শেরপুর সীমান্তে খাবার পানির তীব্র সঙ্কট


প্রকাশিত: ০৩:৩০ এএম, ০৩ ফেব্রুয়ারি ২০১৬

গারো পাহাড়ের পাদদেশে অবস্থিত শেরপুরের ঝিনাইগাতী, নালিতাবাড়ী ও শ্রীবরদী উপজেলার সীমান্তবর্তী জনপদে খাবার পানির তীব্র সঙ্কট দেখা দিয়েছে। ভূ-গর্ভস্থ পানির স্তর অস্বাভাবিক নিচে নেমে যাওয়ায় এমন সঙ্কট দেখা দিয়েছে। এতে করে সীমান্তবর্তী জনপদের মানুষ বিশুদ্ধ পানির অভাবে চরম দুর্ভোগ পোহাচ্ছেন।

জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবে আবহাওয়ার পরিবর্তন, বৃষ্টিপাতের পরিমাণ কমে যাওয়া, সেচকার্যে স্যালো মেশিনের মাধ্যমে অতিমাত্রায় ভূ-গর্ভস্থ পানি উত্তোলন, নদ-নদী, পাহাড়ী ঝরনা, ঝোরাগুলোর নাব্যতা হারানো এবং প্রাকৃতিক জলাশয় ক্রমাগত ভরাট হওয়ার ফলে ভূ-গর্ভস্থ পানির স্তর এমন অস্বাভাবাবিক নিচে নেমে যাচ্ছে বলে জনস্বাস্থ্য প্রকৌশলীরা জানিয়েছেন।

তারা বলছেন, এ অবস্থা থেকে উত্তরণের জন্য এখনই ভাবনা-চিন্তা করতে হবে। এজন্য ভূ-উপরিস্থ পানির সংরক্ষণ ও ব্যবহার বাড়াতে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ গ্রহণ করতে হবে। সাধারণ মানুষকেও সচেতন করতে হবে।

স্থানীয় সূত্রে জানা গেছে, শুষ্ক মৌসুমের শুরুতেই সীমান্তবর্তী পাহাড়ী গ্রামগুলোতে প্রতি বছরই বিশুদ্ধ খাবার পানির সঙ্কট দেখা দেয়। গত কয়েক বছরের ন্যায় এ বছরও ভূ-গর্ভস্থ পানির স্তর আরও নিচে গেছে। এতে ঝিনাইগাতীর তাওয়াকুচা, পানবর, গুরুচরণ দুধনই, ছোট গজনী, বড় গজনী, গান্ধিগাঁও, বাকাকুড়া, হালচাটী, নওকুচি, ধানশাইল, নলকুড়া, গৌরীপুর, নালিতাবাড়ীর গারোপাড়া, বাতকুচি, টিলাপাড়া, লক্ষ্মীকুড়া, পূর্ব সমেশ্চুড়া, শ্রীবরদী উপজেলার হারিয়াকোনা, বাবেলাকোনা এলাকায় ভূ-গর্ভস্থ পানির স্তর প্রায় ১৩০-১৪০ ফুট নিচে নেমে গেছে। ফলে ওইসব এলাকায় খাবার পানির তীব্র সঙ্কট দেখা দিয়েছে।

জনস্বাস্থ্য প্রকৌশল অধিদফতরের কর্মকর্তারা বলছেন, তাদের জানা মতে শুষ্ক মৌসুমে সীমান্তবর্তী এসব এলাকার শতকরা ৬০ ভাগ টিউবওয়েল অকেজো হয়ে পড়েছে। বিশুদ্ধ পানির অভাবে চরম দুর্ভোগ পোহাচ্ছে ওইসব এলাকায় বসবাসকারী মানুষজন। এ ব্যাপারে প্রশাসনকে অবহিত করা হলেও কোনো প্রতিকার মিলছে না বলে জানিয়েছেন স্থানীয় ভুক্তভোগীরা।

