‘বাসস্থানে সাবানের টুকরা-মরিচপোড়া রেখে সাপ তাড়ানো যায় না’
‘ফেসবুকে অনেককে আমরা দেখছি যে বাসস্থানে লাইফবয় সাবান কেটে রাখা, মরিচপোড়া বা কার্বলিক অ্যাসিড রাখলে সাপ আসবে না বলে প্রচার করছেন। এগুলো কোনো কাজে আসবে না। এটা সম্পূর্ণ অবৈজ্ঞানিক পদ্ধতি। বিজ্ঞানে এর কোনো ভিত্তি নেই। মশারি টাঙানোটাই একমাত্র পদ্ধতি। মরিচপোড়াসহ এগুলো সব ফেক। এভাবে কখনো সাপ তাড়ানো যায় না। ফেসবুকে মানুষ এসব দিচ্ছে এবং মারাত্মক আকারে এগুলো শেয়ার করছে। এজন্য মানুষ ভুল জিনিসগুলো জানছে। এগুলো ফলো করতে গেলে মানুষ মারা যাওয়ার সম্ভাবনা থাকবে।’
বন্যাদুর্গত এলাকার মানুষ সাপের উপদ্রপ থেকে কীভাবে রক্ষা পাবে, সাপে কাটলে কী করবে, কী করা উচিত নয়- এসব বিষয়ে জাগো নিউজের সঙ্গে আলাপকালে একথা বলেন সরীসৃপ ও বন্যপ্রাণী বিশেষজ্ঞ আদনান আজাদ আসিফ।
সাপ সচরাচর গর্তে থাকা একটা প্রাণী উল্লেখ করে তিনি বলেন, এরা অন্ধকারে নিজেদের লুকিয়ে রাখে। সেটা নির্বিষ ঢোঁড়া সাপ থেকে গোখরা পর্যন্ত- সব সময় মানুষের কাছ থেকে আড়াল করে রাখে। শুধু মানুষ নয়, সূর্যের তাপ বা আলো থেকে বাঁচার জন্য নিজেদের আড়াল করে রাখে। আমাদের দেশের বেশিরভাগ সাপই নিশাচর, দিনে এরা গর্তে থাকে। সেটা মাটির গর্ত হতে পারে, গাছের গুঁড়ির গর্ত হতে পারে, আমরা অনেক ইট রাখি, জিনিসপত্র বা কোনো কিছু স্তূপ করে রাখি সেটা, বাড়ির পুরোনো প্রাচীরের কোনো গর্তেও থাকতে পারে।
‘এসব জায়গা এখন বন্যার পানি দিয়ে পরিপূর্ণ। এ কারণে যে সাপ লুকিয়ে ছিল, তারাও এখন নিজের জীবন বাঁচানোর জন্য একটি আশ্রয় খুঁজছে। সেটা অবশ্যই শুকনো ও উঁচু জায়গা। এসব জায়গাও এখন মানুষের আশ্রয়স্থল। এজন্য সাপ নিজে থেকে না চাইলেও জীবন রক্ষার জন্য উঁচু জায়গায় যাবে, যেখানে মানুষের বসতি। এসময় মানুষের সঙ্গে তাদের একটা মারাত্মক কনফ্লিক্ট হতে পারে। সেটা হলে সাপের কামড়ে মানুষ আক্রান্ত হতে পারে বা মানুষের কারণে সাপের মৃত্যু হতে পার।’
গর্তে লুকিয়ে আছে সাপ/আদনান আজাদ আসিফ
সাপ থেকে সতর্ক থাকার প্রধান উপায় মশারি টাঙিয়ে ঘুমানো জানিয়ে তিনি বলেন, সাপ নিজে বাঁচার জন্য মানুষের কাছে চলে আসবে। যে জায়গায় মানুষ ঘুমাবে সে জায়গাটা উঁচু ও শুকনো জায়গা। তাই সাপও সেখানে আশ্রয় নিতে চাইবে। মশারি শুধু টাঙালে হবে না, গুঁজে ঘুমাতে হবে। অনেকে আছেন মশারি না গুঁজে ঘুমান, সেটা করলে হবে না। এসময় আশ্রয়কেন্দ্র বা ঘরে জুতা পরার সময় বা হাঁড়ি-পাতিল, বাটি স্পর্শ করার আগে ভালো করে দেখে নিতে হবে সেখানে সাপ আছে কি না।
‘বাটি, গামলা, বিস্কুটের টিন, বয়াম এসব স্পর্শ করার আগে ভালো করে দেখে নিতে হবে। কোনো কিছু স্তূপ করে রাখা থাকলে সেটা দোতলা, তিনতলা যেখানেই হোক, সেখান থেকে কোনো জিনিসপত্র বের করার সময় সতর্ক থাকতে হবে, লাঠির সাহায্য নিতে হবে। সরাসরি হাত দিয়ে সরানো যাবে না। অন্ধকার স্থান দিয়ে কোনোভাবেই হাঁটা যাবে না। লাইট ব্যবহার করতে হবে। এছাড়া কোনো বিকল্প নেই।’
