জ্বালানির মূল্যবৃদ্ধি: সরকারের সিদ্ধান্তের দিকে তাকিয়ে বিপিসি
টানা সাত বছর লাভে থাকার পর লোকসানের শঙ্কায় পড়েছে রাষ্ট্রায়ত্ত প্রতিষ্ঠান বাংলাদেশ পেট্রোলিয়াম করপোরেশন (বিপিসি)। বিশ্ববাজারে জ্বালানি তেলের দাম বাড়তে থাকায় প্রতিষ্ঠানটির সার্বিক লোকসানের শঙ্কা এবং দৈনিক লোকসান বাড়ছে। বিপিসি সূত্রে জানা গেছে, বর্তমানে গড়ে প্রতিদিন ৮৩ কোটি টাকার ওপরে লোকসান হচ্ছে প্রতিষ্ঠানটির। যার প্রভাব গিয়ে পড়ছে বিদ্যুৎ উৎপাদনের ওপর। এ অবস্থায় হয় জ্বালানির মূল্যবৃদ্ধি, না হয় সাশ্রয়ী হতে চায় সরকার।
ঈদের আগে টানা লোডশেডিংয়ের কবলে পড়েছে দেশ। ঈদের পর লোডশেডিং কমাতে এবং জ্বালানি সাশ্রয়ে কর্মঘণ্টা কমিয়ে আনার প্রস্তাবনাও এসেছে। অন্যদিকে জ্বালানি তেলের দাম বাড়ানোর ইঙ্গিতও দিয়েছেন বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ প্রতিমন্ত্রী নসরুল হামিদ। এ অবস্থায় সরকারের সিদ্ধান্তের দিকে তাকিয়ে আছে বিপিসি।
মহামারি করোনা সংক্রমণ কমে এলে ২০২১ সালের শুরুর দিকেই বিশ্বজুড়ে বাড়তে থাকা চাহিদার জেরে ঊর্ধ্বমুখী হতে থাকে তেলের বাজার। বছরের শেষ দিকে তা আরও বাড়লে নভেম্বরে দাম সমন্বয়ে সরকার দেশে ডিজেল ও কেরোসিনের দাম প্রতি লিটারে ১৫ টাকা বাড়িয়ে ৮০ টাকা নির্ধারণ করে। এরপর ফেব্রুয়ারিতে রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ শুরু হলে তেলের বাজার আরও তেঁতে ওঠে।
সবশেষ এক মাসের ব্যবধানে অপরিশোধিত জ্বালানি তেলের দাম ব্যারেলপ্রতি গড়ে প্রায় ১৬ ডলার বেড়েছে। এ অবস্থায় দেশের বাজারে ডিজেল ও অকটেন বিক্রিতে বড় অঙ্কের লোকসান গুনতে হচ্ছে বিপিসিকে। প্রতি লিটার ডিজেল বিক্রিতে ৫৭ টাকা এবং অকটেনে ৩৭ টাকা লোকসান করছে প্রতিষ্ঠানটি। ফলে মূল্যবৃদ্ধি না করে কোনো উপায় দেখছে না বিপিসি।
সরকারি এ প্রতিষ্ঠানটির মতে, অপরিশোধিত তেলের দাম ৮০ ডলারের মধ্যে থাকলে লোকসান হয় না। বর্তমানে প্রতি ব্যারেল অপরিশোধিত তেলের দাম ১২০ ডলারের ওপর। তবে ডিজেলের প্রায় পুরোটাই আনা হয় পরিশোধিত তেল হিসেবে, যার দাম আরও বেশি।
রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ শুরুর পর আন্তর্জাতিক বাজারে হু হু করে বাড়তে থাকে জ্বালানি তেলের দাম। ডিসেম্বরে অপরিশোধিত তেলের ব্যারেলপ্রতি দর ৬৫ ডলার থেকে বাড়তে বাড়তে মার্চে তা বেড়ে দাঁড়ায় ১২৪ ডলারে। এরপর সামান্য ওঠানামা করে বর্তমানে তা ১২০ ডলারের আশেপাশে বিক্রি হচ্ছে।
এর আগের কয়েক বছর বিপিসির জন্য সোনালি অধ্যায়ই বলা চলে। ভতুর্কির কারণে বছরের পর বছর লোকসান গোনা রাষ্ট্রায়ত্ত সংস্থাটি ২০১৪-১৫ থেকে ২০২০-২১ পর্যন্ত সাত অর্থবছরে জ্বালানি তেল বিক্রি করে মুনাফা করে প্রায় ৪৭ হাজার কোটি টাকা। সবশেষ (২০২১-২২) অর্থবছরের প্রথমার্ধেও ভালো মুনাফা করে বিপিসি।
বিপিসি জানায়, বর্তমানে দেশের জ্বালানি তেলের চাহিদা ৬৫ লাখ মেট্রিক টন। এর মধ্যে এক-চতুর্থাংশের কিছুটা কম তথা ১৫ লাখ মেট্রিক টন অপরিশোধিত তেল দেশে এনে ইস্টার্ন রিফাইনারিতে পরিশোধন করা হয়। এরপর তা থেকে বিভিন্ন ধরনের জ্বালানি যেমন- পেট্রল, অকটেন, ডিজেল, কেরোসিনসহ বিভিন্ন পেট্রোলিয়াম পণ্য উৎপাদন করা হয়। বাকি চাহিদা পরিশোধিত জ্বালানি তেল আমদানি করে মেটানো হয়।
