সীতাকুণ্ড ট্র্যাজেডি: দিন গড়াতেই বেরিয়ে আসছে ক্ষয়-ক্ষতির ব্যাপকতা

সাইফুল হক মিঠু
সাইফুল হক মিঠু সাইফুল হক মিঠু
প্রকাশিত: ০৯:২০ এএম, ১১ জুন ২০২২
বিস্ফোরণের পর বিধ্বস্ত সীতাকুণ্ডের বিএম কন্টেইনার ডিপো

অডিও শুনুন

চট্টগ্রামের সীতাকুণ্ডে বিএম কনটেইনার ডিপোতে বিস্ফোরণ ও অগ্নিকাণ্ডের ঘটনায় জানমালের ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে। এখনো ক্ষয়ক্ষতির সঠিক পরিমাণ নির্ণয় করা সম্ভব না হলেও তা দেড় হাজার কোটি টাকা ছাড়াতে পারে বলে ধারণা করা হচ্ছে। ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ নির্ণয়ে কাজ করছে বিভিন্ন সংগঠন ও একাধিক সরকারি সংস্থা।

দেশের ইতিহাসে দীর্ঘতম এ অগ্নিকাণ্ডে এ পর্যন্ত ৪৬ জনের মৃত্যু হয়েছে। এছাড়া আহত হয়েছেন দুই শতাধিক মানুষ। নিহত ব্যক্তিদের মধ্যে ফায়ার সার্ভিসের সদস্য নয়জন। বিস্ফোরণের ঘটনায় কর্তৃপক্ষের অবহেলাজনিত কারণ উল্লেখ করে পুলিশের পক্ষ থেকে আটজনের বিরুদ্ধে মামলা করা হয়েছে। কনটেইনার ডিপোর মালিক ও স্মার্ট গ্রুপের পরিচালক মজিবুর রহমানকে গ্রেফতারের দাবি করেছে বিভিন্ন শ্রমিক সংগঠন।

তবে মজিবুর রহমান জানিয়েছেন, বিস্ফোরণের পর মানসিকভাবে ভেঙে পড়েছেন তিনি। পাশাপাশি এই দুর্ঘটনায় স্মার্ট গ্রুপের ব্যাপক আর্থিক ক্ষতি হয়েছে বলে দাবি করেন তিনি। মজিবুর রহমান বলেন, ডিপোতে অগ্নিকাণ্ডে আমার ক্ষতি হাজার কোটি টাকা ছাড়িয়ে গেছে। আমার সব শেষ। তবে আমি আহত ও নিহতদের পরিবারের পাশে আছি।

jagonews24

বিস্ফোরণের পর বিএম কনটেইনার ডিপো জ্বলছে

সংশ্লিষ্টরা জানিয়েছেন, বিস্ফোরণের ৬১ ঘণ্টা পর মঙ্গলবার (৭ জুন) বেলা ১১টায় আগুন নিয়ন্ত্রণে আসে। যদিও তারপরও থেমে থেমে কিছু বিস্ফোরণের ঘটনা ঘটেছে বলে সংশ্লিষ্টরা জানিয়েছেন। তারা জানান, দুর্ঘটনার পর পুরো সীতাকুণ্ড এলাকা যেন যুদ্ধক্ষেত্র। চারদিকে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে আছে আগুনে পোড়া ধ্বংসাবশেষ। পুড়ে যাওয়া পোশাক, লোহা, প্যাকেট ছড়িয়ে-ছিটিয়ে পড়ে আছে। ২৬ একর জায়গাজুড়ে অবস্থিত ডিপোর এক-তৃতীয়াংশ কনটেইনার ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে বলে জানিয়েছেন সংশ্লিষ্টরা। সেখানে চার হাজারের বেশি কনটেইনার ছিল বলে জানা গেছে।

