গ্যাস-বিদ্যুৎ সংকটে ব্যাহত উৎপাদন, শিল্প মালিকদের কপালে ভাঁজ
অডিও শুনুন
# লোডশেডিংয়ের পাশাপাশি গ্যাসেও রেশনিং
# মানিয়ে চলার পরামর্শ কর্মকর্তাদের
দেশে পেট্রোলিয়াম জ্বালানির প্রায় পুরোটাই আমদানিনির্ভর। আবার গ্যাসের একটি অংশও আমদানি করতে হয়। বৈশ্বিক পরিস্থিতিতে একদিকে বাড়ছে ডলারের দাম, অন্যদিকে আন্তর্জাতিক বাজারে বাড়ছে জ্বালানির দাম। এতে জ্বালানি তেল ও গ্যাস আমদানি করতে গিয়ে টান পড়ছে বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভে। বৈশ্বিক এমন পরিস্থিতিতে জ্বালানি ব্যবহার কাটছাট করছে সরকার। সিদ্ধান্ত হয়েছে বিদ্যুতের লোডশেডিংয়ের, গ্যাস সরবরাহে করা হচ্ছে রেশনিং। এর বিরূপ প্রভাব পড়ছে শিল্পোৎপাদনে।
শিল্প মালিকরা বলছেন, গ্যাস ও বিদ্যুৎ সংকটে উৎপাদনে ধস নামলে দেশের অর্থনীতি আরও বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হবে। এ কারণে সরকারের কাছে নিরবচ্ছিন্ন গ্যাস বিদ্যুতের নিশ্চয়তা চান তারা।
এ বিষয়ে চট্টগ্রাম চেম্বারের সভাপতি মাহবুবুল আলম বৃহস্পতিবার (২১ জুলাই) জাগো নিউজকে বলেন, শিল্পখাতে এখনো পুরোপুরি গ্যাস বা ইলেকট্রিসিটি রেশনিং হয়নি। কিছু কিছু শিল্পকারখানায় বাল্ক গ্যাস সরবরাহে রেশনিং হচ্ছে। এতে কারখানারগুলোর উৎপাদন ব্যাহত হচ্ছে। গ্যাস-বিদ্যুৎ না হলে শিল্প কারখানা চালু রাখা সম্ভব হবে না। শিল্পের উৎপাদন ব্যাহত হলে সামগ্রিক অর্থনীতিতে বিরূপ প্রভাব পড়বে। শিল্প ক্ষতিগ্রস্ত হলে বিনিয়োগ ক্ষতিগ্রস্ত হবে, অর্থনীতি ক্ষতিগ্রস্ত হবে। এজন্য আমরা সরকারের কাছে দাবি রাখবো, যাতে শিল্পখাতে গ্যাস-বিদ্যুতের সরবরাহ নিরবচ্ছিন্ন রাখা হয়।
এদিকে জুন মাসের মাঝামাঝি থেকে সারাদেশে কমবেশি লোডশেডিং শুরু হয়। জুলাইয়ের মাঝামাঝিতে লোডশেডিং প্রকট হয়। এর প্রভাব পড়ছে শিল্পকারখানার উৎপাদনে। দেশের শীর্ষ লৌহজাত পণ্য উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠান আবুল খায়ের গ্রুপের একেএস স্টিল কারখানাটি চলে নিজেদের উৎপাদিত বিদ্যুতে। আবুল খায়ের গ্রুপের ১০০ মেগাওয়াটের একটি ক্যাপটিভ পাওয়ার প্ল্যান্ট রয়েছে। বর্তমানে কর্ণফুলী গ্যাস কর্তৃপক্ষ গ্যাস সরবরাহে রেশনিং শুরু করায় তাদেরও বিদ্যুৎ উৎপাদন ব্যাহত হচ্ছে। এতে রড উৎপাদনেও প্রভাব পড়েছে। কারখানাটিতে সাধারণত প্রতিদিন সাড়ে তিন হাজার টন রড উৎপাদিত হতো। এখন বিদ্যুৎ সংকটে তা প্রায় ২৫ শতাংশ কমে গেছে।
