দোষ ডাক্তারের না, আমার কপালের...


প্রকাশিত: ০২:৪৭ পিএম, ২৮ জানুয়ারি ২০১৬

ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের আইসিইউতে মৃত্যুর সঙ্গে পাঞ্জা লড়ছেন টাঙ্গাইলের করটিয়া সরকারি সাদাত বিশ্ববিদ্যালয় কলেজে ইংরেজি অনার্স শেষ বর্ষের ছাত্র জাকির হোসেন। জীবন মৃত্যুর সন্ধিক্ষণে রয়েছেন তিনি। গত রোববার থেকে আইসিইউতে ভেন্টিলেটর মেশিনে কৃত্রিম শ্বাস-প্রশ্বাসের মাধ্যমে তাকে বাঁচিয়ে রেখেছেন চিকিৎসকরা।

বৃহস্পতিবার আইসিইউর বাইরে এক মধ্যবয়সী মহিলাকে দুহাত তুলে মোনাজাত করতে দেখে জাগো নিউজের এ প্রতিবেদক কৌতুহলবশত তার কে ভর্তি রয়েছে প্রশ্ন করা মাত্রই সশব্দে কান্নায় ভেঙ্গে পড়েন মৃত্যু পথযাত্রী জাকিরের গর্ভধারিণী মা।

কান্নাজড়িত কণ্ঠে তিনি বলেন, আমি এক হতভাগিনী মা। শুনবেন আমার দুঃখ। উত্তরের অপেক্ষা না করেই বলতে শুরু করেন, গত ১০ মাস যাবত দুচোখের পাতা এক করতে পারি নাই। চিকিৎসকের ভুল চিকিৎসায় আমার ছেলে আজ মৃত্যুসজ্জায়।

তিনি জানান, তার তরতাজা ছেলে যার জীবনে একটা ইনজেকশনের সুই দেয়ারও প্রয়োজন পড়েনি। অথচ গত ১০ মাসে বড় ধরনের পাঁচটি অপারেশন হয়েছে। ধার-দেনা করে ছয়লাখ টাকা খরচ করেছেন। কিন্তু ছেলেকে বোধ হয় আর শেষ পর্যন্ত আর বাঁচাতে পারলাম না।

পরক্ষণেই তিনি বলেন, ‘ক্ষমা করবেন, দোষ ডাক্তারের না আমার কপালের।’ বিস্তারিত জানতে চাইলে তিনি জানান, তার স্বামী একজন সামান্য দিন মজুর। নুন আনতে পান্তা ফুরায়। জমি জমা কিছুই করতে পারেন নাই। তবে তাদের স্বপ্ন ছিল তিন ছেলেকে উচ্চ শিক্ষায় শিক্ষিত করবেন।

বড় ছেলে শিক্ষাঋণ করে পড়াশুনা করেছে। অ্যাকাউন্টিং এ অনার্স ও মাস্টার্সে ফার্স্ট ডিভিশন পায়। বর্তমানে ব্র্যাকে ম্যানেজার পদে চাকরি করছেন। দ্বিতীয় ছেলেকে শখ করে ইংরেজিতে অনার্সে ভর্তি করেন। সে শেষ বর্ষে পড়াশুনার পাশাপাশি স্থানীয় শাহিন ক্যাডেট ইংলিশ একাডেমিতে পার্টটাইম চাকরি করতো। ছোট ছেলে ম্যানেজমেন্টে অনার্সে ভর্তি হয়েছে।

তিনি বলেন, গ্রামের লোকজন প্রায়ই টিপ্পনি কেটে বলতো- ‘কিরে তুই কি  নিজে ব-কলম আর পোলাগরে বিদ্যান বানাইতাছস।’ কখনই কারও কথার প্রতিবাদ করি নাই। কোনদিন ছেলেদের গৃহশিক্ষক রাখতে পারি নাই। ওরা নিজেরা টিউশনি আর বাবার সামান্য রোজগারে পড়াশুনা করতো। সংসারের অভাব ঘুচতে যখন শুরু হয়েছে তখনই জীবনে অন্ধকার নেমে আসে।

