যশোরে বাণিজ্যিকভাবে গড়ে উঠছে খেঁজুর বাগান


প্রকাশিত: ১১:৩৩ এএম, ২৪ জানুয়ারি ২০১৬

‘যশোরের যশ খেঁজুরের রস’ প্রাচীন বাংলার এই ঐতিহ্য যখন হারিয়ে যেতে বসেছে ঠিক তখন অতীত ঐতিহ্য ফিরিয়ে আনতে বাণিজ্যিক ভাবে যশোর জেলার বিভিন্নস্থানে খেঁজুর গাছের চারা ও বীজ লাগানো হচ্ছে। তৈরি করা হচ্ছে পরিকল্পিত খেজুর বাগান।

শার্শা উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা হীরক কুমার সরকার বলেন, দেশের কোথাও বাণিজ্যিকভাবে খেঁজুর গাছ লাগানোর নজির না থাকলেও শার্শা উপজেলার বিভিন্নস্থানে কৃষকদের উদ্বুদ্ধ করে খেঁজুর গাছ লাগানো হচ্ছে। এর সুফলও তারা পেতে শুরু করেছেন। বাজারে রস গুড় পাটালির চাহিদা ও দাম বেশি থাকায় এখন অনেকেই এই চাষে ঝুঁকছেন।

যশোর কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতরের উপ-পরিচালক নিত্য রঞ্জন বিশ্বাস বলেন, জেলায় প্রায় ১০ লাখ খেঁজুর গাছের মধ্যে ৬ লাখ ৭৫ হাজার গাছ থেকে রস আহরণ করা হয়। ইট ভাটাসহ নানা প্রতিকূলতায় খেঁজুুর গাছ কমে যাচ্ছে। অতীতে এই সংখ্যা ছিল এর কয়েকগুণ বেশি। তবে আশার কথা নতুন করে খেঁজুর বাগান তৈরির জন্য কৃষি বিভাগ যশোরে কাজ করে যাচ্ছে।

এক সময় খেঁজুর গাছ থেকে রস আহরণ ও গুড় পাটালি তৈরি একটি লাভজনক ব্যবসা ছিল। এখন আর এই অঞ্চলে আগের মতো খেঁজুর গাছও নেই, নেই দক্ষ গাছি, গুড় পাটালি তৈরির কারিগর।

শার্শা উপজেলা বনবিভাগের রেঞ্জার নজরুল ইসলাম বলেন, যশোর অঞ্চলের শত বছরের এই ঐতিহ্যটি ধীরে ধীরে যখন হারিয়ে যেতে বসেছে ঠিক তখনই বন বিভাগের উদ্যোগে ২০০৯ সালে বেশ কিছু খেঁজুর গাছ রোপন করা হয়। বৃহত্তর যশোর জেলার জীববৈচিত্র্যের সংরক্ষণ ও প্রাকৃতিক পরিবেশ উন্নয়ন প্রকল্পের আওতায় প্রায় সাড়ে ৩ লাখ খেঁজুর গাছের চারা লাগানো হয়েছে।

বাজারে রস, গুড় ও পাটালির দাম বেশি হওয়ায় ভাগ্য ফেরানোর আশায় সম্পূর্ণ ব্যক্তি উদ্যোগে শার্শার জিরেনগাছা ও মাটিপুকুর গ্রামে তিন বছর আগে লাগানো হয় খেঁজুর গাছের চারা। মাঠজুড়ে খেঁজুর গাছের সমারোহ। এর সুফলও তারা ইতোমধ্যে পেতে শুরু করেছেন। খেঁজুর গাছ লাগিয়ে ভাগ্য ফিরেছে ওই গ্রামের জয়নাল আবেদীন, আক্তারুজামান, ইয়াকুব আলী, কামাল হোসেন, আইয়ুব হোসেনসহ শতাধিক চাষির।

জিরেনগাছা গ্রামের আক্তারুজামান জানান, তিন বছর আগে পরীক্ষামূলকভাবে দেড় বিঘা জমিতে ৭৮টি খেজুর গাছ লাগিয়েলাম। এখন তার সুফল পাচ্ছি। রস, গুড় ও পাটালি বিক্রি করে সংসারে সুদিন ফিরেছে।

