দূষণ বাড়ে বাজেট কমে পরিবেশের
গত এক দশকে দেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে বেড়েছে শিল্পায়ন। এতে নদ-নদী ও খাল-বিল দখল-দূষণের পাশাপাশি দূষিত হচ্ছে বাতাস, উজাড় হচ্ছে বিস্তীর্ণ বনভূমি। বায়ুদূষণে এরইমধ্যে একাধিকবার শীর্ষে উঠে এসেছে প্রায় দুই কোটি মানুষের নগরী রাজধানী ঢাকা। মাত্রাতিরিক্ত কলকারখানা আর যানবাহনের কারণে বাড়ছে শব্দদূষণও। উচ্চ জনসংখ্যার ঘনত্বের দেশ হিসেবে বাংলাদেশের পরিবেশ ও জলবায়ু ঝুঁকি মোকাবিলায় এখনই সঠিক পদক্ষেপ না নেওয়া হলে নিকট ভবিষ্যৎ আরও কঠিনতর হবে, এমনটিই মনে করছেন পরিবেশবাদী বিভিন্ন সংগঠন ও বিশেষজ্ঞরা।
সম্প্রতি বিজ্ঞান সাময়িকী ল্যানসেট জানিয়েছে, পরিবেশ দূষণের কারণে ২০১৯ সালে বাংলাদেশে দুই লাখেরও বেশি মানুষের মৃত্যু হয়েছে। এসময়ে বিশ্বব্যাপী মারা গেছেন প্রায় ৯০ লাখ মানুষ। দূষণে মৃত্যুর সংখ্যার দিক থেকে বিশ্বে বাংলাদেশের অবস্থান ষষ্ঠ।
২০২০ সালে এনভায়রনমেন্টাল পারফরমেন্স ইনডেক্স (ইপিআই) অনুযায়ী, চরম ঝুঁকিপূর্ণ ১৮০টি দেশের মধ্যে বাংলাদেশের অবস্থান ছিল একেবারে তলানিতে অর্থাৎ ১৮০তম। অথচ এ অবস্থায়ও বিগত বছরগুলোতে পরিবেশ, বন ও জলবায়ু পরিবর্তন মন্ত্রণালয়ের জন্য বাজেটে বরাদ্দ কমেছে। পরিবেশ রক্ষায় নানামুখী উদ্যোগ বাস্তবায়নে চলতি অর্থবছরে এ মন্ত্রণালয়ের বাজেট বরাদ্দ বাড়ানোর পরামর্শ দিচ্ছেন পরিবেশবাদী বিভিন্ন সংগঠন ও বিশেষজ্ঞরা।
বাজেট বিশ্লেষণে দেখা যাচ্ছে, গত পাঁচটি অর্থবছরে বাজেটের আকার বাড়লেও বরাদ্দ খুব একটা বাড়েনি পরিবেশ মন্ত্রণালয়ের।
সবশেষ ২০২১-২০২২ অর্থবছরের বাজেটে পরিবেশ মন্ত্রণালয়ের জন্য বরাদ্দ ছিল ১ হাজার ২২১ কোটি টাকা। যা এর আগের অর্থবছরের (২০২০-২০২১) চেয়ে ২৫ কোটি টাকা কম। ২০২০-২০২১ অর্থবছরে এ মন্ত্রণালয় বাজেট বরাদ্দ পেয়েছিল ১ হাজার ২৪৬ কোটি টাকা। এর আগের অর্থবছরে (২০১৯-২০২০) এ বরাদ্দ ছিল ১ হাজার ৪৯৬ কোটি টাকা।
২০১৬-২০১৭ অর্থবছরে পরিবেশ ও বন মন্ত্রণালয়ের জন্য বাজেট বরাদ্দ রাখা হয়েছিল ১ হাজার ৮৫০ কোটি টাকা। পরের অর্থবছরে (২০১৭-২০১৮) তা ৭৩১ কোটি টাকা কমিয়ে করা হয় ১ হাজার ১১৯ কোটি টাকা। তবে ২০১৮-২০১৯ অর্থবছরে এ মন্ত্রণালয়ের জন্য ১৫০ কোটি টাকা বরাদ্দ বাড়িয়ে ১ হাজার ২৭০ কোটি টাকা করা হয়।
পরিবেশ সুরক্ষা খাতে বরাদ্দ কমায় হতাশা প্রকাশ করে বাংলাদেশ পরিবেশ আন্দোলনের (বাপা) সাধারণ সম্পাদক শরীফ জামিল জাগো নিউজকে বলেন, নানামুখী শিল্পায়নের মাধ্যমে দেশে ব্যাপকভাবে অর্থনৈতিক উন্নয়ন হচ্ছে। এক দশক আগেই ঢাকার চারপাশে নদীগুলোর প্রায় ৬০ শতাংশ দূষিত হয়েছে বলে বিশ্বব্যাংক বলেছে। এখন সারাদেশে যখন আমাদের শিল্পপ্রতিষ্ঠানগুলো ছড়িয়ে দিয়েছি তখন পরিবেশ অধিদপ্তরের সক্ষমতাও বাড়ানো দরকার। কিন্তু বিগত অর্থবছরের বাজেটে আমরা দেখলাম পরিবেশ মন্ত্রণালয়ের জন্য বরাদ্দ আরও কমানো হয়েছে।
তিনি বলেন, সরকার পরিবেশ সংরক্ষণে উদাসীন, এটা বাজেট বরাদ্দেই প্রতিফলিত। পরিবেশ সংরক্ষণে মন্ত্রণালয়ের সক্ষমতা, লোকবল বাড়াতে বড়সড় বরাদ্দ প্রয়োজন। কেননা এখনো ব্যাপকহারে শিল্পায়ন হচ্ছে। কিন্তু বাজেটে যদি সঠিক বরাদ্দ না থাকে তাহলে বুঝতে হবে এটা টেকসই বাজেট না।