এদিকে, আগের বছরগুলোতে তেলের পড়তি আন্তর্জাতিক বাজারে সরকার যেমন নিয়মিত দাম কমায়নি, তেমনি এখন অপরিশোধিত তেল ব্যারেলপ্রতি ১২০ ডলার ছাড়িয়ে গেলেও হুট করে দাম সমন্বয় করতে পারছে না। এতে বিপিসির এতদিনের বাড়তি মুনাফায় ভাটা দেখা দিয়েছে। এ অবস্থায় বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজসম্পদ প্রতিমন্ত্রী নসরুল হামিদ ঈদের আগে তেলের দাম বাড়ানোর ইঙ্গিত দেন। সেদিন সাংবাদিকদের তিনি বলেন, জ্বালানি তেলের দাম সমন্বয় করা হবে।
সেটা কবে নাগাদ হতে পারে সাংবাদিকদের এমন প্রশ্নে প্রতিমন্ত্রী বলেন, এখনও দেশের বাজারে যে তেল মজুত আছে সেটা তুলনামূলক কিছুটা কম দামে কেনা। ফলে জুলাইয়ের যে কোনো সময় দাম সমন্বয় করা হবে। তবে সেক্ষেত্রে মানুষের ওপর থেকে কীভাবে তেলের মূল্যবৃদ্ধির চাপ কমিয়ে আনা যায়, সে বিষয়ে ভাবছে সরকার।
নসরুল হামিদ বলেন, অতীতে দেখা গেছে, জ্বালানি তেলের মূল্যবৃদ্ধির কারণে গণপরিবহন ভাড়াসহ বিভিন্ন পণ্যের দাম অস্বাভাবিকভাবে বেড়েছে। যেখানে ৩০ পয়সা বাড়ার কথা সেখানে দুই টাকা বেড়েছে। ফলে মানুষের কষ্টও বেড়েছে। তাই এবার দাম বাড়ানোর আগে সব স্টেকহোল্ডারের সঙ্গে বৈঠক করা হবে। বিশেষ করে কার্গো মালিক, লঞ্চ মালিক, বাস মালিক ও বিআরটিএ’র সঙ্গে বৈঠক করা হবে।
এদিকে, বিপিসির লোকসানের অজুহাতে তেলের দাম বাড়ানোর উদ্যোগে আপত্তি জানিয়েছে কনজ্যুমার্স অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ (ক্যাব)। ক্যাবের জ্যেষ্ঠ সহ-সভাপতি ও জ্বালানি বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক এম শামসুল আলম বলেন, যদি তেলের দাম বাড়াতেই হয়, তবে বিপিসির উচিত হবে বাংলাদেশ এনার্জি রেগুলেটরি কমিশনের (বিইআরসি) কাছে নিজের লোকসানের হিসাব দিয়ে দাম বাড়ানোর যৌক্তিক কারণ উপস্থাপন করা। তা নাহলে জ্বালানি তেলে দাম বাড়ানোর উদ্যোগ অবৈধ হবে।
এ বিষয়ে বিপিসির চেয়ারম্যান এ বি এম আজাদ এনডিসি জাগো নিউজকে বলেন, বিপিসির লোকসান বর্তমানে মাসে গড়ে আড়াই হাজার কোটি টাকার মতো। প্রতিদিন হিসাব করলে তা ৮৩ কোটি টাকার বেশি। তবে জ্বালানির মূল্য সমন্বয়ের ব্যাপারটা সরকারের সিদ্ধান্তের বিষয়। বিপিসির চেয়ারম্যান হিসেবে আমার দায়িত্ব প্রতিষ্ঠানটির লাভ-ক্ষতির হিসাব সরকারকে জানানো। আমরা সেটাই করছি।
ঈদের পর তেলের দাম বাড়ানোর ইঙ্গিত দিয়েছিলেন প্রতিমন্ত্রী। মূল্যবৃদ্ধি কতটা হতে পারে এমন প্রশ্নে বিপিসির চেয়ারম্যান বলেন, কীভাবে সমন্বয় করা হবে সেটা সরকারের বিষয়। সরকারের কাছে যদি চাইতে হয়, তাহলে তো আমি চাইবো আমার পুরো খরচটাই যেন আমাকে দেওয়া হয়। কিন্তু সেটা তো বাস্তবসম্মত নয়।
তেলের মূল্যবৃদ্ধির বিষয়ে ক্যাবের প্রস্তাবনা প্রসঙ্গে জানতে চাইলে এ বি এম আজাদ বলেন, আমার সঙ্গে বিইআরসির কোনো সম্পর্ক নেই। সেটা সরকার যা করার করবে। ক্যাব একটা বেসরকারি প্রতিষ্ঠান, তারা যা বলে সে কথার প্রতি আপনাদের সম্মান আছে, আপনাদের মূল্যায়ন আছে। কিন্তু আমার ওপর তাদের কথা চাপিয়ে দিয়ে লাভ নেই। ক্যাব ইজ নট মাই কনসার্ন।
দাম বাড়াতে সরকারের কাছে বিপিসি কোনো চাহিদা জানিয়েছে কি না প্রশ্নে তিনি বলেন, আমাদের পক্ষ থেকে কোনো প্রস্তাব পাঠানো হয়নি। কোনো চাহিদার কথা জানানো হয়নি।
এমআইএস/কেএসআর/এসএইচএস/জেআইএম