হলি আর্টিসানের সেই বাড়ি এখনো সুনসান

তৌহিদুজ্জামান তন্ময়
তৌহিদুজ্জামান তন্ময় তৌহিদুজ্জামান তন্ময় , নিজস্ব প্রতিবেদক
প্রকাশিত: ০৮:৩০ এএম, ০১ জুলাই ২০২২

যে জঙ্গি হামলা কাঁপিয়েছিল গোটা বিশ্বকে তার সঙ্গে জড়িয়ে আছে রাজধানীর গুলশান-২ এর ৭৯ নম্বর সড়কের ৫ নম্বর বাড়িটি। সেইসঙ্গে জড়িয়ে আছে হলি ‘আর্টিসান বেকারি’নামটি। গুলশানের হলি আর্টিসান রেস্তোরাঁয় জঙ্গি হামলার ছয় বছর পূর্ণ হতে যাচ্ছে। ২০১৬ সালের ১ জুলাই রাতে জঙ্গি হামলায় ১৭ জন বিদেশিসহ নিহত হন মোট ২২ জন। তাদের মধ্যে দুইজন পুলিশ কর্মকর্তা। জঙ্গিদের গুলি ও বোমায় আহত হন পুলিশের অনেক সদস্য।

হামলার পর পরিত্যক্ত হয়ে যায় হলি আর্টিসান বেকারির ভবনটি। এরপর দীর্ঘদিন বাড়িটি আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাবাহিনীর নিয়ন্ত্রণে থাকার পর মালিককে বুঝিয়ে দেওয়া হয়। এরপরই মূলত সংস্কারের কাজে হাত দেন বাড়ির মালিক সাদাত মেহেদী।

বাড়িটি ছিল স্প্যানিশ খাবারের ক্যাফে-হলি আর্টিসান বেকারি। গুলশান লেকের তিরে দোতলা ভবনটির সামনে সবুজ লন উন্মুক্ত রেস্তোরাঁটি বিদেশিদের কাছে ছিল বেশ জনপ্রিয়। ২০১৬ সালের ১ জুলাই রাতে বদলে যায় সব। দেশের ইতিহাসে ভয়াবহ সেই জঙ্গি হামলার পর বাড়ির মালিক নিজেই সেখানে থাকার জন্য গুছিয়ে নিয়েছিলেন। কিন্তু এখনও দিনের অধিকাংশ সময় বাড়ির গেট থাকে বন্ধ।

জঙ্গি হামলা এবং তাদের দমনে সেনা কমান্ডোদের অভিযানের পর ভবনটির সীমানা দেয়াল ও বেকারির বেশিরভাগ অংশ ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছিল। নষ্ট হয়েছিল ভেতরে থাকা মালামালও।

jagonews24সেই বাড়ি এখনও সুনশান-ছবি জাগো নিউজ

নিরাপত্তাকর্মী-মালি সবমিলিয়ে প্রায় ১০ জন এ বাড়ি ও পাশের লেক ভিউ ক্লিনিকে দায়িত্ব পালন করলেও মালিকের নিষেধাজ্ঞার কারণে সেদিনের ঘটনা সম্পর্কে কেউই মুখ খুলছেন না। বাড়িটিতে প্রবেশেও রয়েছে নিষেধাজ্ঞা।

হলি আর্টিসান বেকারিতে ভয়াবহ সেই জঙ্গি হামলার পর মামলার গুরুত্বপূর্ণ আলামত হিসেবে কয়েক মাস আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর নিয়ন্ত্রণে ছিল বাড়িটি। ঘটনার পাঁচ মাস পর ওই বছরের নভেম্বরে বাড়িটি বুঝিয়ে দেওয়া হয় মালিক সামিরা আহমেদ ও তার স্বামী সাদাত মেহেদীকে।

জানা যায়, ১৯৭৯ সালে আবাসিক ভবন কাম ক্লিনিক গড়ে তোলার জন্য ডা. সুরাইয়া জাবিনকে বরাদ্দ দেওয়া হয়েছিল বাড়িটি। ১৯৮২ সালে ওই প্লটের একপাশে গড়ে তোলা হয় লেকভিউ ক্লিনিক। সুরাইয়ার মৃত্যুর পর প্লটের মালিক হন তার দুই মেয়ে সামিরা ও সারা আহমেদ। তাদের দুটি প্লট এক করে উত্তর পাশের দোতলা ভবনটিতে ২০১৪ সালে গড়ে তোলা হয় হলি আর্টিসান বেকারি, যা পরিচালানায় ছিলেন সাদাত মেহেদী ও তার এক বন্ধু। আর দক্ষিণ পাশে থাকে লেকভিউ ক্লিনিক।

জঙ্গি হামলার আগে বাড়িটির পূর্বপাশ ঘেঁষে গুলশান লেকের পাড় দিয়ে পায়ে পায়ে হাঁটার একটি রাস্তা ছিল, হামলার পর আইন-শৃঙ্খলা বাহিনী সেটি বন্ধ করে দেয়। এরপর তা আর খুলে দেওয়া হয়নি।