স্থানীয় জনস্বাস্থ্য প্রকৌশলীরা বলছেন, গত বছর পরিমাপ করে দেখা গেছে, সীমান্তবর্তী জনপদে ভূ-গর্ভস্থ পানির স্তর ১২২ ফুট নেমে গিয়েছিলো। এবার এখনও পরিমাপ করা হয়নি। তবে প্রতি বছরই এসব এলাকার পানির স্তর নিচে নেমে যাচ্ছে। এ অবস্থা থেকে উত্তেণের জন্য ১৬০ ফুট গভীরতা সম্পন্ন ‘ডিপসেট তারা পাম্প’ এবং ‘সাব মার্জিবল’ পাম্প স্থাপন করা হচ্ছে।

তারা আশঙ্কা প্রকাশ করে বলছেন, যেভাবে এসব এলাকায় পানির স্তর দ্রুত নেমে যাচ্ছে, তাতে করে সামনে এমন সময় আসবে যখন আর ভূ-গর্ভস্থ পানি উঠানো সম্ভব হবে না। এজন্য এসব এলাকায় ‘সারফেস ওয়াটার রিজার্ভার’ বা ভূ-উপরিস্থ পানি সংরক্ষণের ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে। এজন্য এসব এলাকার হাজা-মজা পুকুর, খাল-বিল, নালা, প্রাকৃতিক জলাশয় সংস্কার ও সংরক্ষণ করে বৃষ্টির পানির ধারণ ক্ষমতা বাড়াতে হবে। নদ-নদী, ঝরণা-ঝোরাগুলো খনন করে পানি আটকে রাখার ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে। এজন্য প্রয়োজনে বড় ধরনের প্রকল্প নিয়ে এখনই এগুতে হবে। অন্যথায় সামনে ভয়াবহ বিপর্যয়ের মুখে পড়তে হবে।    

সরেজমিনে গিয়ে দেখা গেছে, বিশুদ্ধ খাবার পানি না পেয়ে মানুষ মাটির কূপ, ঝরণাসহ বিভিন্ন জলাশয় থেকে পানি সংগ্রহ করছে। আবার অনেকেই দূর-দূরান্ত থেকে পানি সংগ্রহ করে গৃহস্থলির কাজ ও খাবার পানির ব্যবস্থা করছেন। এসব গ্রামগুলোতে পানির জন্য হাহাকার পড়ে গেছে। অন্যদিকে খাল-বিল, নদী-নালা, পুকুর ঝরণাসহ জলাশয়ের পানি পান করে বিভিন্ন রোগে আক্রান্ত হচ্ছে পাহাড়ী জনপদের লোকজন।

নওকুচি গ্রামের আদিবাসী নেতা ফছেন সাংমা বলেন, রিংওয়েল নলকূল স্থাপন করে পানি উত্তোলন করতে হয়। আর এতে ব্যয় হয় প্রায় ৩ লাখ টাকা। তিনি বলেন, দরিদ্র সীমার নিচে বসবাসকারী আদিবাসী অধ্যুষিত পাহাড়ী গ্রামবাসীদের পক্ষে তা সম্ভব হয়ে উঠে না।

ছোট গজনী গ্রামের আদিবাসী নেতা ফিলিসন সাংমাসহ আরো অনেকেই জানান, সরকার ও এনজিওর মাধ্যমে বিভিন্ন সময় বেশ কিছু রিংওয়েল নলকূপ স্থাপন করা হলেও নলকূপগুলো এখন অকেজো হয়ে পড়ে আছে। সেগুলোতে পানি উঠছে না।

নালিতাবাড়ীর পূর্ব সমেশ্চুড়া গ্রামের বাসিন্দা রাজ্জাক মিয়া বলেন, ঘণ্টা খানেক চেষ্টার পর টিউবওয়েল দিয়ে কখনো পানি উঠে আবার কখনো উঠেনা। পানির অভাবে কষ্টে আছি।

