‘গোখরা নিয়ে খেলতে গেলে খেয়াল রাখতে হয়, যেকোনো সময় ছোবল দিতে পারে’
তৌহিদুজ্জামান তন্ময় তৌহিদুজ্জামান তন্ময় , জ্যেষ্ঠ প্রতিবেদক সীতাকুণ্ড থেকে
প্রকাশিত: ০৯:২৩ পিএম, ০৫ জুন ২০২২
‘গোখরা সাপ নিয়ে খেলার সময় অবশ্যই খেয়াল রাখতে হবে, এটি যে কোনো সময় ছোবল দিতে পারে। যারা আগুন নিয়ন্ত্রণে নিয়োজিত, তারা হয়তো ধারণা করতে পারেননি এত বড় বিপর্যয় ঘটতে পারে। ফায়ার সার্ভিস কর্তৃপক্ষ বলছে, তারা জানতে পারেননি কোন কনটেইনারে কী আছে। কোনটিতে দাহ্য পদার্থ আছে জানা গেলে তারা এগুলো নিয়ন্ত্রণে আনার চেষ্টা করতে পারতেন।’
রোববার (৫ জুন) সন্ধ্যায় চট্টগ্রামের সীতাকুণ্ডে কনটেইনার ডিপোতে লাগা আগুন ও বিস্ফোরণ সম্পর্কে জানতে চাইলে জাগো নিউজকে একথা বলেন ফায়ার সার্ভিস অ্যান্ড সিভিল ডিফেন্স বাহিনীর সাবেক পরিচালক ও অগ্নিনির্বাপণ ব্যবস্থাপনা বিশেষজ্ঞ মেজর (অব.) শাকিল নেওয়াজ।
ফায়ার সার্ভিসের সাবেক এই কর্মকর্তা বলেন, অন্যদিকে ডিপো কর্তৃপক্ষ বলছে, এ ধরনের দুর্ঘটনা মোকাবিলায় তাদের পর্যাপ্ত প্রস্তুতি ছিল না। হাইড্রোজেন পার অক্সাইডের মতো পদার্থ আমদানির বিষয়েও তারা অবগত ছিলেন না। যদিও তাদের এই দাবি ঘিরে প্রশ্ন তুলছেন সংশ্লিষ্টরা। তাদের নজর ফাঁকি দিয়ে কীভাবে এ ধরনের পদার্থ ডিপোতে রাখা হলো? এই দায় কি তারা চাইলেই এড়াতে পারেন?
‘২০১১ সাল থেকে এই ডিপোটির কার্যক্রম চালু হয়। এখানকার নিরাপত্তা ব্যবস্থার বিষয়টি অবশ্যই আরও আগে দেখা দরকার ছিল। এখন বন্দর কর্তৃপক্ষ বলছে, তারা জানে না হাইড্রোজেন পার অক্সাইড এসেছে। অথচ এই পদার্থ অনেক কাজে লাগে। যেমন- মাউথ ওয়াশ, নেইল রিমুভার, কিচেন ক্লিন, কাপড় পরিষ্কার ইত্যাদি অনেক ক্ষেত্রে কাজে লাগে। এখন বন্দর কর্তৃপক্ষ বলছে তাদের অনুমোদন ছিল না। তাহলে কীভাবে এলো এগুলো?’
আগুন নিয়ন্ত্রণে নিয়োজিত থেকে প্রাণহানির শিকার কর্মীদের কেমিক্যাল সম্পর্কে পর্যাপ্ত জ্ঞান ছিল কি না, সে বিষয়ে প্রশ্ন রেখে শাকিল নেওয়াজ বলেন, যারা আগুন নিয়ন্ত্রণে কাজ করেছেন তারা কেমিক্যাল বিষয়ে প্রশিক্ষিত ছিলেন কি না, সেটি দেখতে হবে। কারণ এ ধরনের ক্ষেত্রে প্রয়োজনীয় দূরত্ব রক্ষা করে কাজ করতে হয়। ১০০ মিটারকে বলা হয় হটজোন। ৩০০ মিটারকে বলা হয় ওয়ার্মজোন। তার পরের অংশ হচ্ছে কুলজোন। হটজোনে একমাত্র কেমিক্যাল এক্সপার্ট লোক ঢুকবে। ওয়ার্মজোনে ফায়ার ফাইটার, অ্যাম্বুলেন্স তারা তৈরি থাকবে। কুলজোনে সাধারণ মানুষ থাকবে। সীতাকুণ্ডের ঘটনায় এই শৃঙ্খলা মানা হয়েছে কি না, সেটি দেখার বিষয়।