যদি কেউ সাপের কামড়ে আক্রান্ত হন তাহলে করণীয় প্রসঙ্গে এই বিশেষজ্ঞ বলেন, দেরি না করে তাকে অবশ্যই জেলা সদর হাসপাতালে নিতে হবে। অন্য কোনো হাসপাতালে সাপের কোনো চিকিৎসা হয় না। জেলার যে প্রধান হাসপাতাল আছে সেখানে যেতে হবে।
‘প্রাথমিকভাবে যেটা করতে হবে সেটা হলো কোনো খাবার খাওয়া যাবে না, কোনো ধরনের উত্তেজনা থাকা যাবে না, সোজা কথায় আতঙ্কিত হওয়া যাবে না। মানুষ আতঙ্কিত হলে রক্ত চলাচল কয়েকগুণ বেড়ে যায়। এতে বিষ তাড়াতাড়ি ছড়িয়ে যেতে পারে। সাপে কাটা ব্যক্তিকে কোনোভাবে ঘুমাতে দেওয়া যাবে না। কোনোভাবে যদি ঘুমিয়ে পড়েন তাহলে তার আর জেগে ওঠার সম্ভাবনা কম থাকে। আক্রান্তকে যত দ্রুত পারা যায় সদর হাসপাতালে নিতে হবে।’
রাসেল ভাইপারের সঙ্গে আদনান আজাদ আসিফ
আদনান বলেন, সাপে কাটলেই মানুষ মারা যায় না। সাপ বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই ড্রাই বাইট করে, মানে বিষ ঢালে না। ৪০-৫০ শতাংশ ক্ষেত্রে বিষ ঢালে না। কামড় দেবে কিন্তু বিষ ঢালবে না। এজন্য আতঙ্কিত হওয়া যাবে না। আতঙ্কিত হলে হার্ট অ্যাটাক হয়ে মারা যেতে পারে রোগী।। মাথা ঠান্ডা রাখতে হবে। অন্যদের বোঝাতে হবে সাপে কাটলে সমস্যা নেই, সঠিক সময়ে চিকিৎসা নিলে সেরে উঠবে। এখন বিজ্ঞান অনেক এগিয়ে গেছে। ভুল করেও কেউ যেন কোনো ওঝা বা সাপুড়ের কাছে না যায়। এতে বিপদ ঘটার আশঙ্কা থাকে।
তিনি বলেন, হাতে বা পায়ে দড়ি দিয়ে তাগা বাঁধা যাবে না। এটাও একটা অবৈজ্ঞানিক পদ্ধতি। এতে দেখা যায় অনেক সময় রক্ত চলাচলে ব্যাঘাত ঘটে। পরে রোগী সুস্থ হলেও তার হাত-পা কেটে ফেলতে হতে পারে গ্যাঙ্গরিন হয়ে যেতে পারে। আশপাশের লোকজনও যেন আতঙ্কিত না হয়। অনেক সময় নির্বিষ সাপ কামড় দিলেও মানুষ মারা যায় আতঙ্কে। যতটা সম্ভব নিজেকে শান্ত হতে হবে।
এই প্রাণী বিশেষজ্ঞ অনুরোধ করেন, বন্যার সময় যদি সাপ সামনে পড়ে যায়, না মেরে বন বিভাগকে খবর দিতে বা সম্ভব হলে ৯৯৯-এ ফোন দিতে। তাহলে সাপ রেসকিউ করার টিম পাঠাবে। মানুষ সাপকে আক্রমণ করতে গিয়ে বেশি আক্রান্ত হয়। এটা করা যাবে না। সাপ দেখলে তার থেকে দূরে থাকতে হবে।
আদনান আজাদ আসিফ আরও বলেন, সিলেট হলো বন্যপ্রাণীসমৃদ্ধ একটি বিভাগ। এখানে উল্লুকের মতো বিশ্বব্যাপী বিপন্ন প্রাণী থেকে শুরু করে হনুমান, বানরসহ অনেক সরীসৃপও আছে। আমার ধারণা অনেক প্রাণী এরই মধ্যে মারা গেছে। পাশাপাশি সাধারণ যে প্রাণী আছে কুকুর, বিড়াল এদের অবস্থাও খুবই খারাপ, যারা ডাস্টবিনের খাবার খেতো। কুকুর তো উঁচু জায়গায়ও উঠতে পারে না। যারা বানর গোত্রীয় প্রাণী তারা হয়তো কিছুদিন নিজেকে টিকিয়ে রাখতে পারবে, কিন্তু অন্যরা তাও পারবে না। কেউ যদি দেখে কোনো প্রাণী, আহত বা বিপন্ন তারা যেন বন বিভাগকে জানায়।
এএসএ/জিকেএস