আকবর আলি খান স্মরণ
সাধারণরা এগোতে চায়, রাজনীতিকরা পিছিয়ে দেয়
প্রখ্যাত অর্থনীতিবিদ ও সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা আকবর আলি খানের (৭৮) বর্ণাঢ্য জীবনের অবসান ঘটেছে। কর্মমুখর জীবনকে বিদায় জানিয়ে বৃহস্পতিবার (৮ সেপ্টেম্বর) রাতে শেষ নিশ্বাস ত্যাগ করেছেন তিনি। বিভিন্ন সময়ে তিনি জাগো নিউজের মুখোমুখি হয়েছেন, কথা বলেছেন দেশ ও জাতির স্বার্থ সংশ্লিষ্ট বিভিন্ন বিষয়ে। তার স্মরণে পুরোনো একটি সাক্ষাৎকারই তুলে ধরা হলো।
জ্যেষ্ঠ প্রতিবেদক সায়েম সাবুর নেওয়া সাক্ষাৎকার ২০১৭ সালের ১২ ডিসেম্বর প্রকাশিত হয়। ওই সাক্ষাৎকারে আকবর আলি খান বলেন, ‘সাধারণরা এগোতে চায় কিন্তু রাজনীতিকরা পিছিয়ে দেয়। শিক্ষিত রাজনীতিবিদরা যদি সাধারণ মানুষের এগিয়ে যাওয়ার ক্ষেত্রে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি না করতো তাহলে আমাদের প্রবৃদ্ধি ১০ শতাংশের ওপরে থাকতো।’
(সেসময় প্রকাশিত সাক্ষাৎকারের কোনো শব্দ-বাক্যই পরিমার্জন করা হয়নি)
জাগো নিউজ: রাষ্ট্র, সমাজের নানা প্রতিবন্ধকতার কথা বলছিলেন। এরপরও তো মানুষ এগিয়ে যাচ্ছে?
আকবর আলি খান: বাংলাদেশের অর্থনীতির মূলে রয়েছে অশিক্ষিত সাধারণ মানুষ। মূলত তিন ধরনের অশিক্ষিত জনগোষ্ঠী আমাদের প্রবৃদ্ধির মূলহোতা বা নায়ক মনে করি।
যারা বিদেশে গিয়ে কঠোর পরিশ্রম করে দেশে ২০/২২ বিলিয়ন ডলার পাঠাচ্ছেন, তারাই হচ্ছেন অর্থনীতির মূল নায়ক। অথচ তারা কিন্তু অদক্ষ, অশিক্ষিত। দ্বিতীয়ত, অশিক্ষিত গার্মেন্টস শ্রমিক, যারা কম বেতন নিয়ে পোশাক রপ্তানিতে সহায়তা করছেন। তৃতীয়ত, অশিক্ষিত কৃষক যারা তাদের হাজারও চেষ্টার মধ্য দিয়ে দেশের খাদ্য নিরাপত্তা চারগুণ বাড়িয়েছেন।
এ তিন শ্রেণির মানুষই রাষ্ট্র, সমাজ ও অর্থনীতিকে এগিয়ে নিয়ে যাচ্ছে।
জাগো নিউজ: দেশ এগিয়ে নেওয়ার পেছনে রাজনীতিকে কীভাবে মূল্যায়ন করবেন?
আকবর আলি খান: সাধারণরা এগোতে চায়, রাজনীতিকরা পিছিয়ে দেয়। শিক্ষিত রাজনীতিবিদরা যদি সাধারণ মানুষের এগিয়ে যাওয়ার ক্ষেত্রে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি না করতো তাহলে আমাদের প্রবৃদ্ধি ১০ শতাংশের ওপরে থাকতো। যে সাত শতাংশ প্রবৃদ্ধি হচ্ছে, সেটাও ধরে রাখতে পারব কি না, তা নিয়ে আমার সন্দেহ আছে।
জাগো নিউজ: কেনো এমন আশঙ্কা প্রকাশ করছেন?
আকবর আলি খান: আমাদের চলমান অর্থনীতির প্রধান নায়ক হচ্ছেন প্রবাসী শ্রমিকরা। যারা অধিকাংশই অদক্ষ ও অশিক্ষিত। বিদেশের মাটিতে অদক্ষ শ্রমিকের বাজার সংকোচিত হচ্ছে। মধ্যপ্রাচ্যে ইতোমধ্যে নারী শ্রমিকদের নিয়ে নানা শঙ্কার কথা গণমাধ্যমে প্রকাশ পেয়েছে। এ পরিস্থিতির ধারাবাহিকতা থাকলে প্রবৃদ্ধি আরও কমতে পারে। যা বিশ্বব্যাংক ও আইএমএফ ইতোমধ্যে আশঙ্কা করেছে।
জাগো নিউজ: তার মানে উন্নয়নের পথে রাজনীতিই এখন বাধা?