ঝিনাইগাতীর নলকুড়া ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান খলিলুর রহমান বলেন, জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবে প্রতি বছর শুষ্ক মৌসুমে ভূ-গর্ভস্থ পানির স্তর নিচে নেমে যাওয়ায় পানির তীব্র সঙ্কট দেখা দেয়। এ বছর এ সঙ্কট আরো তীব্র হয়েছে।

শ্রীবরদী উপজেলা ট্রাইবাল ওয়েলফেয়ার অ্যাসোসিয়েশনের সাধারণ সম্পাদক প্রাঞ্জল এম সাংমা বলেন, হারিয়াকোনা, বাবেলাকোনা এলাকায় আদিবাসী গারো সম্প্রদায়ের বসবাস। শুষ্ক মওশুমে পানির স্তর নিচে নেমে যাওয়ায় টিউবওয়েলগুলো অচল হয়ে পড়ে। এতে করে প্রতি বছরই আমাদের পানির কষ্টে ভুগতে হয়। কিন্তু আজও এর কোনো প্রতিকার হয়নি।

ঝিনাইগাতী উপজেলা জনস্বাস্থ্য প্রকৌশল অধিদফতরের সহকারী প্রকৌশলী মো. আব্দুল মোতালেব জানান, গত বছর সীমান্তবর্তী অঞ্চলে ভূ-গর্ভস্থ পানির স্তর প্রায় ১২২ ফুট নিচে নেমে যাওয়ার ফলে পানির সংঙ্কট চরম আকার ধারণ করে। চলতি বছর ভূ-গর্ভস্থ পানির স্তর আরো নিচে নেমে যাওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে। এজন্য সীমান্তবর্তী অঞ্চলে জনস্বাস্থ্য প্রকৌশল অধিদফতরের পক্ষ থেকে বেশ কিছু রিংঅয়েল, ডিপসেট তারা পাম্প, সাব মার্জিবল স্থাপনের উদ্যোগ নেয়া হয়েছে। ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা এখানকার ভূ-গর্ভস্থ পানির স্তর অস্বাভাবিক নিচে নেমে যাওয়ার বিষয়টি নিয়ে চিন্তিত হয়ে পড়েছেন। সারফেস ওয়াটার ধরে রাখার রিজার্ভার বাড়াতে হবে অন্যথায় এটা সামনে ভয়াবহ রূপ নেবে। এজন্য তিনি বড় ধরনের প্রকল্প নেয়া উচিত বলে উল্লেখ করেন।

এ ব্যাপারে ঝিনাইগাতী উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) মোহাম্মদ সেলিম রেজা বলেন, ভূ-গর্ভস্থ পানির স্তর নিচে নেমে যাওয়ায় পাহাড়ী কয়েকটি এলাকায় খাবার পানির সঙ্কট দেখা দিয়েছে। এসব গ্রামে মাটির নিচে পাথর থাকায় নলকূপ স্থাপন করা সম্ভব হয় না। তবে রিংওয়েল নলকূপ স্থাপন করে খাবার পানির সমস্যা সমাধান করা সম্ভব। আমরা ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষকে বিষয়টি অবহিত করেছি। সরকার অথবা বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থার পক্ষ থেকে বিশেষ প্রযুক্তি ব্যবহারের  মাধ্যমে নলকূপ স্থাপন করা হলে পানি সঙ্কট সমাধান করা সম্ভব। আমাদের চেষ্টা অব্যাহত রয়েছে।

হাকিম বাবুল/এসএস/পিআর

পাঠকপ্রিয় অনলাইন নিউজ পোর্টাল জাগোনিউজ২৪.কমে লিখতে পারেন আপনিও। লেখার বিষয় ফিচার, ভ্রমণ, লাইফস্টাইল, ক্যারিয়ার, তথ্যপ্রযুক্তি, কৃষি ও প্রকৃতি। আজই আপনার লেখাটি পাঠিয়ে দিন [email protected] ঠিকানায়।