একেএস পাওয়ার প্ল্যান্টের সিনিয়র ম্যানেজার ইমরুল কাদের ভূঁইয়া জাগো নিউজকে বলেন, কর্ণফুলী গ্যাস ডিস্ট্রিবিউশন কোম্পানি (কেজিডিসিএল) থেকে আমাদের গ্যাসের রেস্ট্রিকশন (বাধ্যবাধকতা) রয়েছে। আমাদের প্ল্যানটটি ১০০ মেগাওয়াটের। সাধারণত আমাদের ৯০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদন হতো। এখন গ্যাস সংকটের কারণে ৬৫ থেকে ৭০ মেগাওয়াট উৎপাদন হচ্ছে। পাওয়ার বন্ধ থাকলে পুরো প্ল্যান্ট কয়েক ঘণ্টা বন্ধ রাখতে হয়। একইভাবে কারখানার উৎপাদনও কমে গেছে। বিদ্যুতের সমস্যার কারণে আমাদের ৮০০-৯০০ মেট্রিক টন রড উৎপাদন কমে গেছে।
জানা গেছে, বর্তমানে চট্টগ্রামের বড় বড় শিল্পকারখানা চলছে নিজেদের ক্যাপটিভ পাওয়ারে উৎপাদিত বিদ্যুৎ দিয়েই। আর এসব পাওয়ার প্ল্যান্টের জন্য গ্যাসের যোগান দেয় কেজিডিসিএল। লৌহ, সিমেন্ট, গ্যাস, পেপার, টেক্সটাইলের মতো এসব ভারী শিল্প চলছে ‘ক্যাপটিভ পাওয়ার’ নামের নন-গ্রিড বিদ্যুতে।
চট্টগ্রামে গ্যাস রিফুয়েলিং স্টেশনসহ ১৭১টি ক্যাপটিভ পাওয়ার ইউনিট রয়েছে। এর মধ্যে গ্যাসচালিত জেনারেটর দ্বারা উৎপাদিত বিদ্যুৎ ব্যবহার করে রিফুয়েলিং স্টেশনগুলো। এছাড়া চট্টগ্রামের বড় বড় শিল্পগ্রুপ ক্যাপটিভ পাওয়ারের মাধ্যমে নিজেদের পণ্য উৎপাদনে কারখানা চালাচ্ছে। এসব ক্যাপটিভ পাওয়ার প্ল্যান্টে প্রতি মাসে গ্যাসের চাহিদা রয়েছে সাড়ে ৫ কোটি ঘনমিটার। বর্তমানে মাসে চার কোটি ঘনমিটারের মতো গ্যাস পাচ্ছে এসব ক্যাপটিভ পাওয়ার।
কর্ণফুলী গ্যাস ডিস্ট্রিবিউশন কোম্পানি লিমিটেড
সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে, বড় বড় শিল্পকারখানাগুলো নিজস্ব ব্যবস্থাপনায় বিদ্যুৎকেন্দ্র (ক্যাপটিভ পাওয়ার) নির্মাণ করেছে। ১ মেগাওয়াট থেকে ১০০ মেগাওয়াট সক্ষমতার ক্যাপটিভ পাওয়ার প্ল্যান্ট রয়েছে চট্টগ্রামে। ক্যাপটিভে উৎপাদিত বিদ্যুৎ ইস্পাত শিল্পে বেশি ব্যবহৃত হচ্ছে। এছাড়া সিমেন্ট, গ্যাস, সিরামিক, টেক্সটাইল, অ্যালুমিনিয়াম, জুতা, কাগজ, ভোজ্যতেল, কেমিক্যাল কারখানাতেও রয়েছে ক্যাপটিভ পাওয়ার প্ল্যান্ট।
ক্যাপটিভ পাওয়ারে চলে আরেক শিল্পপ্রতিষ্ঠান চট্টগ্রামের কর্ণফুলী এলাকার মডার্ন পলি ইন্ডাস্ট্রিজ। কারখানাটি চালাতে তাদের ৮ মেগাওয়াট বিদ্যুতের প্রয়োজন হয়। নন-কটন সুতা উৎপাদিত হয় সেখানে। কারখানাটিতে ৯০০ শ্রমিক কাজ করে।
কথা হয় মডার্ন পলি ইন্ডাস্ট্রিজ লিমিটেডের ব্যবস্থাপনা পরিচালক আবু সুফিয়ান চৌধুরীর সঙ্গে। তিনি জাগো নিউজকে বলেন, আমাদের ১২ মেগাওয়াট ইনস্টলেশন ক্যাপাসিটির একটি ক্যাপটিভ পাওয়ার প্ল্যান্ট রয়েছে। এটি পুরোটাই গ্যাসনির্ভর। কেজিডিসিএল থেকে আমাদের ব্যবহার কমিয়ে আনার জন্য বলা হয়েছে। বর্তমানে আমাদের ৮ মেগাওয়াট বিদ্যুতের প্রয়োজন হয়। যদি গ্যাস সরবরাহ কমিয়ে দেওয়া হয়, তাহলে আমাদের ক্যাপটিভ বন্ধ করে দেওয়া ছাড়া উপায় থাকবে না। এতে আমাদের কারখানার উৎপাদনও বন্ধ হয়ে যাবে।
