রাত ২টার পর ফার্মেসি বন্ধের সিদ্ধান্তে অটল দক্ষিণ সিটি

মুসা আহমেদ
মুসা আহমেদ মুসা আহমেদ
প্রকাশিত: ১০:২৬ পিএম, ২৯ আগস্ট ২০২২

জ্বালানি তেলের দাম বাড়ায় সারা বিশ্বের মতো বিপর্যয় আসে বাংলাদেশেও। অস্থিরতা বাড়ে ডলারের দামে। জ্বালানি খরচ বাঁচাতে বিদ্যুৎ সাশ্রয়ে নানামুখী উদ্যোগ নেয় সরকার। সরকারি-স্বায়ত্তশাসিত বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান চলছে বিধি-নিষেধ ও নতুন নিয়মের আওতায়। এর বাইরে সিটি করপোরেশনগুলোও নিজেদের মতো করে কিছু সিদ্ধান্ত নিয়েছে।

এরই অংশ হিসেবে ১ সেপ্টেম্বর থেকে ফার্মেসি বন্ধ করার সময়সীমাও বেঁধে দিয়েছে ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশন (ডিএসসিসি)। জরুরি এ সেবার সময়সীমা বেঁধে দেওয়ায় তীব্র প্রতিক্রিয়া আসে সব মহল থেকে। তবু নিজেদের সিদ্ধান্তে অটল ডিএসসিসি।

সংস্থাটির গণবিজ্ঞপ্তি অনুযায়ী, রাত ১২টার মধ্যে মহল্লার ওষুধের দোকান বন্ধ করতে হবে। আর রাত ২টার পর বন্ধ করতে হবে হাসপাতালের সঙ্গে যুক্ত ওষুধের দোকান।

ডিএসসিসির এমন ঘোষণার পর সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ব্যাপক সমালোচনা শুরু হয়। সাধারণ মানুষের বক্তব্য, মানুষ কখন অসুস্থ হবে, কখন ওষুধ কিনবে, কখন ওষুধ খাবে— সেই সময় বেঁধে দেওয়ার কোনো এখতিয়ার সিটি করপোরেশনের নেই। রাত ২টার পর কেউ অসুস্থ হলে কোথায় ওষুধ পাবে। তাই রাতে ওষুধের দোকান বন্ধ রাখার কোনো যৌক্তিকতা নেই।

এমন সমালোচনার মুখে সাংবাদিকদের মুখোমুখি হন স্বাস্থ্যমন্ত্রী জাহিদ মালেক। তিনি ডিএসসিসির নির্দেশনা নাকচ করে ফার্মেসি ২৪ ঘণ্টাই খোলা রাখা যাবে বলে জানান। মন্ত্রীর এমন আশ্বাসে মানুষের মনে স্বস্তি ফেরে। সন্তুষ্টি প্রকাশ করেন ফার্মেসি মালিকরা।

কিন্তু মন্ত্রীর বক্তব্যের পরও নিজেদের বিজ্ঞপ্তি সংশোধন করেনি ডিএসসিসি। সংস্থাটির সংশ্লিষ্টরা জানান, এখন পর্যন্ত তারা নিজেদের অবস্থানে অটল। আগামী ১ সেপ্টেম্বর থেকে তাদের নির্দেশনা মেনেই ফার্মেসি বন্ধ করতে হবে। প্রয়োজনে ভ্রাম্যমাণ আদালত পরিচালনা করবেন তারা। তবে রাত ২টার পর যদি কারও ওষুধের দরকার হয়, তখন নগরের মানুষ ওষুধের জন্য কোথায় যাবে এমন প্রশ্নের কোনো উত্তর দিতে পারেনি ডিএসসিসি। যদিও ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশন (ডিএনসিসি) এলাকায় এমন কোনো নির্দেশনা দেওয়া হয়নি।

এক শহরে দুই নিয়মে ফার্মেসি বন্ধের সময়সীমা নির্ধারণ করা কতটা যৌক্তিক তা নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন চিকিৎসক ও স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা। তারা এই সিদ্ধান্ত পুনর্বিবেচনার আহ্বান জানিয়েছেন।

মেডিসিন বিশেষজ্ঞ ও প্রধানমন্ত্রীর ব্যক্তিগত চিকিৎসক ডা. এ বি এম আবদুল্লাহ জাগো নিউজকে বলেন, ‘ফার্মেসি মানুষের জীবনের সঙ্গে সম্পৃক্ত বিষয়। হাসপাতাল-ক্লিনিকের আশপাশে ফার্মেসিগুলো বন্ধ করা সমীচীন নয়। এগুলো ২৪ ঘণ্টাই খোলা রাখা উচিত। ইমার্জেন্সি রোগের ক্ষেত্রে কোনো মানুষই বলতে পারেন না যে, রাত ২টার পরে আর ওষুধ লাগবে না। তাই এই সিদ্ধান্ত রিভিউ করা উচিত। অন্তত হাসপাতালের সামনের সব ফার্মেসি খোলা রাখা উচিত।’