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, স্বল্পোন্নত দেশের (এলডিসি) তালিকা থেকে উন্নয়নশীল দেশে উত্তরণে সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ পরিবেশ ও জলবায়ুর উন্নতি।
জাতিসংঘের টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা বা এসডিজির সুনির্দিষ্ট ১৭টি অভীষ্টের মধ্যে চারটি অভীষ্ট সরাসরি পরিবেশের সঙ্গে সম্পর্কযুক্ত। এর মধ্যে ২০৩০ সালের মধ্যে পরিবেশ ও জলবায়ুর কারণে ক্ষতিগ্রস্ত মানুষের সংখ্যা কমিয়ে আনা, শতভাগ জনগোষ্ঠীকে বিশুদ্ধ পানির আওতায় আনা, নবায়নযোগ্য জ্বালানি নিশ্চতকরণ ও সমুদ্র দূষণ কমানোর লক্ষ্যমাত্রা অন্তর্ভুক্ত।
শরীফ জামিল বলেন, আমাদের দেশ এলডিসি থেকে উত্তরণ হবে। আমরা মধ্যম আয়ের দেশে আছি এখন। এলডিসি উত্তীর্ণ হতে হলে সরকারকে এসডিজি (টেকসই উন্নয়ন অভীষ্ট) বাস্তবায়ন করতে হবে। পরিবেশ দূষণ অব্যাহত রেখে এসডিজি অর্জন অসম্ভব। এটা আমরা কেউই চাই না। পরিবেশ রক্ষায় বাজেটে রিফ্লেকশন থাকতে হবে। শুধু যে পরিবেশ মন্ত্রণালয়ে বরাদ্দ বাড়ালে হবে তা নয়, এক্ষেত্রে শিল্প মন্ত্রণালয়কেও অন্তর্ভুক্ত করতে হবে। যেন শিল্প মালিকেরা সঠিক কর্মপরিবেশ নিশ্চিত করতে পারেন। সর্বোপরি পরিবেশ রক্ষায় বাজেটে বরাদ্দ ও ব্যাপকতা বাড়াতে হবে।
এ বিষয়ে স্টামফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিবেশ বিজ্ঞান বিভাগের চেয়ারম্যান অধ্যাপক ড. আহমদ কামরুজ্জমান মজুমদার জাগো নিউজকে বলেন, আমাদের বাজেট দিন দিন বড় হচ্ছে। ৫ লাখ কোটি থেকে ৭ লাখ কোটি টাকায় উন্নীত হয়েছে। কিন্তু বাজেট যখন ১ লাখ কোটি টাকা ছিল তখন পরিবেশ মন্ত্রণালয়ের যে জন্য যে বরাদ্দ ছিল, বর্তমানে বাজেটের আকার অনেক বড় হলেও পরিবেশের জন্য বরাদ্দ একই রয়ে গেছে।
তিনি বলেন, পরিবেশের ভেতরে অন্যান্য জিনিসগুলো এমনভাবে দেওয়া হচ্ছে যেগুলো আসলে পরিবেশের না। উন্নয়ন কর্মকাণ্ড বা অবকাঠামোর বরাদ্দকে পরিবেশে দেওয়া হচ্ছে। আমরা চাচ্ছি, যথাযথভাবে যেন পরিবেশের জন্য টেকসই বাজেট বরাদ্দ দেওয়া হয়।
সবুজ আন্দোলনের চেয়ারম্যান বাপ্পি সরদার জাগো নিউজকে বলেন, অন্তত ২০ হাজার কোটি টাকা যেন পরিবেশের জন্য বরাদ্দ দেওয়া হয়। নবায়নযোগ্য জ্বালানি গবেষণা ও উৎপাদনে এ বরাদ্দের ৩০ ভাগ ব্যবহার করা যেতে পারে। পাশাপাশি সবুজায়ন বাড়ানোর জন্য সারাদেশে ১০ কোটি গাছ লাগানোর পরিকল্পনা করা যেতে পারে।
তিনি বলেন, পরিবেশখাতের উন্নয়নের অন্যতম শর্তই হচ্ছে পর্যাপ্ত গবেষণাগার। যার মাধ্যমে জলবায়ু পরিবর্তনের ঝুঁকিগুলো আমরা চিহ্নিত করতে পারবো ও সে অনুযায়ী ব্যবস্থা নিতে পারবো। কৃষির ওপর জলবায়ু পরিবর্তনের যে প্রভাব, তা থেকে উত্তরণ ও আগাম ফসল প্রস্তুতিতে বরাদ্দের অর্থ প্রয়োজন পড়বে।
তার মতে, দেশে যে হারে শিল্পায়ন বাড়ছে সেক্ষেত্রে প্রতিটি ইউনিয়নে পানি শোধনাগার প্রয়োজন। যা পানিকে পরিশোধন করে খাল-বিলে ফেলবে। এটা করা হলে আমাদের কৃষি ও জীববৈচিত্র্যও রক্ষা পাবে।
আগামী ৯ জুন ২০২২-২৩ অর্থবছরের বাজেট জাতীয় সংসদে উত্থাপন করবেন অর্থমন্ত্রী আ হ মুস্তফা কামাল। দেশের ৫১তম, আওয়ামী লীগ সরকারের ২২তম এ বাজেটে গুরুত্ব পাচ্ছে দেশের অবকাঠামো, সামাজিক সুরক্ষা, কৃষি ও কর্মসংস্থান।
এসএম/এইচএ/এমকেআর/এএসএম