লোডশেডিংয়ে বেড়েছে চার্জার ফ্যান-সোলার প্যানেল বিক্রি
গ্যাস সংকটের কারণে বিদ্যুৎ উৎপাদন ব্যাহত হওয়ায় কয়েকদিন ধরে লোডশেডিংয়ের কবলে পড়েছে সারাদেশ। কোনো কোনো এলাকায় তীব্র আকার ধারণ করেছে লোডশেডিং। সারাদেশে তীব্র গরমের মধ্যে বিদ্যুৎ যাওয়া-আসার এ অবস্থা আরও অসহনীয় করে তুলেছে সাধারণ মানুষের জীবনযাত্রা। বিশেষ করে বৃদ্ধ, শিশু, অসুস্থ ব্যক্তিরা পড়েছেন বেশি বিপাকে। আবার বিদ্যুৎ সরবরাহ যে সহসাই স্বাভাবিক হচ্ছে না, সরকারের পক্ষ থেকেও তা বলা হয়েছে।
এ কারণে তীব্র গরম থেকে বাঁচতে বিকল্প পথ খুঁজতে শুরু করেছেন সাধারণ মানুষ। কয়েকদিন ধরে চার্জার ফ্যান ও সোলার প্যানেল কিনতে শুরু করেছেন তারা। হঠাৎ করে বিক্রি বেড়ে যাওয়ায় বাজারে সংকট দেখা দিয়েছে যেমন চার্জার ফ্যানের, দামও বেড়েছে ফ্যানের। একই সঙ্গে দাম বেড়েছে সোলার প্যানেলেরও।
অন্তঃসত্ত্বা স্ত্রীকে নিয়ে নারায়ণগঞ্জ থাকেন মো. সাইদুল হক। সম্প্রতি দেশের সব অঞ্চলে লোডশেডিং বেড়ে যাওয়ায় অন্যদের মতো বিপাকে পড়েছেন সাইদুলও। গরমে স্ত্রীকে নিয়ে চিন্তিত তিনি। স্ত্রীর কথা চিন্তা করেই চার্জার ফ্যান কিনতে বুুধবার (৬ জুলাই) নারায়ণগঞ্জ থেকে বঙ্গবন্ধু জাতীয় স্টেডিয়াম মার্কেটে আসেন। তবে কয়েকটি দোকান ঘুরেও ফ্যান পান না তিনি।
একটি দোকান থেকে বেরিয়ে আসার পর কথা হয় সাইদুলের সঙ্গে। তিনি জাগো নিউজকে বলেন, লোডশেডিংয়ের মাত্রা ইদানিং অনেক বেড়ে গেছে। আমার স্ত্রী অন্তঃসত্ত্বা। তাই দীর্ঘক্ষণ বিদ্যুৎ না থাকলে গরমে তা সমস্যা হয়। এ কারণে চার্জার ফ্যান কিনতে এসেছি।
একই মার্কেটে পুরান ঢাকা থেকে ফ্যান কিনতে আসা মো. মঞ্জু জাগো নিউজকে বলেন, কারেন্ট (বিদ্যুৎ) এত বেশি যায়, এখন চার্জার ফ্যান ছাড়া উপায় নেই। আগে তো এভাবে কারেন্ট যেতো না। কয়েকদিন ধরে ঘন ঘন কারেন্ট যায়। এ কারণে চার্জার ফ্যান কিনতে আসলাম, কিন্তু পেলাম না। সোলার প্যানেলের দাম জিজ্ঞাসা করে দেখলাম সেটাও মনে হয় আগে থেকে দাম বেড়েছে।
হানিফ নামে আরেকজন বলেন, বাসায় ছোট বাচ্চা আছে। বারবার বিদ্যুৎ চলে যাওয়ায় বেশ সমস্যা হচ্ছে। বাচ্চা কান্নাকাটি করে। আগে মাঝে মাঝে দু/একবার গেলেও সমস্যা হতো না। কিন্তু গত কয়েকদিন ধরে দিনে তিন থেকে চারবার বিদ্যুৎ চলে যায়। গরমে বাচ্চার সমস্যা হচ্ছে। তবে চাহিদা বাড়ায় চার্জার ফ্যানের দাম বেড়েছে বলেও জানান তিনি।
