নায়করাজ উপাধির স্রষ্টা খোকা ভাইকে মনে পড়ে
সাংবাদিকরাও যে চলচ্চিত্রের প্রাণপুরুষ হতে পারেন তার উজ্জল দৃষ্টান্ত তিনি রেখে গেছেন। চার দশকেওর বেশি সময় ধরে তিনি চলচ্চিত্র নিয়ে লিখেছেন। ‘পিচঢালা পথ’, ‘নতুন নামে ডাকো’, ‘নাচের পুতুল’, ‘বাদী থেকে বেগম’, ‘আগুন’, ‘যাদুর বাঁশি’, ‘মাস্তান’, ‘তুফান’, ‘শেষ উত্তর’, ‘লাভ ইন সিঙ্গাপুর’, ‘শ্বশুরবাড়ি’, ‘মিস লংকা’, ‘দূরদেশ’র মতো বিখ্যাত আর জনপ্রিয় নব চলচ্চিত্রের চিত্রনাট্য লিখেছেন।
পিচঢালা এ পথটারে ভালবেসেছি, যেও না সাথী, নতুন নামে ডাকবো তোমায়, কে তুমি এলে গো, ও দরিয়ার পানি, এ বৃষ্টিভেজা রাতে চলে যেও না, চুরি করেছো আমার মনটা, মাগো তোর কান্না আমি সইতে পারি না, যাদু বিনা পাখি যেমন বাঁচিতে পারে না, এক বুক জ্বালা নিয়ে বন্ধু তুমি কেন একা বয়ে বেড়াও, বিদায় দাওগো বন্ধু তোমরা এবার দাও বিদায়, প্রেম পিরিতি চাই বলে সবাই আমায় পাগল বলে’র মতো লিখেছেন কালজয়ী কিছু চলচ্চিত্রের গানও। তিনি প্রয়াত চলচ্চিত্র সাংবাদিক আহমদ জামান চৌধুরী। যিনি আজাচৌ এবং খোকা ভাই নামেও সমাদৃত ছিলেন সবার কাছে।
মাত্র দুই বছর পেরিয়ে এসেছি আমরা এই গুণী মানুষটিকে হারানোর পর। অথচ এই অল্প কিছু দিনের মধ্যে অকৃতজ্ঞের মতো ভুলতে বসেছি ঢাকাই ছবিতে তার অবদান, প্রচেষ্টা, উন্নয়ন ভাবনা ও আজীবনের ভালোবাসা। জন্ম-মৃত্যু দিনগুলো ছাড়া তাকে কোথাও খুঁজে পাওয়া দুষ্কর। চলচ্চিত্র বিষয়ক সাংবাদিক সংগঠনগুলো আজ ব্যক্তি স্বার্থ উদ্ধারে ব্যস্ত। তারা না করে স্বজাতের উন্নয়ন ভাবনা না করে গুণী মানুষদের অমর করে রাখবার চেষ্টা। তেমনি খোকা ভাই খ্যাত সাংবাদিকদের অঘোষিত এই প্রয়াত অভিভাবককে নিয়েও খুব বেশি স্মরণায়োজন চোখে পড়ে না।
তাই দুঃখ নিয়েই উপলব্দি করতে হয়, পুরোনোরাই যেখানে এই গুণী কিংবদন্তি সাংবাদিক-চলচ্চিত্রপ্রেমীর নাম ভুলতে বসেছে সেখানে নতুন প্রজন্ম তার সম্পর্কে কি করে জানবে ও কেমন করে তাকে অনুসরণ করার সুযোগ পাবে! অথচ তাকে মনে করার অনেক কারণ রয়েছে, উপলক্ষ রয়েছে।
এই যেমন আজ নায়করাজ রাজ্জাকের জন্মদিনে খুব বেশি করে মনে পড়বে তাকে। কেননা, নায়কের ‘নায়করাজ’ উপাধিটি যে তিনিই দিয়েছিলেন আশির দশকে। সেই কথা নায়করাজ নিজেও কৃতজ্ঞচিত্তে স্বীকার করেন এবং গর্বভরে সেটি বলেও বেড়ান। আজ যখন জন্মদিন উপলক্ষে নামের আগে বারবার শুনবেন ‘নায়করাজ’ শব্দটি, হয়তো প্রিয় বন্ধুটির কথা স্মরণ করে রাজ্জাক আড়ালেই ফেলবেন খানিকটা অশ্রু।