১০ মাস আগে হঠাৎ করে জাকির হোসেন অসুস্থ হয়ে পড়ে। প্রচণ্ড পেটের ব্যথা নিয়ে টাঙ্গাইল সদর হাসপাতালে গেলে জনৈক হানিফ নামে এক সার্জারির ডাক্তার তার অস্ত্রোপচার করেন। ওই সময় তার প্রসাব পায়খানা করার জন্য বিকল্প পদ্ধতি ব্যাগ বাইরে বের করে দেন চিকিৎসকরা। তারা বলেন, তিনমাস পর সুস্থ হইয়া যাইব। বাড়িতে নিয়ে ছেলেকে ৫শ’ মুরগীর ডিম খাইয়েছেন বলেও জানান তিনি।

হতভাগিনী এই মা বলেন, অপারেশনের কয়েকদিন পর থার্ড ইয়ারের পরীক্ষা শুরু হয়। বিশেষ ব্যবস্থায় নাকে টিউব, রক্তের ব্যাগ ও প্রসাবের ব্যাগ হাতে নিয়ে পরীক্ষা দেয় জাকির। কিন্তু কোরবানির ঈদের ছেলে আবার অসুস্থ হয়ে পড়লে হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। ওই সময় ডাক্তার হানিফ হজে চলে গেলে জনৈক ডাক্তার বিপ্লবকে ফের অস্ত্রোপচারের পরামর্শ দিয়ে যান।

জাকির হোসেনের মায়ের ভাষ্যমতে ডা. বিপ্লব নিজে সেদিন অপারেশন না করে ছোট (জুনিয়র) ডাক্তারকে দিয়ে অস্ত্রোপচার করান। পরে তারা জানতে পারেন অপারেশনের সময় তার খাদ্যনালী কেটে ফেলা হলেও তা সঠিক জায়গায় জোড়া দেয়া হয়নি। পরবর্তীতে ডাক্তারের পরামর্শে ঢামেক হাসপাতালে ডাক্তার জামালউদ্দিনের কাছে ১৫দিন চিকিৎসা নেই।

ডাক্তার বলেন, এত তাড়াতাড়ি অপারেশন করলে শরীরে সইবে না। ওষুধপত্র খাইয়ে কিছুটা সুস্থ হলে বাড়ি নিয়ে যাই। কিন্তু কয়েকদিন পর আবার অসুস্থ হয়ে পড়ে।

Sick

তিনি বলেন, ‘এরপর আবার টাঙ্গাইল মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নিয়া আসি। সার্জারি বিভাগের প্রধান গোলাম মোস্তফা স্যারকে দেখানোর চেষ্টা করি। তার ধারেকাছে পিয়ন যাইবার দেয়না। পরে পিয়নের পরামর্শে ৫শ’ টাকা ভিজিট দিয়া দেখাইলে স্যার কয়, আবার সার্জারি কইরা খাদ্যনালি ঠিক করতে হইবো, ৫০ হাজার টাকা নিয়া আসো।

স্যার আমরা গরিব মানুষ ৫০ হাজার টাকা কই পামু কইতেই ধমক দিয়া কইল টাকা না থাকলে বাড়িত লইয়া যাও। ওর বাপে এই কথা শুনন্যা দাদন (ঋণ) কইরা ৫০ হাজার টাকা জোগাড় কইরা অপারেশন করাইল।’

কিন্তু ৩/৪দিন পরে আবার অসুস্থ হয়ে পড়লে গোলাম মোস্তফা স্যার টাঙ্গাইল মেডিকেল কলেজ নিয়ে যাওয়ার পরামর্শ দেন। সেখানে পরীক্ষা-নিরীক্ষার পর জানায়, তার হার্টে সমস্যা দেখা দিয়েছে। তাকে ঢাকা মেডিকেল কলেজে নিয়ে যাওয়ার পরামর্শ দেন।