সম্প্রতি বাড়িটির সামনে গিয়ে দেখা গেল প্রধান গেটে কালো পোশাকধারী নিরাপত্তাকর্মীদের পাহারা। প্রতিবেদককে দেখে তাদের দুইজন নিরাপত্তাকর্মী এগিয়ে আসেন। বাড়িটির ভেতরে প্রবেশ করতে চাইলে মালিকের নিষেধ আছে বলেও জানান তারা।

নিরাপত্তাকর্মী নূর আলম জাগো নিউজকে বলেন, স্যার-ম্যাডাম এই বাড়ি থাকার উপযোগী করেছেন। ভেতরে বেশকিছু আসবাবপত্র বসানো হয়েছে। তারা এখন এখানে থাকেন। ভেতরে কাউকে প্রবেশ করতে দেওয়া হয় না।

jagonews24বাড়ির বাইরের বর্তমান দৃশ্য-ছবি জাগো নিউজ

মালিকের সঙ্গে কথা বলতে চাইলে তিনি বলেন, স্যার এখন নেই। তিনি এলেও কথা বলা সম্ভব না।

বাড়িটি আগের মতো থাকলেও বেকারিটি এখন আর এখানে নেই। এটি চলে গেছে অন্য ঠিকানায়। হামলার ৬ মাস পর গুলশান এভিনিউয়ের র‌্যাংগস আর্কেডের দ্বিতীয় তলায় নতুন ঠিকানায় নতুন পরিসরে চালু হয় হলি আর্টিসান বেকারি। নাম দেওয়া হয় ‘ওরো’। এখানে চালুর পর বেকারিটি ঠিক আগের মতো না চললেও ক্রেতাদের অধিকাংশ বিদেশি, যারা বিভিন্ন দেশের দূতাবাস বা বিদেশি প্রতিষ্ঠানে কর্মরত বলে বেকারির কর্মীরা জানান।

সেদিন যা ঘটেছিল

২০১৬ সালের ১ জুলাই দিনটি ছিল শুক্রবার। সন্ধ্যারাতে হঠাৎ করে খবর আসে গুলশানে ‘সন্ত্রাসীদের সঙ্গে’ পুলিশের গোলাগুলি হচ্ছে। সোশ্যাল মিডিয়ার মাধ্যমে জানা গেল এক রেস্টুরেন্টে সশস্ত্র হামলাকারী ঢুকে বেশ কয়েক জনকে জিম্মিও করেছে।

কিন্তু ঘটনাটা আসলে কী? গুজব নাকি সত্য- সেটি নিশ্চিত হতেও ঘণ্টাখানেক সময় চলে গেল। পরে জানা গেল হামলাকারীরা ওই রেস্টুরেন্টে থাকা বিদেশি নাগরিকসহ বেশ কয়েকজনকে জিম্মি করেছে। এক পর্যায়ে জানা যায় গুলশান ৭৯ নম্বর সড়কের হলি আর্টিসান বেকারিতে জঙ্গিরা হামলা চালিয়েছে।

জিম্মি সংকটের ঘটনায় ১ জুলাই সন্ধ্যারাত থেকে দিবাগত সারারাত অর্থাৎ ২ জুলাই সারা বিশ্বের গণমাধ্যমের নজর  ছিল ঢাকার অভিজাত গুলশান এলাকায় অবস্থিত হোলি আর্টিসান বেকারির দিকে।

গুলশানের পুলিশের সহকারী কমিশনার আশরাফুল করিম জানান, খবর পাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে গুলশান থানা পুলিশ ঘটনাস্থলে ছুটে যায়। রাত ৯টা ২০ মিনিটে ঘটনাস্থলে গোলাগুলির শব্দ শুনতে পান প্রত্যক্ষদর্শীরা। রাত সাড়ে ৯টার দিকে গোলাগুলিতে আহত হন বনানী থানার ওসি মোহাম্মদ সালাউদ্দীন। হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হয় তাকে।

jagonews24বাইরের সড়কও এমনই থাকে-ছবি জাগো নিউজ

রাত ১০টার দিকে পুলিশ, র্যাব এবং আধা সামরিক বাহিনী বর্ডার গার্ডস বাংলাদেশের কয়েকশো সদস্য ঘটনাস্থলে গিয়ে অবস্থান নেয়। গণমাধ্যম কর্মীরাও ৭৯নং রোডের মাঝামাঝি স্থানে অবস্থান নেন। রাত সোয়া ১১টার দিকে হাসপাতালে মারা যান বনানী থানার ওসি  মোহাম্মদ সালাউদ্দীন। এর কিছুক্ষণ পরই ডিবির সহকারী কমিশনার (এসি) মো. রবিউল করিম নিহত হন।

এর মধ্যে পুলিশের আইজিপি ঘটনাস্থল ও হাসপাতাল পরিদর্শন করেন। রাত সাড়ে ১১টার দিকে ঘটনাস্থলে র্যাবের তৎকালীন মহাপরিচালক বেনজীর আহমেদ সাংবাদিকদের জানান, হলি আর্টিসানের ভেতরে অন্তত ২০ জন বিদেশিসহ কয়েকজন বাংলাদেশিও আটকা পড়েছেন। ভেতরে যারা আছেন, তাদের জীবনের নিরাপত্তার জন্য তারা বিপথগামীদের সঙ্গে কথা বলতে চান।

