কমছে না নারী নির্যাতন, বেশিরভাগই ধর্ষণ
দিন দিন বাড়ছে নারীর প্রতি নির্যাতনের মাত্রা। পরিবার, সমাজ কোথাও রেহাই পাচ্ছে না নারী। নির্যাতন চলছে নানা মাত্রিকতায়। রাষ্ট্রের সর্বত্র নারীর ওপর শারীরিক, মানসিক, সামাজিক ও অর্থনৈতিক নিপীড়ন তীব্রতর হচ্ছে। ধর্ষণ প্রতিরোধে সরকার মৃত্যুদণ্ডের মতো আইন করলেও, সচেতনতার জন্য নানা পদক্ষেপসহ আলোচনা-পর্যালোচনা হলেও নারীর প্রতি সহিংসতা কমছে না। প্রতিনিয়ত ঘরে-বাইরে নির্যাতনের শিকার হচ্ছে নারী।
১৯৯৫ সালের ২৪ আগস্ট দীর্ঘদিন পর মাকে দেখতে ঢাকা থেকে দিনাজপুরে যাচ্ছিল কিশোরী ইয়াসমিন (১৩)। কিন্তু দিনাজপুরের কোচে না উঠতে পেরে পঞ্চগড়গামী একটি কোচে ওঠে পড়ায় তাকে দিনাজপুরের দশমাইল নামক এলাকায় নামিয়ে দেওয়া হয়। এরপর পথে কিশোরী ইয়াসমিনকে ধর্ষণের পর হত্যা করে শহরতলির রাস্তার পাশে ফেলে যায় পুলিশ। পুলিশের এ পৈশাচিক ঘটনা জানাজানি হলে বিক্ষুব্ধ জনতা দোষীদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির দাবি জানিয়ে শহরে প্রতিবাদ মিছিল বের করে।
কিন্তু তৎকালীন পুলিশ প্রশাসন ঘটনাকে ধামাচাপা দিতে উল্টো নিষ্পাপ কিশোরী ইয়াসমিনকে যৌনকর্মী হিসেবে চালিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করলে আরও বিক্ষুব্ধ হয়ে ওঠে মানুষ। ঘটনার দুদিন পর জনতা রাস্তায় নেমে এলে বিক্ষুব্ধ জনতার ওপর পুলিশের গুলিবর্ষণে ৭ জন নিহত এবং আহত হন তিন শতাধিক মানুষ। ইয়াসমিন ধর্ষণ ও হত্যা মামলার রায় হয় ১৯৯৭ সালের আগস্ট মাসে। রায়ে তিনজনকে ফাসি দেওয়া হয়, রায় কার্যকর হয় ২০০৪ সালে।
কিশোরী ইয়াসমিন ধর্ষণ ও হত্যার ২৭ বছর কেটে গেলেও নারীর প্রতি সহিংসতা এখনো কমেনি, বরং বেড়েই চলেছে। বাংলাদেশ মহিলা পরিষদ কেন্দ্রীয় লিগ্যাল এইড উপ-পরিষদের প্রকাশিত তথ্য মতে, ২০১৯ সালে দেশে এক হাজার ৩৭০ জন, ২০২০ সালে এক হাজার ৩৪৬ জন, ২০২১ সালে এক হাজার ২৩৫ জন নারী ও কন্যাশিশু ধর্ষণের শিকার হয়েছেন।
আইন ও সালিশ কেন্দ্রের (আসক) তথ্য বলছে, সারাদেশে ধর্ষণ ও দলবেঁধে ধর্ষণের শিকার হয়েছেন ২০১৮ সালে ৭৩২ জন, ২০১৯ সালে ১ হাজার ৪১৩ জন ও ২০২০ সালে ১ হাজার ৬২৭ জন, ২০২১ সালে ১ হাজার ৩২১ জন এবং ২০২২ সালে জুলাই পর্যন্ত ৫৪৬ জন।
সংস্থা দুটির তথ্য বিশ্লেষণে দেখা যায়, গত কয়েক বছরে প্রতি বছরই গড়ে ১ হাজার ২০০ থেকে ১ হাজার ৬০০টি ধর্ষণের ঘটনা ঘটেছে। এছাড়া চলতি বছরের প্রথম সাত মাসে দেশে নারী ও শিশু নির্যাতনের অভিযোগে দায়ের হওয়া মামলার প্রায় অর্ধেকই ধর্ষণের।