অনেকের মতো শহিদুল আলমও এসেছেন চার্জার ফ্যান কিনতে। এসময় কথা হয় তার সঙ্গে। তিনি বলেন, এক মাস আগেও আমার এক পরিচিত ভাই দুই হাজার টাকা দিয়ে চার্জার ফ্যান কিনেছেন। আজকে দোকানে এসে দেখি সেই একই ফ্যান তিন হাজার-সাড়ে তিন হাজার টাকা দাম চান দোকানিরা। তার মতো আরও কয়েকজন প্রায় একই কথা বলেন।
শুধ সাইদুলই নন, আরও অনেকেই লোডশেডিং থেকে বাঁচতে বিকল্প পথ বেছে নিচ্ছেন অনেকে। বুধবার (৬ জুলাই) রাজধানীর গুলিস্তান, নওয়াবপুর এলাকায় ফ্যানের দোকানগুলো ঘুরে চার্জার ফ্যানের ক্রেতাদের ভিড় দেখা যায়। তাদের মধ্যে কেউ চার্জার ফ্যান কিনতে এসেছেন, আবার কেউ এসেছেন সোলার প্যানেল। তবে দোকানগুলোতে চাহিদার তুলনায় চার্জার ফ্যানের সংখ্যা খুবই কম। কোনো কোনো দোকানে ফ্যানই নেই।
দোকানি ও ক্রেতাদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, গত কয়েকদিন ধরে অধিকাংশ ক্রেতাই চার্জার ফ্যান চাইছেন। কেউ কেউ সোলার প্যানেল চাইছেন। সোলার প্যানেলের তুলনায় চার্জার ফ্যান বিক্রি বেড়েছে। হঠাৎ করে চার্জার ফ্যানের চাহিদা বাড়ায় বেড়েছে দামও। আগে যেখানে দুই হাজার টাকায় এই ফ্যান বিক্রি হতো, তা এখন বিক্রি হচ্ছে তিন হাজারেরও বেশি টাকায়। তবে শুধু যে ক্রেতাদের বেশি দামে কিনতে হচ্ছে তাই নয়, বিক্রেতাদেরও বেশি দামে কিনতে হচ্ছে। আগে দোকানিরা যে ফ্যান এক হাজার ৮০০ টাকা থেকে এক হাজার ৯০০ টাকায় কিনতেন, এখন তা দুই হাজার ৬০০ টাকা থেকে দুই হাজার ৭০০ টাকায় কিনতে হচ্ছে।
চার্জার ফ্যানের চাহিদা ও দাম বাড়ার বিষয়ে বঙ্গবন্ধু জাতীয় স্টেডিয়াম মার্কেটের অপু ইলেকট্রনিক্স’র ম্যানেজার এবাদ উল্লাহ জাগো নিউজকে বলেন, দুই দিন আগেও কম দামে বিক্রি করেছি। এখন প্রতিটি চার্জার ফ্যানের দাম ৫০০ থেকে এক হাজার টাকা বেড়েছে। আমরাও এখন পাচ্ছি না। আগে যে চার্জার ফ্যান এক হাজার ৮০০ টাকা থেকে এক হাজার ৯০০ টাকায় কিনতাম, এখন সেগুলো দুই হাজার ৬০০ টাকা থেকে দুই হাজার ৭০০ টাকায়ও পাচ্ছি না। উৎপাদকরা জানান কারখানায় ফ্যান নেই।
মো. রবিউল ইসলাম নামের এক দোকানি বলেন, কয়েকদিন ধবে চার্জার ফ্যানের চাহিদা অনেক বেড়েছে। আবার মার্কেটে ফ্যানের সংখ্যাও কম। এ কারণে অনেকেই ফ্যান কিনতে চাইলেও পাচ্ছেন না।
আরেক দোকানি আনিসুর রহমান জাগো নিউজকে বলেন, চার্জার ফ্যানের চাহিদা বেড়েছে। অনেকেই ফ্যান কিনতে আসছেন। লোডশেডিং বাড়ার কারণেই চাহিদা বাড়ছে। অনেকে চাইলেও মার্কেটে ফ্যান খুবই কম। হঠাৎ করে দাম বাড়ায় অনেকেই কিনতে চাচ্ছেন, কিন্তু কোম্পানি থেকেও পাওয়া যাচ্ছে না।