রাত চারটা পর্যন্ত অস্ত্রধারীদের সঙ্গে কোনো যোগাযোগ স্থাপন করতে পারেনি আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যরা।

আইএসের দায় স্বীকার

রাতেই ইসলামিক স্টেট জঙ্গি গোষ্ঠী তাদের বার্তা সংস্থা বলে পরিচিত ‘আমাক’ এ গুলশান হামলার দায় স্বীকার করে ২০ জন নিহত হওয়ার কথা জানায়। আইএস এর পক্ষ থেকে হামলাকারীদের মধ্যে পাঁচজনকে তাদের ‘সৈনিক’ বলে দাবি করে, হামলার দায় নেয় তারা।

২ জুলাই অভিযানের ঘটনাক্রম

সকাল ৭টা ৩০ মিনিট: রাতভর গুলশানের হলি আর্টিসান রেস্টুরেন্ট সংলগ্ন এলাকা ঘিরে রাখার পর যৌথ সেনা, নৌ, পুলিশ, র্যাব এবং বিজিবির সমন্বয়ে যৌথ কমান্ডো দল গুলশানে অভিযানের চূড়ান্ত প্রস্তুতি নেয়।

৭টা ৪৫ মিনিট: কমান্ডো বাহিনী অভিযান শুরু করে। অস্ত্রশস্ত্রে সজ্জিত দলের সদস্যরা রেস্টুরেন্টের ভেতরে প্রবেশ করে। এ সময় গোলাগুলির শব্দ শোনা যায়।

সকাল সোয়া ৮টায় রেস্টুরেন্ট থেকে প্রথম দফায় নারী ও শিশুসহ ৬ জনকে বেরিয়ে আসতে দেখা যায়। পাশের একটি ভবন থেকে একজন বিদেশি নাগরিক তার মোবাইল ফোনে সেটি ধারণ করেন।

৮টা ৫৫ মিনিটে ভবনের নিয়ন্ত্রণ নেয় অভিযানকারীরা। গোয়েন্দা দল ভবনের ভেতর বিস্ফোরকের জন্য তল্লাশি শুরু করে। কিছুক্ষণ পরই আলামত সংগ্রহের কাজ শুরু করে গোয়েন্দারা।

jagonews24হলি আর্টিসান বেকারির দক্ষিণ পাশে লেকভিউ ক্লিনিক-ছবি জাগো নিউজ

৯টা ১৫ মিনিটে অভিযান শেষ হয়। কমান্ডো অভিযানের মধ্য দিয়ে ঢাকার গুলশানের হলি আর্টিসান বেকারিতে প্রায় ১২ ঘণ্টার রক্তাক্ত জিম্মি সংকটের অবসান হয়।

‘অপারেশন থান্ডারবোল্ট’  নামে সেনাবাহিনীর কমান্ডোরা যে অভিযান চালায় সেখানে জঙ্গি হামলায় সরাসরি অংশ নেয়া পাঁচ তরুণের সবাই মারা পড়েন। তারা হলেন- মীর সামেহ মোবাশ্বের, রোহান ইবনে ইমতিয়াজ ওরফে মামুন, নিবরাজ ইসলাম, খায়রুল ইসলাম পায়েল ও শফিকুল ইসলাম উজ্জ্বল।

সকাল ১০টায় ৪ জন বিদেশিসহ ১৩ জন জীবিত উদ্ধারের খবর জানানো হয়। রেস্টুরেন্টের ভেতরে অজ্ঞাত পাঁচজনের মরদেহ পাওয়ার কথা পুলিশ জানায়।

বেলা ১১টা ৫০ মিনিট: অভিযানে জঙ্গিদের ৬ জন নিহত এবং একজন ধরা পড়েছে বলে নিশ্চিত করা হয়।

টিটি/এসএইচএস/জিকেএস

নিরাপত্তাকর্মী-মালি সবমিলিয়ে প্রায় ১০ জন এ বাড়ি ও পাশের লেক ভিউ ক্লিনিকে দায়িত্ব পালন করলেও মালিকের নিষেধাজ্ঞার কারণে সেদিনের ঘটনা সম্পর্কে কেউই মুখ খুলছেন না। বাড়িটিতে প্রবেশেও রয়েছে নিষেধাজ্ঞা।

স্যার-ম্যাডাম এই বাড়ি থাকার উপযোগী করেছেন। ভেতরে বেশকিছু আসবাবপত্র বসানো হয়েছে। তারা এখন এখানে থাকেন। ভেতরে কাউকে প্রবেশ করতে দেওয়া হয় না।

পাঠকপ্রিয় অনলাইন নিউজ পোর্টাল জাগোনিউজ২৪.কমে লিখতে পারেন আপনিও। লেখার বিষয় ফিচার, ভ্রমণ, লাইফস্টাইল, ক্যারিয়ার, তথ্যপ্রযুক্তি, কৃষি ও প্রকৃতি। আজই আপনার লেখাটি পাঠিয়ে দিন [email protected] ঠিকানায়।