কেজিডিসিএল’র ঊর্ধ্বতন এক কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে জাগো নিউজকে বলেন, বর্তমানে অসংখ্য শিল্পকারখানা ক্যাপটিভ পাওয়ারের মাধ্যমে উৎপাদন অব্যাহত রেখেছে। বর্তমানে শিল্পে গ্যাসে কোনো রেশনিং করা হচ্ছে না। গত দুই দিন বড় বড় শিল্পপ্রতিষ্ঠানে কিছু রেশনিং করা হয়েছে। চিটাগাং ইউরিয়া ফার্টিলাইজার কোম্পানি লিমিটেড (সিইউএফএল) বন্ধ থাকায় শিল্পে গ্যাসের রেশনিং করতে হচ্ছে না। আজ থেকে তাদের পুরোদমে ক্যাপটিভ ব্যবহারের জন্য বলা হয়েছে।
তিনি বলেন, এখন বড় প্রায়োরিটি বিদ্যুতে। গ্যাসের মাধ্যমে রাউজান পাওয়ার প্ল্যান্টের একটি ইউনিট সচল রাখা হয়েছে।
তবে ক্যাপটিভ বাদেও চট্টগ্রামসহ সারাদেশে অসংখ্য শিল্পকারখানা রয়েছে, যাদের জাতীয় গ্রিডের বিদ্যুতই একমাত্র ভরসা।
প্রিমিয়ার সিমেন্ট লিমিটেডের মহাব্যবস্থাপক গোলাম কিবরিয়া জাগো নিউজকে বলেন, সরকার শিল্পবান্ধব। এখন যে লোডশেডিং হচ্ছে, তাতে আমাদের কারখানায় বেশি প্রভাব পড়েনি। তবে গত কয়েকদিনে যে লোডশেডিং হয়েছে, তাতে আমাদের প্ল্যান্ট কয়েকবার বন্ধ করতে হয়েছিল। এতে উৎপাদন ব্যাহত হয়েছে। কারণ আমরা পুরোপুরি বিদ্যুতের ওপর নির্ভরশীল। আমাদের কারখানাটি কর্ণফুলী উপজেলায়। ওই উপজেলায় নির্দিষ্ট সময়ের জন্য বিদ্যুৎ না থাকলে আমাদের কারখানাতেও বিদ্যুৎ পাওয়া যাবে না। তখন বাধ্য হয়ে উৎপাদন বন্ধ রাখতে হবে।
তিনি বলেন, শিল্পজোনগুলোতে বিদ্যুতের সমস্যা হবে না। কিন্তু আমাদের মতো শত শত কারখানা বিভিন্ন জেলা-উপজেলায় ছড়িয়ে ছিটিয়ে রয়েছে। সেসব কারখানায় বিদ্যুতের বরাদ্দ কমলে তার প্রভাব আশপাশের কারখানাগুলোতেও পড়বে।
গার্মেন্টস শিল্পেও লোডশেডিংয়ের বিরূপ প্রভাব পড়ছে বলে জানান ব্যবসায়ীরা। তৈরি পোশাকশিল্প মালিকদের সংগঠন বিজিএমইএ’র সহ-সভাপতি রকিবুল আলম চৌধুরী জাগো নিউজকে বলেন, সারাদেশে পাঁচ হাজারের মতো গার্মেন্টস কারখানা চলমান রয়েছে। চট্টগ্রামে ৪৫০ পোশাক কারখানা সচল রয়েছে। বিদ্যুৎ সমস্যার কারণে কমবেশি প্রতিটি কারখানা ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। বিদ্যুতের সমস্যা সম্প্রতি আলোচনায় এসেছে। কিন্তু আমরা গত প্রায় দুই মাস থেকেই প্রতিদিন ৪-৫ ঘণ্টা করে বিদ্যুৎ পাচ্ছিলাম না। বিদ্যুৎ না থাকলে বিকল্প ব্যবস্থায় জেনারেটর ব্যবহার করতে হয়।
তিনি বলেন, বিদ্যুতের বিকল্প হিসেবে জেনারেটর দিয়ে পুরো কারখানা চালানো সম্ভব হয় না। সেক্ষেত্রে কারখানাতেও রেশনিং করতে হয়। হয়তো একটি ফ্লোর চালু রেখে অন্য ফ্লোর বন্ধ রাখতে হয়। কখনো দুই লাইন বন্ধ রেখে দুই লাইন চালু রাখতে হচ্ছে। এতে উৎপাদনের ব্যয় কয়েকগুণ বেড়ে যাচ্ছে। আবার নির্ধারিত সময়ে উৎপাদন করা সম্ভব হচ্ছে না। এতে অনেকের শিপমেন্ট বিলম্বিত হওয়ার আশঙ্কা রয়েছে।