গত ২২ আগস্ট দেশের জাতীয় বিভিন্ন পত্রিকায় একটি গণবিজ্ঞপ্তি দেয় ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশন (ডিএসসিসি)। এতে বলা হয়, আগামী ১ সেপ্টেম্বর মধ্যরাত থেকে ক্যাটাগরি অনুযায়ী বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান বা দোকান বন্ধের সময়সীমা নির্ধারণ করে দিয়েছে ডিএসসিসি। এর মধ্যে সব দোকানপাট, শপিংমল, মার্কেট, বিপণিবিতান, কাঁচাবাজার, ব্যবসায়িক-বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠান রাত ৮টার পর বন্ধ থাকবে। সব ধরনের খাবার হোটেল, রেস্তোঁরা, খাবারের দোকান খোলা থাকবে রাত ১০টা পর্যন্ত। খাবার সরবরাহ করা যাবে রাত ১১টা পর্যন্ত। এছাড়া চলচ্চিত্র প্রেক্ষাগৃহসহ চিত্তবিনোদনমূলক স্থাপনা, প্রতিষ্ঠানগুলো রাত ১১টার মধ্যে বন্ধ করতে হবে। সাধারণ ওষুধের দোকান রাত ১২টা এবং হাসপাতালের সঙ্গে সংযুক্ত নিজস্ব ওষুধের দোকান রাত ২টার মধ্যে বন্ধ করতে হবে।

এই বিজ্ঞপ্তির দুদিন পর (২৪ আগস্ট) শাহবাগের বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয় সংলগ্ন নগর পরিবহনের নতুন রুটের বাস থামার স্থান পরিদর্শনে যান ডিএসসিসি মেয়র শেখ ফজলে নূর তাপস। এসময় তাকে মধ্যরাত থেকে ফার্মেসি বন্ধ রাখার সিদ্ধান্তের বিষয়ে প্রশ্ন করেন সাংবাদিকরা। জবাবে মেয়র শেখ তাপস বলেন, ‘ওষুধের দোকান বা ফার্মেসিকে আমরা সর্বোচ্চ সময় দিয়েছি। অলিগলিসহ বিভিন্ন এলাকায় যে ফার্মেসি আছে তা রাত ১২টা পর্যন্ত খোলা থাকবে। অন্য হাসপাতালের সঙ্গে যেসব ফার্মেসি সংশ্লিষ্ট, সেগুলো রাত ২টা পর্যন্ত খোলা থাকবে। এরপর ফার্মেসি খোলা রাখার প্রয়োজন দেখি না।' কিন্তু রাত ২টার পর কারও ওষুধের দরকার হলে তখন কী হবে, এমন প্রশ্ন এড়িয়ে যান মেয়র।

মেয়রের এমন বক্তব্যের পর তুমুল সমালোচনা শুরু হয়। পরদিন সচিবালয়ে স্বাস্থ্যমন্ত্রী জাহিদ মালিককে প্রশ্ন করেন সাংবাদিকরা। তখন ফার্মেসি বন্ধে ডিএসসিসি মেয়র শেখ ফজলে নূর তাপস যে নির্দেশ দিয়েছেন, তা নাকচ করেন স্বাস্থ্যমন্ত্রী। তিনি বলেন, বিদ্যুৎ সাশ্রয়ে ওষুধের দোকান নির্দিষ্ট সময়ের পর বন্ধ করার কোনো কারণ নেই। স্বাস্থ্যসেবা হলো জরুরি সেবা। ফার্মেসি ২৪ ঘণ্টাই খোলা রাখা যাবে। কোনো ওষুধের দোকান বন্ধ থাকবে না। যেভাবে হাসপাতাল খোলা থাকবে, সেভাবে ওষুধের ব্যবস্থাও থাকবে। এ বিষয়ে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় ও স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের কর্মকর্তাদের নির্দেশ দেওয়া হয়েছে, সিটি করপোরেশনের সঙ্গে আলোচনা চলছে।

তবে মন্ত্রীর এমন নির্দেশনার পরও স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় বা অধিদপ্তরের কেউ ডিএসসিসিতে যোগাযোগ করেনি বলে জানা যায়। ডিএসসিসির সচিব দপ্তর সূত্র জানায়, গণবিজ্ঞপ্তির বিষয়ে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের কেউ তাদের সঙ্গে যোগাযোগ করেনি। ডিএসসিসি সরকারের একটি আলাদা সংস্থা। তারা নিজেদের মতো করে সিদ্ধান্ত নেওয়ার এখতিয়ার রাখে।

