বেটিং সাইট ও পিএসজি ফুটবল অ্যাপসে জুয়ার মাধ্যমে টাকা পাচার
অনলাইনে জুয়া ও অবৈধ মাল্টিলেভেল মার্কেটিং কার্যক্রম পরিচালনার মাধ্যমে তিন কোটি টাকা আত্মসাতের পর বিদেশে পাচারকারী চক্রের তিনজনকে গ্রেফতার করেছে ঢাকা মেট্রোপলিটন গোয়েন্দা পুলিশের (ডিবি) সাইবার অ্যান্ড স্পেশাল ক্রাইম (উত্তর) বিভাগ।
ডিবি জানায়, অনলাইনে পিএসজি সাইট ও পিএসজি ফুটবল নামের একটি মোবাইল অ্যাপসের মাধ্যমে জুয়া ও অবৈধ মাল্টিলেভেল মার্কেটিং কার্যক্রম পরিচালনা করছিল চক্রটি। সুপার অ্যাডমিন ফ্রান্স থেকে ওয়েবসাইট ও অ্যাপস নিয়ন্ত্রণ করেন। বিভিন্ন দেশে দেখভালের জন্য বেশকিছু ম্যানেজার নিয়োগ করা আছে।
জানা যায়, চক্রটি নতুন অ্যাকাউন্ট খুলে দেওয়ার জন্য রেফারেলকারীকে আকর্ষণীয় বোনাস অফার করে থাকে। ৩০টি অ্যাকাউন্টের জন্য প্রতিমাসে ৩ হাজার ৬০০ টাকা, ৫০টির জন্য মাসে সাড়ে ৭ হাজার, ১০০টির জন্য মাসে ১৮ হাজার টাকা। এভাবে ৮০০টি অ্যাকাউন্টের জন্য মাসে ২ লাখ টাকা পর্যন্ত মাসিক আয়ের অফার করে। এক বছরে তিন কোটি টাকা আত্মসাৎ করেছে চক্রটি।
এছাড়া তিনদিনের জন্য বিনিয়োগে ২ দশমিক ৭ শতাংশ, সাতদিনের জন্য বিনিয়োগে ২ দশমিক ৮ শতাংশ, ১৫ দিনের জন্য বিনিয়োগে ২ দশমিক ৯ শতাংশ, ২৮ দিনের জন্য বিনিয়োগে ৩ শতাংশ, ৪৫ দিনের জন্য বিনিয়োগে ৩ দশমিক ১ শতাংশ দৈনিক মুনাফার প্রতিশ্রুতি দেওয়া হয়। গ্রাহক বা ইউজার বেশি মুনাফায় আকৃষ্ট হয়ে বিনিয়োগ করে।
সুনির্দিষ্ট অভিযোগ ও তথ্য-প্রমাণের ভিত্তিতে চক্রটির তিন সদস্যকে গ্রেফতারের পর এ তথ্য জানিয়েছে ডিবি সাইবার অ্যান্ড স্পেশাল ক্রাইম (উত্তর) বিভাগ।
গ্রেফতাররা হলেন- সাদ্দাম হোসেন মিজি (৩৬), সহিদুল ইসলাম আলমগীর (৩৭) ও আলমগীর খান (৩৫)। গ্রেফতারকালে তাদের কাছ থেকে অনলাইনে জুয়া ও অবৈধ মাল্টিলেভেল মার্কেটিং কার্যক্রম পরিচালনার কাজে ব্যবহৃত ৫টি মোবাইল ফোন ও ৭টি সিম কার্ড জব্দ করা হয়।
রোববার (১১ সেপ্টেম্বর) বিকেলে জাগো নিউজকে এসব তথ্য জানান অর্গানাইড ক্রাইম ইনভেস্টিগেশন টিমের টিম লিডার অতিরিক্ত উপ-পুলিশ কমিশনার (এডিসি) মো. নাজমুল হক।
তিনি বলেন, নিয়মিত সাইবার পেট্রোলিং ও অনলাইনে নজরদারির মাধ্যমে অনলাইনে জুয়া ও অবৈধ মাল্টিলেভেল মার্কেটিং কার্যক্রম পরিচালনার মাধ্যমে সাধারণ মানুষের সরলতাকে পুঁজি করে বেশি মুনাফার প্রলোভন দেখিয়ে কোটি কোটি টাকা আত্মসাৎকারী চক্রের তিন সাইবার অপরাধীকে রাজধানীর খিলক্ষেত থানা এলাকা থেকে গ্রেফতার করা হয়।
অনলাইনে পিএসজি সাইট ও পিএসজি ফুটবল নামের একটি মোবাইল অ্যাপসের মাধ্যমে অনলাইনে জুয়া ও অবৈধ মাল্টিলেভেল মার্কেটিং কার্যক্রম পরিচালনা করছিল চক্রটি। সুপার এডমিন ফ্রান্স থেকে ওয়েবসাইট ও অ্যাপস নিয়ন্ত্রণ করে। বিভিন্ন দেশে দেখভালের জন্য বেশকিছু ম্যানেজার নিয়োগ করা আছে।
এডিসি নাজমুল হক আরও বলেন, ম্যানেজাররা নির্দিষ্ট এলাকা টার্গেট করে এজেন্টকে অধিক কমিশনের প্রলোভন দেখিয়ে আকৃষ্ট করে। এজেন্টরা মূলত ইউজার সংগ্রহে সহায়তা ও বিভিন্ন সমস্যা হলে সরাসরি ম্যানেজারের সঙ্গে যোগাযোগ করে সমাধানের কাজ করে। এজেন্ট সদস্য সংগ্রহ করে তাদের প্রত্যেকের কাছ থেকে পিরামিড সিস্টেমে কমিশন পেয়ে থাকে।