গণমাধ্যমের খবর ও মামলার অভিযোগ থেকে জানা যায়, দেশে নানা মাত্রায় ঘটছে ধর্ষণসহ যৌতুকের কারণে হত্যা, অপহরণ ও নির্যাতনের ঘটনা। এসব ঘটনায় হচ্ছে মামলা। সিলেটে জুলি নামের এক নারীর সঙ্গে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ফেসবুকে পরিচয় হয় ঢাকার উত্তরা থানার আজমপুর এলাকার এক তরুণীর। ফেসবুকে তাদের দুজনের মধ্যে বন্ধুত্ব হয়। দীর্ঘদিন জুলি ওই তরুণীকে সিলেটে ঘুরে যাওয়ার আমন্ত্রণ জানান। গত ২০ আগস্ট ঢাকা থেকে সিলেটে ঘুরতে যান ওই তরুণী। ওঠেন জুলির বাসায়। ওইদিন সন্ধ্যায় মেয়েটিকে জুলি তার স্বামী জুবায়ের হোসেনের হাতে তুলে দেন। এরপর টানা দুদিন ওই ভাড়া বাসায় আটকে রেখে সাতজন তাকে ধর্ষণ করেন।
গত ১২ আগস্ট জামালপুরের সরিষাবাড়িতে বিয়ের প্রস্তাবে রাজি না হওয়ায় কনক হাসান নামের এক ব্যক্তি গভীর রাতে স্থানীয় এক স্কুলছাত্রীর ঘরে ঢুকে তাকে ধর্ষণ করেন। এ ঘটনার মাত্র ছয় দিন আগে গত ৬ আগস্ট গাজীপুরের শ্রীপুরে তাকওয়া পরিবহনের মিনিবাসে সংঘবদ্ধ ধর্ষণের শিকার হন এক গৃহবধূ। এর আগে ধর্ষকরা সঙ্গে থাকা তার স্বামীকে বাস থেকে ফেলে দেন।
ধর্ষণের ঘটনায় নারী ও শিশু নির্যাতনের আইনের পরিবর্তন হলেও দেশে নারী নির্যাতন, সহিংসতা বা ধর্ষণের সংখ্যা কমেনি। দিনাজপুরে আলোচিত ইয়াসমিন ধর্ষণ ও হত্যার ঘটনাসহ পরবর্তীকালে সারাদেশে নারী-শিশু নির্যাতন ও ধর্ষণের বিস্তারের মধ্য দিয়েই ২৪ আগস্ট পালিত হয়ে আসছে ‘নারী নির্যাতন প্রতিরোধ দিবস’।
নারী ও শিশু নির্যাতন রোধে নতুন আইন করেছে সরকার। এতেও নারীর প্রতি সহিংসতা, নির্যাতন ও ধর্ষণ এখনো কমেনি। তবে অপরাধীর দ্রুত বিচার নিশ্চিত করলে ধর্ষণ ও নারীর প্রতি যৌন সহিংসতা কিছুটা হলেও কমবে বলে মনে করেন মানবাধিকারকর্মীরা।
এ বিষয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী ও মানবাধিকার নিয়ে কাজ করা হিউম্যান রাইটস ভয়েস অ্যান্ড হিউম্যানিটির সভাপতি আব্দুল আওয়াল নয়ন খান জাগো নিউজকে বলেন, নারী ও শিশু নির্যাতন এবং ধর্ষণ সারাদেশেই চলেছে। দেশজুড়ে ধর্ষণবিরোধী আন্দোলনের ফলে মৃত্যুদণ্ডের বিধান রেখে আইন করা হলেও নারী নির্যাতন বা ধর্ষণ কমছে না। এজন্য অপরাধীর রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ও সামাজিক অবস্থান না দেখে দ্রুত বিচার সম্পন্ন করা প্রয়োজন।