আকবর আলি খান: রাজনীতি উন্নয়নের বাধা, এটি এখন প্রমাণিত। অথচ সরকারগুলোর অর্থমন্ত্রীরা দাবি করেন যে, তাদের কারণে অর্থনীতি এগিয়ে যাচ্ছে। অর্থমন্ত্রী বা সরকার নায়ক নন, আসল নায়ক হচ্ছেন অশিক্ষিত সাধারণ মানুষ।
বাংলাদেশের মানুষ দেখাতে পারে যে, তারা কঠোর পরিশ্রম করতে জানেন এবং বিশেষ মুহূর্তে শক্ত অবস্থানে থাকতে পারেন।
জাগো নিউজ: রোহিঙ্গা ইস্যুতে কতটুকু শঙ্কা প্রকাশ করছেন?
আকবর আলি খান: রোহিঙ্গা ইস্যুতে আমি চরম আতঙ্কিত। আলোচনা হচ্ছে, ভালো। কিন্তু এ আলোচনার সুফল আমরা পাবো কি না, তা নিয়ে সন্দেহ আছে।
জাগো নিউজ: কেন এমন মনে করছেন?
আকবর আলি খান: সামরিক শক্তিতে প্রভাবিত মিয়ানমারের রাজনীতি অত্যন্ত অসহিষ্ণু, উগ্র বৌদ্ধ-মতাবলম্বী। তারা সত্যিই কোনো আপস চায় কি না, তা এখনও পরিষ্কার নয়।
যদি সত্যিই তারা আপস বা শান্তি চাইতো তাহলে এখনও রোহিঙ্গারা জীবন ভয়ে পালিয়ে আসতো না। এ সমস্যা তো পরিকল্পিতভাবে তৈরি করা হয়েছে।
জাগো নিউজ: আমাদের কী করণীয়?
আকবর আলি খান: আলোচনা চলছে, চলুক। কিন্তু এ ইস্যুতে আমাদের অত্যন্ত সতর্ক অবস্থানে থাকতে হবে।
জাগো নিউজ: ভারত-চীনকে কাছে পেলাম না রোহিঙ্গা ইস্যুতে। সতর্ক থেকেই-বা কী লাভ?
আকবর আলি খান: ভারত-চীনের মদদেই রোহিঙ্গা ট্র্যাজেডি ঘটেছে। আমরা পাশের এ দুই দেশকে কাছে না পেলেও বিশ্বশক্তির সমর্থন পাচ্ছি। সতর্কতা এখানেই। কারণ এ সমর্থন ধরে রেখে রোহিঙ্গা সমস্যার সমাধানে চেষ্টা করতে হবে।
সরকার কীভাবে এগোচ্ছে, তার ওপরে অনেক কিছু নির্ভর করছে। তবে এ মুহূর্তে রোহিঙ্গা ইস্যু নিয়ে দৃশ্যমান কোনো সমাধানের পথ নেই বলে ধারণা করা যায়।
জাগো নিউজ: সম্প্রতি প্রধান বিচারপতি এস কে সিনহার ছুটি, পরে পদত্যাগ; নানা ঘটনার জন্ম দিলো। বিষয়টি কীভাবে পর্যবেক্ষণ করলেন?
আকবর আলি খান: প্রধান বিচারপতি এস কে সিনহার ছুটি, পদত্যাগ নিয়ে যা ঘটলো, তা কোনোভাবেই কাম্য নয়। এতে বিচার বিভাগের বড় ক্ষতি হলো।
সরকার দাবি করছে, বিচার বিভাগকে স্বাধীন করা হচ্ছে। বিশেষ করে নির্বাহী বিভাগ থেকে বিচার বিভাগকে পুরোপুরিভাবে স্বাধীন করার কথা বলছে। কিন্তু আমরা এস কে সিনহার ঘটনায় উদ্বিগ্ন।
জাগো নিউজ: আস্থা তৈরির প্রশ্নে কী বলবেন?
আকবর আলি খান: সবার আগে সরকারকে ভাবতে হবে। মানুষের শেষ আশ্রয়স্থল হচ্ছে বিচার বিভাগ। এখানে আস্থা হারালে রাষ্ট্র, সমাজের বড় ক্ষতি হবে। দীর্ঘমেয়াদের এ ক্ষতিতে রাষ্ট্রের অন্য কাঠামো ভেঙে পড়বে। সরকার বিচার বিভাগের স্বাধীনতার প্রশ্নে যে নীতির কথা বলছে, তার সত্যিকার প্রতিফলন ঘটলে মানুষের আস্থা ফিরবে।
এসএএস/জেডএইচ