ওই গ্রামের জয়নাল আবেদীন জানান, শীতে এখন খেঁজুরের রস বিক্রি হচ্ছে প্রতি ভাড় একশ টাকা আর গুড় ও পাটালি বিক্রি হচ্ছে দেড়শ থেকে দুইশ কুড়ি টাকা কেজি দরে। গাছ লাগিয়ে এর সুফল আমরা পেতে শুরু করেছি।

Benapole-Kejur

মাটিপুকুর গ্রামের চাষি আব্দুল আলিম ও আয়ুব আলী জানান, কৃষি জমির চার পাশে খেঁজুর গাছ লাগিয়েছি। এর থেকে পাচ্ছি জ্বালানি, রস ও গুড়। এতে জমির ফসলের কোনো ক্ষতি হচ্ছে না। রস, গুড় বিক্রি করে সংসারে বাড়তি আয় আসছে।

কৃষিবিদ হীরক কুমার সরকার জানান, উপজেলার বিভিন্নস্থানে ৩৫ হাজার পুরনো খেঁজুর গাছ রয়েছে। এ বছর পাঁচ হাজার খেঁজুর গাছ বেনাপোল, মাটিপুকুর, কায়বা, কাগজপুকুর, জিরেনগাছা, শাখারীপোতা, বারোপোতা, রঘুনাথপুর ও ডিহিতে পরিকল্পিতভাবে রাস্তার ধার দিয়ে লাগানো হয়েছে। গত বছর উপজেলার বিভিন্নস্থানে এক হাজার দেশি জাতের সঙ্গে পরীক্ষামূলকভাবে আরব দেশীয় খেঁজুরের চারাও লাগানো হয়েছে বলে জানান তিনি।

ত্রিশ বছর ধরে গাছি হিসেবে খেঁজুর গাছ তোলা ও রস সংগ্রহ করে আসছেন এমন একজন শার্শার টেংরা গ্রামের মুছা করীম (৫৫) বলেন, কোনো পরিচর্যা ছাড়া খেঁজুরের গাছ বিভিন্নস্থানের ঝোপ ঝাড়ে বড় হয়ে উঠে।

জমির আইলে, বাগানের পতিত জমিতে ও বাড়ির আঙিনায়, রাস্তার ধারে খেঁজুর গাছ বেশি জন্মে। ৩ বছর বয়সে একটি গাছ রস দেবার উপযোগি হয়। ২০ বছর পর্যন্ত ভালোভাবে রস পাওয়া যায়। খেঁজুর গাছ বছরের ৪ মাস রস দেয়। ১০-১২টি খেঁজুর গাছের রস ও গুড় বিক্রি করে একটি পরিবার অনায়াসে সংসারের ব্যয় চালাতে সক্ষম বলে জানান তিনি।

বেনাপোলের উত্তর বারোপোতা গ্রামের আব্দুল মমিন বলেন, অতীতে কখনও খেঁজুরের চারা রোপন করা হয়নি। যশোরের আবহাওয়ার সঙ্গে মানানসই খেঁজুর গাছ এমনিতেই জন্মে। বিভিন্নস্থানে সৃষ্টি হয় খেঁজুরের বাগান। এখন শীতকাল তাই অযত্নে অবহেলায় পড়ে থাকা খেঁজুর গাছের কদর বেড়েছে।

এই শিল্পের সরকারি পৃষ্টপোষকতার ব্যবস্থা না থাকায় ঐতিহ্যবাহী এ শিল্প আজ বিলুপ্তির পথে বলে জানান যশোরের শার্শা উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান সিরাজুল হক মঞ্জু।

এ ব্যাপারে সরকারের দৃষ্টি আকর্ষন করার পর বন বিভাগ ও কৃষি বিভাগ উদ্যোগ নিয়েছে খেঁজুর গাছ লাগানোর এবং গবেষণা করা হচ্ছে কিভাবে অর্থকারী করে তোলা যায়। ব্যক্তি উদ্যোগেও গাছ লাগানো হচ্ছে এতে যশোর ফিরে পাবে তার অতীত ঐতিহ্য।

এমএএস/পিআর

পাঠকপ্রিয় অনলাইন নিউজ পোর্টাল জাগোনিউজ২৪.কমে লিখতে পারেন আপনিও। লেখার বিষয় ফিচার, ভ্রমণ, লাইফস্টাইল, ক্যারিয়ার, তথ্যপ্রযুক্তি, কৃষি ও প্রকৃতি। আজই আপনার লেখাটি পাঠিয়ে দিন [email protected] ঠিকানায়।