পেট্রোবাংলার তথ্যমতে, বৃহস্পতিবার (২১ জুলাই) ২ হাজার ৭৭৪ মিলিয়ন ঘনফুট গ্যাস সরবরাহ করেছে পেট্রোবাংলা। দেশীয় গ্যাসক্ষেত্র থেকে ২ হাজার ৩৪৫ মিলিয়ন ঘনফুট এবং আমদানিকৃত এলএনজি সরবরাহ দেওয়া হয়েছে ৪২৯ মিলিয়ন ঘনফুট। এর মধ্যে চট্টগ্রামের জন্য কর্ণফুলী গ্যাসকে দেওয়া হয়েছে ২৬৫ মিলিয়ন ঘনফুট গ্যাস।ৎ
অন্যদিকে রূপান্তরিত প্রাকৃতিক গ্যাস কোম্পানি লিমিটেড (আরপিজিসিএল) বলছে, বর্তমানে সারাদেশে ৪ হাজার ২০০ মিলিয়ন ঘনফুট গ্যাসের চাহিদা রয়েছে। গ্যাস সেক্টর মাস্টার প্ল্যান খসড়া-২০১৭ অনুযায়ী ২০২৩ সালে চাহিদা অনুযায়ী গড়ে ১৯৬৮ মিলিয়ন ঘনফুট গ্যাসের ঘাটতি থাকার কথা।
পিডিবির তথ্যমতে, বুধবার (২০ জুলাই) সারাদেশে ১২ হাজার ৪৯৪ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপান হয়। এর বাইরে জাতীয় গ্রিডে যুক্ত হয়েছে ভারত থেকে আমদানিকৃত ৯৮০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ। এর মধ্যে ত্রিপুরা থেকে ১২৬ মেগাওয়াট এবং ভেড়ামাড়া এইচভিডিসি (হাই ভোল্টেজ ডিরেক্ট কারেন্ট) দিয়ে ৮৫৪ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ যুক্ত হয়েছে দেশের জাতীয় গ্রিডে। ওইদিন পিডিবির নিজস্ব মালিকানাধীন ৪৬টি বিদ্যুৎকেন্দ্রের মধ্যে ১৫টিতে পিক আওয়ারে কোনো বিদ্যুৎ উৎপাদন হয়নি। কমবেশি গ্যাস সংকট ছিল গ্যাসনির্ভর ২৭টি বিদ্যুৎকেন্দ্রে। ১০টি বিদ্যুৎকেন্দ্রে ডিজেল ও ফার্নেস অয়েলের সংকট ছিল। কয়লা সংকট ছিল পিডিবির মালিকানাধীন দুই বিদ্যুৎকেন্দ্রে।
২০ জুলাই সারাদেশে ১ হাজার ১৭০ মেগাওয়াট লোডশেডিং হয়েছে। ২১ জুলাই সারাদেশে কমবেশি ১৪ হাজার ৯৩৫ মেগাওয়াট বিদ্যুতের চাহিদা ছিল। এর মধ্যে ১ হাজার ৩৬৫ মেগাওয়াট সম্ভাব্য লোডশেডিংয়ের পরিকল্পনা হাতে নিয়েছে পিডিবি। এতে বেশি লোডশেডিংয়ের পরিকল্পনা রয়েছে চট্টগ্রাম ও খুলনা অঞ্চলে। কোনো লোডশেডিং রাখা হয়নি বরিশাল অঞ্চলে। আগের দিন ১৯ জুলাই সারাদেশে লোডশেডিং হয়েছিল ১ হাজার ৯১৫ মেগাওয়াট।
পিডিবির দক্ষিণাঞ্চল বিতরণ বিভাগের প্রধান প্রকৌশলী (চলতি দায়িত্ব) রেজাউল করিম জাগো নিউজকে বলেন, বিশেষায়িত শিল্প এলাকাগুলোতে কোনো লোডশেডিং করা হয়নি। তবে এলাকাভিত্তিক যেসব শিল্প আছে সেগুলোতে খুব নগণ্য পর্যায়ে লোডশেডিং করা হয়। যখন কোনো উপায় থাকে না, তখন বাধ্য হয়েই লোডশেডিং করতে হয়। বৈশ্বিক বাস্তবতার কারণে আমাদের কমবেশি সমস্যায় পড়তে হচ্ছে। পরিস্থিতি স্বাভাবিক না হওয়া পর্যন্ত বিষয়টি মানিয়ে চলার পরামর্শ দেন তিনি।
ইকবাল হোসেন/ইএ/এমএইচআর/এমএস