। সরেজমিনে দেখা যায়, তেজগাঁও রেলক্রসিং এলাকা থেকে সরু একটা রাস্তা দিয়ে ৩০০ মিটার এগোলে উত্তর দিকে তেজগাঁও রেলস্টেশন। স্টেশনের সামনে কলার আড়ত। এই আড়তের বর্জ্য রাস্তায় স্তূপ হয়ে আছে। কাদা-পানিতে স্টেশনে ঢোকা দায়। প্রধান ফটকের সামনে ভাসমান লোকজন শুয়ে-বসে আছে। প্ল্যাটফর্মে বসার কোনো জায়গা বা বিশ্রামাগার নেই। প্ল্যাটফর্মে দাঁড়িয়ে ট্রেনের জন্য অপেক্ষা করছেন যাত্রীরা।
ক্যান্টনমেন্ট স্টেশনের পরিবেশ অন্যগুলোর চেয়ে তুলনামূলক ভালো
নরসিংদীগামী যাত্রী ইরফান হোসেন বলেন, এই স্টেশনে বিভিন্ন গন্তব্যের লোকাল ট্রেন থামে, প্রচুর যাত্রীচাহিদা রয়েছে। কিন্তু প্ল্যাটফর্মে যাত্রীসেবার কিছুই নেই।
এ বিষয়ে তেজগাঁও রেলস্টেশনের ম্যানেজার শফিকুল ইসলাম জাগো নিউজকে বলেন, এই স্টেশনের পেছন দিয়ে এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ের কাজ চলছে। এই কাজ শুরু হওয়ার পর থেকে স্টেশনের পরিবেশ নোংরা হতে থাকে। এখন স্টেশনের অবকাঠামো উন্নয়নে প্রকল্প নেওয়া আছে। এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ের কাজ শেষ হলে রেলস্টেশনের কাজ শুরু হবে।
ক্যান্টনমেন্ট-কমলাপুর রেলস্টেশন
কমলাপুর রেলস্টেশন থেকেই দেশের সব গন্তব্যে ছেড়ে যায় ট্রেনগুলো। তবে এই স্টেশনে অনেকগুলো প্ল্যাটফর্ম থাকায় যাত্রীচাপ তেমন দেখা যায় না। স্টেশনে বিশ্রামাগারসহ টয়লেট, নামাজের জায়গা, বিশুদ্ধ পানির ব্যবস্থা রয়েছে। সেখানকার প্ল্যাটফর্ম নিয়ে যাত্রীদের তেমন অভিযোগ নেই। তবে ভাসমান লোকজনকে স্টেশনের বাইরে রাখার দাবি জানিয়েছেন যাত্রীরা।
আরও পড়ুন: বাংলাদেশকে ২০ ব্রডগেজ ডিজেল লোকোমোটিভ দেবে ভারত
এদিকে ঢাকা-ক্যান্টনমেন্ট রেলস্টেশনে সব ধরনের সেবার ব্যবস্থা রয়েছে। সব ট্রেন এখানে না থামায় যাত্রীদের তেমন চাপও থাকে না। কমসংখ্যক যাত্রী ওঠা-নামা করায় কোনো বিশৃঙ্খলা হয় না এই স্টেশনে। পরিপাটি স্টেশনটিতে ভাসমান লোকজনও নেই।
প্রতিদিন অসংখ্য মানুষ যাতায়াত করেন এসব স্টেশন দিয়ে
ক্যান্টনমেন্ট রেলস্টেশনের মাস্টার লিটন দাস জাগো নিউজকে বলেন, ঢাকার অধিকাংশ যাত্রী কমলাপুর বা বিমানবন্দর রেলস্টেশন ব্যবহার করেন। এ কারণে এই স্টেশনে যাত্রীচাপ থাকে না। তবে স্টেশনে যাত্রীদের সেবায় সব ব্যবস্থা রয়েছে।
বিমানবন্দর ও তেজগাঁও রেলস্টেশনসহ ঢাকার অন্যান্য স্টেশনে যাত্রীসেবার মান বাড়াতে কী কী উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে জানতে চাইলে রেলমন্ত্রী নূরুল ইসলাম সুজন জাগো নিউজকে বলেন, আগের তুলনায় রেলে যাত্রীচাহিদা বাড়ছে। সে অনুযায়ী দেশের গুরুত্বপূর্ণ সব রেলস্টেশনের অবকাঠামো উন্নয়ন করা হচ্ছে। এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ের কাজ শেষ হলে বিমানবন্দর ও তেজগাঁও রেলস্টেশনের অবকাঠামো উন্নয়ন শুরু হবে। তার আগে কমলাপুর থেকে জয়দেবপুর পর্যন্ত রেললাইন ডাবল করা হবে। এই কাজটি অনেক আগেই শুরু হয়েছে।
এমএমএ/ইএ/এএসএ/জিকেএস