জাকিরের মা আরো জানান, ‘ওই সময় অ্যাম্বুলেন্স ভাড়া কইরা ঢামেক হাসপাতালের ১৯ নম্বর ওয়ার্ডে আনলে ডাক্তাররা জানান, সিট খালি নাই। এই সময় ওয়ার্ডবয় আনোয়ার আমাগরে ধানমন্ডি নদার্ন হাসপাতালের আইসিইউতে ভর্তি কইরা দেয়।

তিন দিন তিন রাত পেটে ভাত নাই, ডাক্তাররা খালি ওষুধপত্রের সিলিপ দেয়, প্রতিদিন ভাড়া ৩০/৪০হাজার টাকা। ধার দেনা সাহায্য লইয়া ১ লাখ টাকা খরচ কইরা হাসপাতাল ছাড়ি। এক ডাক্তারের পরামর্শে আবার ঢামেক হাসপাতালে নিয়ে আসলে ডাক্তাররা কইলো নাড়ির জয়েন ছুইট্যা গেছে। অপারেশন করতে হইবো। তাড়াতাড়ি দুই ব্যাগ রক্ত জোগাড় কইরা আনেন। দেরি করলে বাঁচান যাইবো না।

অপারেশনের পর পোলাডা কিছুদিন ভালই ছিল। কিন্তু কয়েকদিন আগে কাঁশির চোটে অপারেশনের জায়গার সেলাই ছুটে যায়। ওই জায়গায় ইনফেকশন হইয়া রক্তপুজ বাইর হইতে থাকে।

গত রোববার আবার তার অস্ত্রোপচার হয়। ১৮ নম্বর ওয়ার্ডের প্রতাপ স্যার, এরফান স্যার, সামিয়া ম্যাডামসহ সব ডাক্তার, নার্সরা চাঁদা তুইল্যা সাহায্য করছে। ওইদিন থাইক্যা পোলা আমার আইসিইউতে আছে।’

এ প্রতিবেদকের সঙ্গে আলাপের শেষ পর্যায়ে তিনি বলেন, তার সব স্বপ্ন শেষ। টাকাও শেষ, টাকার অভাবে ছেলের মরণ চেয়ে চেয়ে দেখা ছাড়া তার সামনে কোনো পথ খোলা নেই বলে ফের কান্নায় ভেঙ্গে পড়লেন জাকির হোসেনের অসহায় মা।

এ বিষয়ে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের সার্জারি বিভাগের সহকারী অধ্যাপক ডা. হরিদাস সাহা প্রতাপ বলেন, টাঙ্গাইলে দুদফা অস্ত্রোপচারে ভুল হয়েছে কিনা তা তাদের পক্ষে বলা সম্ভব নয়। জাকির হোসেনের এপেনডিসাইটিস অপারেশনের সময় ক্ষুদান্ত্র ও বৃহদা্ন্ত্রের অংশবিশেষ কেটে জোড়া লাগানো হলেও পরবর্তীতে জোড়া ছুটে যায়। তাদের কাছে আসার পর অস্ত্রোপচারে রোগী বেশ সুস্থ হয়ে উঠেছিল। সম্প্রতি তার শ্বাসকষ্ট দেখা দেয়। তারা আইসিইউতে বেড ম্যানেজ করে অস্ত্রোপচার করেছেন। তবে রোগীর বর্তমান অবস্থা খুব খারাপ বলে জানান তিনি।

এমইউ/এসএইচএস/পিআর

পাঠকপ্রিয় অনলাইন নিউজ পোর্টাল জাগোনিউজ২৪.কমে লিখতে পারেন আপনিও। লেখার বিষয় ফিচার, ভ্রমণ, লাইফস্টাইল, ক্যারিয়ার, তথ্যপ্রযুক্তি, কৃষি ও প্রকৃতি। আজই আপনার লেখাটি পাঠিয়ে দিন [email protected] ঠিকানায়।