ওই ডিপোতে থাকা কনটেইনারের প্রায় সবগুলোতেই ছিল রপ্তানিমুখী গার্মেন্ট পণ্য। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, বিএম কনটেইনার ডিপোর প্রায় সব কনটেইনারই পণ্যভর্তি ছিল। যার মধ্যে বেশি ছিল গার্মেন্টস পণ্য। অধিকাংশই ছিল রপ্তানির জন্য একেবারে প্রস্তুত অবস্থায়। গার্মেন্টসের কাঁচামালসহ কনটেইনারভর্তি রপ্তানির জন্য প্রস্তুত পণ্য এবং আমদানি করা পণ্য পুড়ে ছাই হয়ে গেছে। প্রাথমিকভাবে ধারণা করা হচ্ছে, অগ্নিকাণ্ডে ১৫ কোটি ডলার বা প্রায় দেড় হাজার কোটি টাকার পণ্য পুড়েছে। এর মধ্যে আরএমজি (তৈরি পোশাক) পণ্যই পুড়েছে এক হাজার কোটি টাকার বেশি।

এ বিষয়ে বিজিএমইএর সহ-সভাপতি শহিদুল্লাহ আজিম জাগো নিউজকে বলেন, বিএম কনটেইনার ডিপোতে ভয়াবহ আগুনে ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি ও প্রাণহানির ঘটনায় আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ন হবে। রানা প্লাজা দুর্ঘটনার পর আরও একটি বড় ধাক্কার মুখে পড়লো পোশাকখাত। এতে ক্রেতাদের কাছে নেতিবাচক বার্তা যাবে, আমরা এ ঘটনায় উদ্বিগ্ন।

jagonews24

আগুন নেভাতে কাজ করছেন ফায়ার সার্ভিসের কর্মীরা

তিনি আরও বলেন, কী পরিমাণ ক্ষতি হয়েছে তা এখনই সঠিকভাবে বলা যাচ্ছে না। বিজিএমইএ সব সদস্যকে চিঠি দিয়েছে। জানতে চেয়েছে কার কী পরিমাণ ক্ষতি হয়েছে। তবে প্রাথমিকভাবে ধারণা করছি, এ ঘটনায় শুধু তৈরিপোশাক খাতে এক হাজার কোটি টাকার বেশি ক্ষতি হয়েছে।

পোশাক খাতের আরেক সংগঠন বিকেএমইএর সহ-সভাপতি ফজলে এহসান শামীম জাগো নিউজকে বলেন, কী পরিমাণ ক্ষতি হয়েছে তা নিরূপণে কাজ করছি। সম্পূর্ণ রিপোর্ট এখনও পাইনি। কী পরিমাণ কার্টন পুড়েছে, কী পরিমাণ অক্ষত আছে- তা এখনও জানতে পারিনি। তৈরিপোশাক ছাড়া অন্যান্য পণ্যও ছিল।

বাংলাদেশ ইনল্যান্ড কনটেইনার ডিপো অ্যাসোসিয়েশনের (বিকডা) সচিব রুহুল আমিন সিকদার বিপ্লব বলেন, প্রাথমিকভাবে ধারণা করা হচ্ছে, বিএম ডিপোতে অগ্নিকাণ্ডে ১০০ মিলিয়ন ডলারের বেশি মূল্যের পণ্য পুড়েছে।

বিএম কনটেইনার ডিপোতে দুর্ঘটনার সময়ে সাড়ে চার হাজারেরও বেশি কনটেইনার ছিল জানিয়ে তিনি বলেন, এসবের মধ্যে অন্তত ১৩০০ কনটেইনারে আমদানি ও রপ্তানিপণ্য ছিল।

পরিবেশ ও স্বাস্থ্যগত ক্ষতিও কম না
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, সীতাকুণ্ডের বিভীষিকার পর চট্টগ্রামের চরম নিরাপত্তাহীনতার বিষয়টি ফের সামনে এসেছে। বিএম কনটেইনার ডিপোতে ‘হাইড্রোজেন পারঅক্সাইড’ নামের বিপুল পরিমাণ রাসায়নিক সহ অন্যান্য রাসায়নিক থাকার কথা জানা গেছে। অগ্নিকাণ্ডের ঘটনায় আগুন, উত্তাপ ও ধোঁয়া প্রত্যক্ষভাবে ছড়িয়েছে আড়াই বর্গকিলোমিটার এলাকাজুড়ে। আর এর দূরবর্তী প্রভাব পড়েছে সীতাকুণ্ডের ১০ বর্গকিলোমিটার এলাকায়।