এদিকে বিদ্যুৎ জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ মন্ত্রণালয় এবং বিদ্যুৎ উৎপাদন ও বিতরণকারী প্রতিষ্ঠান সূত্রে জানা গেছে, দেশে যে পরিমাণ গ্যাস সরবরাহ করা হয়, তার একটি বড় অংশই বিদ্যুৎ উৎপাদনে ব্যবহৃত হয়। এছাড়া সরকার খোলাবাজার থেকে তরলীকৃত প্রাকৃতিক গ্যাস কিনে বিদ্যুৎ উৎপাদনে ব্যয় করে। কিন্তু বিশ্ববাজারে বেড়েছে গ্যাসের দাম, আবার সরবরাহেও ঘাটতি আছে। এ কারণে বিদ্যুৎ উৎপাদনের জন্য প্রয়োজনীয় গ্যাস সরবরাহ করতে না পারায় বাধ্য হয়েই লোডশেডিং করছে সরকার। দেশে দিনে প্রায় ৩৭০ কোটি ঘনফুট গ্যাসের চাহিদার বিপরীতে গড়ে ৩০০ কোটি ঘনফুট সরবরাহ করা যেতো, কিন্তু বর্তমানে ২৭৫ থেকে ২৮০ কোটি ঘনফুট সরবরাহ করা হচ্ছে। বিদ্যুৎ উৎপাদনও কমেছে প্রায় দুই হাজার মেগাওয়াট।
বিদ্যুৎ সরবরাহ বিঘ্নিত হওয়ায় কয়েকদিন আগেই বিদ্যুৎ ও জ্বালানি প্রতিমন্ত্রী নসরুল হামিদ তার ফেসবুক পেজে বলেন, গ্যাস সরবরাহ স্বাভাবিক হলে বিদ্যুৎ উৎপাদন পুনরায় স্বাভাবিক হবে। রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের কারণে আন্তর্জাতিক বাজারে জ্বালানির উচ্চমূল্য ও সরবরাহ অন্যান্য সব দেশের মতো বাংলাদেশকেও সমস্যায় ফেলেছে। চলমান লোডশেডিংয়ের দুর্ভোগ বেশিদিন থাকবে না বলেও আশা প্রকাশ করেছেন তিনি।
নসরুল হামিদ বলেন, এ পরিস্থিতি খুব বেশিদিন থাকবে না আশা করি। এ বছরের মধ্যেই পায়রা তাপবিদ্যুৎকেন্দ্রের দ্বিতীয় ইউনিট, রামপাল বিদ্যুৎকেন্দ্র এবং ভারত থেকে ১৬০০ মেগাওয়াট আমদানি করা বিদ্যুৎ জাতীয় গ্রিডে যুক্ত হবে।
এ অবস্থায় সবাইকে বিদ্যুৎ সাশ্রয়ী হওয়ার আহ্বান জানিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী শেখে হাসিনা। লোডশেডিং বেড়ে যাওয়ার বিষয়ে প্রধানমন্ত্রী বলেন, আমাদের এখন একটাই উপায়, কখন, কোন এলাকায় বিদ্যুতের লোডশেডিং হবে সেটার একটা রুটিন তৈরি করা। যাতে মানুষ প্রস্তুত থাকতে পারে। মানুষের কষ্টটা যেন আমরা লাঘব করতে পারি। আমি আশা করি দেশবাসী আমাদের সহযোগিতা করবেন। সবাইকে আহ্বান করছি, প্রত্যেককে নিজ নিজ সঞ্চয় বাড়াতে হবে। খরচের ক্ষেত্রে মিতব্যয়ী হতে হবে। যতটুকু পারা যায় বিদ্যুৎ সাশ্রয়ী হতে হবে। বিদ্যুতের ব্যবহার কমাতে হবে।
বিদ্যুৎ সাশ্রয়ের লক্ষ্যে বিভিন্ন সামাজিক অনুষ্ঠান, কমিউনিটি সেন্টার, বিপণি-বিতান, দোকানপাট, অফিস-আদালত এবং বাড়িঘরে আলোকসজ্জা না করার জন্যও দেশবাসীর প্রতি আহ্বান জানিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা।
আরএসএম/ইএ/জেআইএম