২০১৩ সালে ৬ মার্চ আহমদ জামান চৌধুরীর মৃত্যু হলে দেশের বাইরে থাকায় তাকে শেষ দেখা দেখতে পারেননি রাজ্জাক। দেশে ফিরে এসে আবেগে আপ্লুত হয়ে সাংবাদিকদের বলেছিলেন, ‘আহমদ জামান চৌধুরী সাংবাদিকদের মধ্যে আমার সবচেয়ে ঘনিষ্ঠ বন্ধু ছিলেন। আমার ‘নায়করাজ’ উপাধিটি তারই দেয়া। কত সময় কেটেছে তার সঙ্গে আমার। একজন নায়ক হিসেবে আমি যখন জনপ্রিয়তায় তুঙ্গে, তখন নানা হিসাব-নিকাশ কষেই খোকা (আহমদ জামান চৌধুরী) আমাকে এই উপাধিটি দিয়েছিল।’
রাজ্জাক আরো বলেছিলেন, ‘আমি নায়করাজ যতদিন বেঁচে থাকব আমার মাঝে ততদিনই আমার বন্ধু খোকা বেঁচে থাকবে। যতদিন ঢাকাই চলচ্চিত্র বেঁচে থাকবে ততদিন একজন আহমদ জামান চৌধুরী (খোকা) বেঁচে থাকবে। কারণ এ দেশের চলচ্চিত্রে তার অবদান অস্বীকার করার কোনোই উপায় নেই।’
আমরা ধরে নিয়েছি আমাদের খোকা ভাইও বেঁচে ছিলেন, বেঁচে আছেন, বেঁচে থাকবেন চলচ্চিত্রে। কেননা, আমাদের নায়করাজ যে অমরত্ব নিয়েছেন।
শুধু তাই নয়, তাকে মনে পড়বে নন্দিত চলচ্চিত্রাভিনেতা সোহেল রানার নাম উচ্চারনে। কেননা, মাসুদ পারভেজ থেকে সোহেল রানা নামটি দিয়েছিলেন প্রয়াত বরেণ্য চলচ্চিত্র সাংবাদিক, চিত্রনাট্যকার, কাহিনিকার ও গীতিকার আহমদ জামান চৌধুরীই। সোহেল রানা বলেন, ‘আমার নায়ক হিসেবে কাজ করার পেছনে সুমিতা দেবী, মোস্তাফিজ, এস এম শফি ও আহমদ জামান চৌধুরীর উত্সাহ এবং ভূমিকা আমৃত্যু আমি ভুলবো না। তাদের ঋণ কোনোদিনই পরিশোধ করার মতো নয়।’
সাংবাদিকতা শুরু জনপ্রিয় সিনেমা পত্রিকা ‘চিত্রালী’র মাধ্যমে ১৯৭০ সালে। এরপর নানা দায়িত্ব পালন শেষে পত্রিকাটির সম্পাদনার দায়িত্বও পালন করেন দীর্ঘ ১০ বছর। সব মিলিয়ে চিত্রালীর সঙ্গে তিনি সম্পৃক্ত ছিলেন দীর্ঘ ২০ বছর। চিত্রালীর পর তিনি দু’বছর ফিচার এডিটর হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন দৈনিক যুগান্তর পত্রিকায়। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ও স্টামফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়েও ফিল্ম এন্ড মিডিয়া বিষয়ের ওপর পাঠদান করেছেন।
শেষকথা
বহু উপলক্ষ আসবে যাবে, যেখানে খোকা ভাইকে মনে পড়বে বারবার। তিনি চিরকাল নিভৃতেই সম্মানিত হবেন, যেভাবেই নিভৃতেই কাটিয়ে গেছেন বর্ণাঢ্য এক জীবন; সে কেউ আয়োজন করুক বা না করুক। নায়করাজের জন্মদিনে তাই এই উপাধির স্রষ্টাকেও অভিনন্দিত করছি। অদেখা ভুবনে ভালো থাকুন তিনি।
এলএ