jagonews24

দুর্ঘটনাস্থল থেকে মরদেহ উদ্ধার করছেন ফায়ার সার্ভিসের কর্মীরা

বিস্ফোরণের পর পুরো এলাকায় কেমিক্যালের বিষাক্ত ধোঁয়া ছড়িয়ে পড়ে। ফায়ার সার্ভিসের সদস্যসহ ঘটনাস্থলে আসা লোকজনের চোখ খুলতে ও নিশ্বাস নিতে কষ্ট হয়েছে। অনেককেই মুখে কাপড় বেঁধে বসে থাকতে দেখা যায়। বিস্ফোরণে স্বাস্থ্যহানির পাশাপাশি পরিবেশের ব্যাপক ক্ষতি হয়েছে বলে বিশেষজ্ঞরা জানিয়েছেন। তবে সেই ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ জানতে আরও কয়েক সপ্তাহ অপেক্ষা করা লাগতে পারে।

মহাখালী জাতীয় বক্ষব্যাধি ইনস্টিটিউট ও হাসপাতালের সহকারী অধ্যাপক ও আবাসিক চিকিৎসক ডা. সিরাজুল ইসলাম জানান, ঘটনাস্থলে মানুষ মারা যাওয়ার পেছনে সবচেয়ে বড় যে কারণ- বিস্ফোরণস্থলে যারা ছিলেন তারা নিঃশ্বাসের সঙ্গে কার্বন ডাই অক্সাইড ও কার্বন মনোক্সাইড গ্রহণ করেছেন। দগ্ধ হওয়ার পূর্বে ওই গ্যাস গ্রহণের ফলে হঠাৎ করেই তাদের অনেকের মৃত্যু হয়েছে। ওই দুর্ঘটনায় যারা আহত হয়েছেন তাদের শরীরে চর্মরোগ বা অন্যান্য সমস্যা হতে পারে। এছাড়া শ্বাসতন্ত্রের প্রদাহ, শ্বাসনালী চিকন হওয়া ও শ্বাসকষ্টের সমস্যা দেখা দিতে পারে।

কার্বন মনোক্সাইড ও কার্বন ডাই অক্সাইডের দীর্ঘ মেয়াদি প্রভাব কম, তবে এর কারণে হঠাৎ মৃত্যু হতে পারে। বাতাসে কার্বন ডাই অক্সাইড ও কার্বন মনোক্সাইড যতটুকু থাকা দরকার তার থেকে যদি বেশি হয় তাহলে তাহলে আমাদের শরীরে যে অক্সিজেনের মাত্রা রয়েছে তাতে অসামঞ্জস্যতা দেখা দেবে। এতে কারও কারও ঝিমুনি দেখা দিতে পারে।

ভয়াবহ এ বিস্ফোরণে পরিবেশের ক্ষতি প্রসঙ্গে স্টামফোর্ড ইউনিভার্সিটির পরিবেশ বিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক ড. আহমদ কামরুজ্জামান মজুমদার জাগো নিউজকে বলেন, সায়েন্টেফিক মনিটরিং বা সার্ভে ছাড়া ক্ষতির বিষয়টা বলা যাবে না। এ জন্য এ বিষয়ে মন্তব্য করা হবে ‘টু আর্লি’। যখন আগুনে কোনো কিছু পোড়ে, তখন সেটার উপযাচক হিসেবে কোনো না কোনো দূষিত কেমিক্যাল তৈরি হয়। হাইড্রোজেন পার অক্সাইড পুড়ে যাওয়ায় আশেপাশে একটা ঝাঁঝালো পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়েছে বলে জানা গেছে। কয়েকজন অসুস্থ হয়ে গেছে বলে জেনেছি। যেহেতু কিছু লক্ষণ আছে, পরিবেশ ও জনস্বাস্থ্যের বিপর্যয় আসতে পারে এমন সম্ভাবনা একদম উড়িয়ে দেওয়া যায় না। তবে ক্ষতির দিকগুলো বের করতে আরও সময় ও গবেষণা প্রয়োজন।

এসএম/কেএসআর/এমএস

পাঠকপ্রিয় অনলাইন নিউজ পোর্টাল জাগোনিউজ২৪.কমে লিখতে পারেন আপনিও। লেখার বিষয় ফিচার, ভ্রমণ, লাইফস্টাইল, ক্যারিয়ার, তথ্যপ্রযুক্তি, কৃষি ও প্রকৃতি। আজই আপনার লেখাটি পাঠিয়ে দিন [email protected] ঠিকানায়।