শাহবাগে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয় সংলগ্ন ইকরাম ফার্মেসি। এই ফার্মেসির স্বত্বাধিকারী তানভীর আলম বলেন, ঢাকা শহরের হাসপাতালের আশপাশের ফার্মেসি ২৪ ঘণ্টাই খোলা থাকে। আমরাও ২৪ ঘণ্টা ফার্মেসি খোলা রাখি। এতে হাসপাতালে জটিল ও আশঙ্কাজনক অবস্থায় রোগী এলে সার্বক্ষণিক ওষুধের জোগান নিশ্চিত রাখা যায়। এখন ডিএসসিসি যে সিদ্ধান্ত নিয়েছে, এটা মানুষের ভোগান্তি বাড়াবে।

ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল সংলগ্ন একটি ফার্মেসির দোকানের ব্যবস্থাপক সাইফুল ইসলাম জানান, মধ্যরাতে ফার্মেসি বন্ধের সিদ্ধান্ত একেবারেই হঠকারী। কারণ, তাদের দোকানে সারারাতই ওষুধ বেচাকেনা হয়। হাসপাতাল থেকে প্রচুর মানুষ তাদের দোকানে ওষুধ কিনতে যান। এখন কেউ যদি ওষুধ না পায় বা ভোগান্তিতে পড়ে তার দায় সিটি করপোরেশনকে নিতে হবে।

ডিএসসিসির বিজ্ঞপ্তি সংশোধন চেয়ে নোটিশ

গত ২৩ আগস্ট ওষুধের দোকান রাতে বন্ধ রাখার নির্দেশনা দিয়ে ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের (ডিএসসিসি) জারি করা গণবিজ্ঞপ্তি সংশোধন করতে আইনি নোটিশ পাঠিয়েছেন সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী এ কে এম এহসানুর রহমান, এএম জামিউল হক ফয়সাল ও মো. জুয়েল মুন্সী সুমনের পক্ষে মোহাম্মদ মাহবুবুর রহমান খান। স্থানীয় সরকার, পল্লী উন্নয়ন ও সমবায় মন্ত্রণালয়ের সচিব, জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের সচিব ও ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তাকে এই নোটিশ পাঠানো হয়।

নোটিশে বলা হয়, ওষুধ জীবন রক্ষাকারী অত্যাবশ্যকীয় একটি পণ্য। তা প্রয়োজনসাপেক্ষে জীবন রক্ষার জন্য তাৎক্ষণিক প্রয়োগ করতে হয়। ওষুধ বিক্রির সময়ের ওপর নিষেধাজ্ঞায় মানুষের জীবন হুমকির মুখে পড়ার আশঙ্কা তৈরি হয়েছে। সংবিধানের ৩২ অনুচ্ছেদ অনুযায়ী, মানুষকে জীবন রক্ষার অধিকার থেকে বঞ্চিত করা যাবে না। কিন্তু এই গণবিজ্ঞপ্তি বাংলাদেশের সংবিধানের ওই অনুচ্ছেদের সঙ্গে সরাসরি সাংঘর্ষিক। তাই নোটিশপ্রাপ্তির ২৪ ঘণ্টার মধ্যে গণবিজ্ঞপ্তিটির ওই অংশ সংশোধন করার জন্য অনুরোধ জানানো হলো। অন্যথায় প্রয়োজনীয় আইনগত ব্যবস্থা নেওয়া হবে।

ডিএসসিসি মেয়র শেখ ফজলে নূর তাপস এখন লন্ডনে অবস্থান করছেন। তাই তার সঙ্গে যোগাযোগ করা সম্ভব হয়নি। জানতে চাইলে ডিএসসিসির জনসংযোগ কর্মকর্তা আবু নাসের জাগো নিউজকে বলেন, দেশে বিদ্যুৎ সাশ্রয় এবং নগরে শৃঙ্খলা আনতে এই গণবিজ্ঞপ্তি দেওয়া হয়েছে। সেটা পরিবর্তন বা সংশোধন করতে কেউ তাদের নির্দেশনা দেয়নি। তাই বিজ্ঞপ্তি অনুযায়ী আগামী ১ সেপ্টেম্বর থেকে দক্ষিণ সিটিতে এই নির্দেশনা মেনে চলতে হবে।

এমএমএ/এএসএ/জেডএইচ

পাঠকপ্রিয় অনলাইন নিউজ পোর্টাল জাগোনিউজ২৪.কমে লিখতে পারেন আপনিও। লেখার বিষয় ফিচার, ভ্রমণ, লাইফস্টাইল, ক্যারিয়ার, তথ্যপ্রযুক্তি, কৃষি ও প্রকৃতি। আজই আপনার লেখাটি পাঠিয়ে দিন [email protected] ঠিকানায়।