জাতীয় জরুরি সেবা ৯৯৯-এর তথ্যানুযায়ী, নারী ও শিশু নির্যাতনের অভিযোগের সংখ্যা ব্যাপক হারে বাড়ছে। এ বছরের জুলাই পর্যন্ত নারী ও শিশু নির্যাতনের অভিযোগে ১১ হাজার ৯৫৯টি ফোনকল এসেছে। এরমধ্যে ধর্ষণের ৬১৯টি, ধর্ষণচেষ্টা ৩১৪টি, যৌন নির্যাতন ২৬৮টি, ধর্ষণের হুমকি ৩১টি এবং উত্যক্ত ও যৌন হয়রানির ১ হাজার ৯টি। একই অভিযোগে গত বছর অর্থাৎ ২০২১ সালে ১২ হাজার ১৬৯টি, ২০২০ সালে ৬ হাজার ৩৩১টি, ২০১৯ সালে ৩ হাজার ১১৫টি এবং ২০১৮ সালে ২ হাজার ২৯২টি ফোনকল আসে।
নারী ও শিশু নির্যাতনের অভিযোগ বাড়ার বিষয়ে ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশের উপ-পুলিশ কমিশনার মো. ফারুক হোসেন জাগো নিউজকে বলেন, কোনো নারী যখন নির্যাতনের শিকার হন বা নির্যাতনের মুখোমুখি হন তখনই জাতীয় জরুরি সেবা ৯৯৯-এ যোগাযোগ করেন। এতে অনেকেই নির্যাতন থেকে রেহাইও পাচ্ছেন। এখানে সফলতার ঘটনা অনেক রয়েছে। তবে এ সফলতাটুকু দিয়েই নারী নির্যাতন ও ধর্ষণ কমবে বিষয়টি এমন নয়। এর জন্য জনসচেতনতা প্রয়োজন।
নারী ও শিশু নির্যাতন বা ধর্ষণ বেড়ে যাওয়ার বিষয়ে তিনি বলেন, নারী ও শিশু নির্যাতন না কমার মূল কারণ সামাজিক অবক্ষয়। ফলে কঠোর আইন থাকা সত্ত্বেও নারী নির্যাতন ও ধর্ষণ কমছে না। পুলিশের দায়িত্ব অভিযুক্ত বা অপরাধীকে আইনের আওতায় আনা। কিন্তু এসব ঘটনায় বিচারের দায়িত্ব আদালতের।
গত পাঁচ বছর ধরে নারী নির্যাতনের ঘটনা ও ধর্ষণের মামলার হার বেড়েছে। আইনের যথাযথ প্রয়োগের অভাব, বিচার প্রক্রিয়ার দুর্বলতা, দীর্ঘসূত্রতা এবং দোষীদের বিচার না হওয়ার সংস্কৃতির কারণে ধর্ষণের ঘটনা বাড়ছে বলে বিশেষজ্ঞরা মনে করেন।
সমাজে নারী-শিশু নির্যাতন বেড়ে যাওয়ার বিষয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উইমেন অ্যান্ড জেন্ডার স্টাডিজ বিভাগের চেয়ারপারসন অধ্যাপক ড. সানজীদা আখতার জাগো নিউজকে বলেন, পুরুষতান্ত্রিক ব্যবস্থা ও মানসিকতা থেকেই ক্ষমতা প্রয়োগের একটা কুৎসিত রূপ নারী নির্যাতন বা ধর্ষণ। পর্যায়ক্রমে ওই জায়গাগুলোতে আমাদের মানসিকতার পরিবর্তন আনা প্রয়োজন। একইসঙ্গে নারী নির্যাতন, সহিংসতা বা ধর্ষণের পেছনে রয়েছে রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক ক্ষমতা কাঠামোরও একটা বিরাট প্রভাব।
আরএসএম/এমকেআর/জেআইএম