জানা যায়, এজেন্টরা প্রথম স্তরের রেফারেল কমিশন ১০ শতাংশ এবং দ্বিতীয় স্তরের রেফারেল কমিশন ৪ শতাংশ এবং তৃতীয় স্তরের রেফারেল সদস্যদের কাজ থেকে ২ শতাংশ কমিশন পেয়ে থাকেন।
একজন নতুন গ্রাহকের অ্যাকাউন্ট খুলতে ৩ হাজার ২০০ টাকা নিয়ে থাকে। নতুন গ্রাহক অ্যাকাউন্ট খোলার পর তাকে বিভিন্ন মেয়াদে ডিপোজিট বা বিনিয়োগের প্রস্তাব দেওয়া হয়।
ডাউনলাইন গ্রাহক প্রথম ডিপোজিট তিন হাজার টাকা করলে আপলাইন গ্রাহক কমিশন হিসেবে ২০০ টাকা, প্রথম রিচার্জ আট হাজার টাকা হলে আপলাইন গ্রাহক কমিশন হিসেবে ৬৪০ টাকা, প্রথম রিচার্জ ১৫ হাজার টাকা হলে আপলাইন গ্রাহক কমিশন হিসেবে ১২০০ টাকা, প্রথম রিচার্জ ৫০ হাজার টাকা হলে আপলাইন গ্রাহক কমিশন হিসেবে চার হাজার টাকা, প্রথম রিচার্জ এক লাখ টাকা হলে আপলাইন গ্রাহক কমিশন হিসেবে ৮ হাজার ৭৭৭ টাকা কমিশনের অফার করে থাকে। এছাড়াও নতুন অ্যাকাউন্ট খুলে দেওয়ার জন্য রেফারেলকারীকে আকর্ষণীয় বোনাস অফার করে থাকে।
৩০টি অ্যাকাউন্টের জন্য প্রতি মাসে ৩ হাজার ৬০০ টাকা, ৫০টি অ্যাকাউন্টের জন্য প্রতিমাসে ৭ হাজার ৫০০ টাকা, ১০০টি অ্যাকাউন্টের জন্য প্রতি মাসে ১৮ হাজার টাকা, ৩০০টি অ্যাকাউন্টের জন্য প্রতিমাসে ৫৪ হাজার টাকা, ৫০০টি অ্যাকাউন্টের জন্য প্রতিমাসে এক লাখ টাকা ও ৮০০টি অ্যাকাউন্টের জন্য প্রতিমাসে দুই লাখ টাকা মাসিক আয়ের অফার করে থাকে।
গ্রেফতারদের প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদে ডিবির এ কর্মকর্তা বলেন, গ্রেফতাররা অভ্যন্তরীণ কথাবার্তা ও যোগাযোগের জন্য সাদ্দাম হোসেন মিজি নামের প্রাইভেট টেলিগ্রাম গ্রুপ ব্যবহার করতো।
গ্রেফতার সাদ্দাম হোসেন মিজি সাইট ও পিএসজি ফুটবলের একজন এজেন্ট এবং সহিদুল ইসলাম আলমগীর ও আলমগীর খান তার সহযোগী হিসেবে কাজ করতো। সাদ্দাম হোসেন মিজি বিভিন্ন এলাকায থেকে ইউজার সংগ্রহ করে পিএসজি সাইট ও পিএসজি ফুটবল নামের মোবাইল অ্যাপসের অ্যাকাউন্ট তৈরি ও তাতে ডিপোজিট করতে সহায়তা করতো। বিনিময়ে তিনি মোটা অংকের একটি কমিশন পেতেন। ডিপোজিটের টাকা ডিজিটাল হুন্ডির সহায়তায় দেশের বাইরে পাচার হয়ে যেতো। যার প্রভাব পড়ে দেশের সামগ্রিক রেমিটেন্স খাতের ওপর।
গ্রেফতারদের নিবন্ধিত অ্যাকাউন্টের তথ্য পর্যালোচনা করে প্রায় ৩ কোটি টাকা লেনদেনের তথ্য পাওয়া যায়। লেনদেনকৃত টাকা বিভিন্ন মাধ্যমে বিদেশে পাচার করা হয়েছে। চক্রের অন্য সদস্যদের গ্রেফতারের চেষ্টা অব্যাহত আছে।
ডিবি-সাইবার অ্যান্ড স্পেশাল ক্রাইম বিভাগের উপ-পুলিশ কমিশনার (ডিসি) মোহাম্মদ তারেক বিন রশিদের নির্দেশনায় অতিরিক্ত উপ-পুলিশ কমিশনার (এডিসি) ফজলুর রহমানের তত্ত্বাবধানে অর্গানাইড ক্রাইম ইনভেস্টিগেশন টিমের টিমের সহকারী পুলিশ কমিশনার জুয়েল রানার নেতৃত্বে অভিযানটি পরিচালিত হয়।
এ ধরনের প্রলোভনের ফাঁদে পা না দিতে দুটি পরামর্শ দিয়েছে ডিবি-সাইবার অ্যান্ড স্পেশাল ক্রাইম (উত্তর) বিভাগ। এরমধ্যে-
১. অধিক মুনাফার আশায় অনলাইন জুয়া বা বেটিং-এ না জড়ানো।
২. নাম সর্বস্ব সফটওয়্যার বা ওয়েবসাইটে বিনিয়োগ না করা।
টিটি/এমকেআর/জিকেএস