ফায়ার সার্ভিস কর্মীদের প্রাণহানির ঘটনা দুঃখজনক উল্লেখ করে তিনি বলেন, আপনি ঝুঁকিপূর্ণ একটি বিষয় নিয়ে কাজ করছেন, যে ধরনের সতর্কতা দরকার ছিল তা ছিল কি না, সেটি এখন বড় প্রশ্ন। সতর্কতা থাকলে ফায়ার সার্ভিস কর্মীদের এত প্রাণহানি হয়তো ঘটতো না। আগুন লেগেছে, এখন সবাই ঝাঁপিয়ে পড়লো নেভানোর জন্য, এটা ঠিক হয়নি। সঠিক জ্ঞান বা প্রশিক্ষণ না থাকায় দুর্ঘটনায় প্রাণহানি বেড়েছে।
ডিপোর স্টোরিং ব্যবস্থাপনা নিয়ে প্রশ্ন তুলে ফায়ার সার্ভিসের সাবেক এই পরিচালক বলেন, ডিপোতে কনটেইনারগুলো স্টোরিংয়ে বড় ঘাটতি ছিল। কেমিক্যাল সব সময় আলাদা জায়গায় রাখতে হয়। একটি কনটেইনার থেকে আরেকটি কনটেইনারের মধ্যে নিরাপদ দূরত্বও থাকতে হবে। যাতে একটি বিস্ফোরণ বা ক্ষতিগ্রস্ত হলে অন্যটি কোনোভাবেই ক্ষতিগ্রস্ত না হয়। এ ধরনের কেমিক্যাল হালকা ঠান্ডা তাপমাত্রায় রাখতে হয়।
কী কারণে এই আগুন লাগতে পারে? এমন প্রশ্নের জবাবে মেজর (অব.) শাকিল নেওয়াজ বলেন, তিন কারণে আগুন লাগতে পারে। একটি হচ্ছে প্রাকৃতিক আগুন। অর্থাৎ বজ্রপাত থেকে। দ্বিতীয়ত দুর্ঘটনাবশত আগুন লাগতে পারে। যেমন- মানুষের অসতর্ক চলাফেরা, বৈদ্যুতিক ত্রুটি, ধূমপান, গ্রেইনডিং, ওয়েল্ডিং ইত্যাদি। তৃতীয়ত হচ্ছে শত্রুতা করে বা পরিকল্পনা করে কেউ আগুন দিলে। যেহেতু শনিবার রাতে সেখানে কোনো বজ্রপাত হয়নি তাই দ্বিতীয় এবং তৃতীয় কারণ দুটো অনুসন্ধান করতে হবে।
এর আগে শনিবার (৪ জুন) রাত ১১টার দিকে বিএম কনটেইনার ডিপোতে আগুনের খবর পেয়ে ঘটনাস্থলে যায় ফায়ার সার্ভিস। এরপর তারা আগুন নিয়ন্ত্রণে কাজ শুরু করে। এসময় এক কনটেইনার থেকে অন্য কনটেইনারে ছড়িয়ে পড়তে থাকে আগুন। কিছু কনটেইনারে রাসায়নিক থাকায় বিকট শব্দে বিস্ফোরণ ঘটে। বিস্ফোরণে ঘটনাস্থল থেকে অন্তত চার কিলোমিটার এলাকা কেঁপে ওঠে। ভেঙে পড়ে আশপাশের বাড়িঘরের জানালার কাচ।
রোববার (৫ জুন) রাত ৯টা পর্যন্ত ৪৯ জন নিহত হওয়ার খবর নিশ্চিত করেছেন চট্টগ্রামের সিভিল সার্জন ডা. ইলিয়াছ চৌধুরী। এর মধ্যে আটজন ফায়ার সার্ভিস কর্মী। আহত আছেন কয়েকশ। ডিপোটিতে ১৩শ কনটেইনার ছিল বলে জানিয়েছেন সংশ্লিষ্টরা। প্রাথমিকভাবে এ আগুনে নয়শ কোটি টাকার বেশি ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে বলে ধারণা করা হচ্ছে।
অপরদিকে নিহত ও আহত শ্রমিকদের জন্য ক্ষতিপূরণের ঘোষণা দিয়েছে শ্রম মন্ত্রণালয়। নিহত শ্রমিকদের ২ লাখ টাকা ও আহতদের চিকিৎসায় ৫০ হাজার টাকা সহায়তা দেওয়া হবে। আর নিহত প্রত্যেকের পরিবারকে ১০ লাখ টাকা করে দেওয়ার ঘোষণা দিয়েছে বিএম কনটেইনার ডিপো কর্তৃপক্ষ। এছাড়া এ দুর্ঘটনায় যারা অঙ্গ হারিয়েছেন তাদের ৬ লাখ এবং আহতদের ৪ লাখ টাকা করে দেবে প্রতিষ্ঠানটি।
টিটি/এএসএ/জিকেএস