২৮ মাসে সড়ক দুর্ঘটনায় ১৬৭৪ শিশুর মৃত্যু
সড়ক ও সড়ক পরিবহন খাতে অব্যবস্থাপনা ও নৈরাজ্যের কারণে শিশুরা অস্বাভাবিক হারে দুর্ঘটনাকবলিত হচ্ছে। দেশে সড়ক দুর্ঘটনায় শিশু মৃত্যুহার উদ্বেগজনক পর্যায়ে। ২০২০ থেকে ২০২২ সালের এপ্রিল মাস পর্যন্ত দেশে সড়ক দুর্ঘটনায় এক হাজার ৬৭৪ শিশু নিহত হয়েছে।
বৃহস্পতিবার (১৯ মে) সড়ক দুর্ঘটনা নিয়ে রোড সেফটি ফাউন্ডেশনের পক্ষ থেকে শিশু নিহতের প্রতিবেদনে এ তথ্য জানানো হয়।
গত ২৮ মাসে সড়ক দুর্ঘটনায় শিশু মৃত্যুর ঘটনা বিশ্লেষণ করলে দেখা যায়, বিভিন্ন যানবাহনের যাত্রী হিসেবে নিহত হয়েছে ৩৩১ শিশু, যা মোট সংখ্যার ১৯ দশমিক ৭৭ শতাংশ। এ সময় রাস্তা পারাপার ও রাস্তা ধরে হাঁটার সময় যানবাহনের চাপায় বা ধাক্কায় নিহত হয়েছে এক হাজার ২৭ শিশু, যা মোট সংখ্যার ৬১ দশমিক ৩৫ শতাংশ।
এছাড়া ট্রাক, পিকআপ, ট্রাক্টর ও ড্রাম ট্রাক ইত্যাদি পণ্যবাহী যানবাহনের চালক ও সহকারী হিসেবে নিহত হয়েছে ৪৮ শিশু, যা মোট সংখ্যার ২ দশমিক ৮৬ শতাংশ। অন্যদিকে, মোটরসাইকেল চালক ও আরোহী হিসেবে নিহত হয়েছে ২৬৮ শিশু, যা মোট সংখ্যার ১৬ শতাংশ।
যাত্রী হিসেবে শিশু নিহতের যানবাহনভিত্তিক চিত্র:
যাত্রী হিসেবে শিশু নিহতের যানবাহনভিত্তিক পর্যবেক্ষণে দেখা যায়,
১. বাসযাত্রী হিসেবে নিহত ৭২ শিশু (২১.৭৫%)
২. প্রাইভেটকার, মাইক্রোবাস ও অ্যাম্বুলেন্স যাত্রী হিসেবে ২৫ শিশু (৭.৫৫%)
৩. থ্রি-হুইলার (সিএনজি, অটোরিকশা, ইজিবাইক ইত্যাদি) যাত্রী হিসেবে ১৮৩ শিশু (৫৫.২৮%)
৪. স্থানীয়ভাবে তৈরি যানবাহনের (নসিমন, ভটভটি, মাহিন্দ্র, টমটম ইত্যাদি) যাত্রী হিসেবে ৫১ শিশু (১৫.৪০%) নিহত হয়েছে।
যানবাহনের চাপায় বা ধাক্কায় শিশু নিহতের চিত্র:
১. পণ্যবাহী যানবাহনের (ট্রাক, কাভার্ডভ্যান, পিকআপ, ড্রাম ট্রাক, ট্রাক্টর ও ট্রলি ইত্যাদি) চাপায় বা ধাক্কায় নিহত ২৫৮ শিশু (২৫.১২%)
২. বাস, প্রাইভেটকার, মাইক্রোবাস ও অ্যাম্বুলেন্সের চাপায় বা ধাক্কায় নিহত ১৪৩ শিশু (১৩.৯২%)
৩. থ্রি-হুইলারের (সিএনজি, অটৈারিকশা ও ইজিবাইক ইত্যাদি) চাপায় বা ধাক্কায় নিহত ৩২১ শিশু (৩১.২৫%)
৪. স্থানীয়ভাবে তৈরি যানবাহনের (নসিমন, ভটভটি, মাহিন্দ্র ও টমটম ইত্যাদি) চাপায় বা ধাক্কায় নিহত ২০৮ শিশু (২০.২৫%)
৫. বেপরোয়া মোটরসাইকেলের ধাক্কায় নিহত হয়েছে ৯৭ শিশু (৯.৪৪%)।
শিশু নিহত হওয়া সড়কের ধরন:
দুর্ঘটনায় শিশু নিহত হওয়া সড়কের ধরন বিশ্লেষণে দেখা যায়, মহাসড়কে নিহত ২৮৭ শিশু (১৭.১৪%); আঞ্চলিক সড়কে নিহত হয়েছে ৩২৮ শিশু (১৯.৫৯%); গ্রামীণ সড়কে নিহত হয়েছে ৮৮৯ শিশু (৫৩.১০%); শহরের সড়কে নিহত হয়েছে ১৪৭ শিশু (৮.৭৮%) এবং অন্যান্য স্থানে নিহত হয়েছে ২৩ শিশু (১.৩৭%)।
দুর্ঘটনার সময় বিশ্লেষণ:
শিশু নিহত হওয়া দুর্ঘটনার সময় বিশ্লেষণে দেখা যায়, ভোরে মোট সংগঠিত দুর্ঘটনার এক দশমিক ৫৫ শতাংশ, সকালে ৫১ দশমিক ৭৯ শতাংশ, দুপুরে ১৩ দশমিক ৩২ শতাংশ, বিকেলে ২২ দশমিক ৪৬ শতাংশ, সন্ধ্যায় ৬ দশমিক ৫১ শতাংশ ও রাতে ৪ দশমিক ৩৬ শতাংশ দুর্ঘটনা ঘটেছে।
সড়ক দুর্ঘটনায় নিহত শিশুদের বয়সভিত্তিক বিশ্লেষণ:
মোট নিহত শিশুর মধ্যে এক মাস থেকে পাঁচবছর বয়সী নিহত হয়েছে ৩৩৭ শিশু (২০.১৩%), ৬ বছর থেকে ১২ বছর বয়সী নিহত হয়েছে ৭৫৪ শিশু (৪৫.০৪%) ও ১৩ বছর থেকে ১৮ বছর বয়সী নিহত হয়েছে ৫৮৩ শিশু (৩৪.৮২%)।
সড়ক দুর্ঘটনায় শিশু মৃত্যুহার বৃদ্ধির কারণসমূহ:
১. দেশের সড়ক ও সড়ক পরিবহন শিশুবান্ধব না হওয়া
২. সড়ক ব্যবহার সম্পর্কে শিশুদের মধ্যে সচেতনতার অভাব
৩. পরিবার ও শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে সড়ক ব্যবহার সম্পর্কে শিশুদের পরামর্শ ও পশিক্ষণ না দেওয়া
৪. অদক্ষ ও অপ্রাপ্ত বয়স্ক চালক কর্তৃক যানবাহন চালানো
৫. দুর্ঘটনায় আহত শিশুদের উপযুক্ত চিকিৎসা ব্যবস্থার সংকট
৬. আহত শিশুদের চিকিৎসায় পরিবারের আর্থিক অসচ্ছলতা
সড়ক দুর্ঘটনায় শিশু মৃত্যুহার কমাতে সুপারিশসমূহ:
১. সড়ক ও সড়ক পরিবহন ব্যবস্থা শিশুদের জন্য নিরাপদ করা
২. নিরাপদে সড়ক ব্যবহার বিষয়ে পরিবার ও শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে শিশুদের সচেতন করা
৩. অদক্ষ ও অপ্রাপ্ত বয়স্ক চালক কর্তৃক যানবাহন চালানো বন্ধে কঠোর ব্যবস্থা নেওয়া
৪. জেলা পর্যায়ের হাসপাতালসমূহে সড়ক দুর্ঘটনায় আহতদের চিকিৎসার সুযোগ ও সক্ষমতা বৃদ্ধি করা
৫. সড়ক দুর্ঘটনায় আহতদের চিকিৎসায় বিশেষ সরকারি তহবিল গঠন করা
৬. সড়ক পরিবহন আইন ২০১৮ বাস্তবায়ন করা।
দুর্ঘটনা পর্যালোচনা ও মন্তব্য:
শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে যাওয়া-আসার সময় নিহত হয়েছে ৭৩১ শিশু (৪৩.৬৬%)। এছাড়া বসতবাড়ির আশে-পাশের সড়কে খেলাধুলার সময় নিহত হয়েছে ১৯৩ শিশু (১১.৫২%)। এ সময় ট্রাক নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে বসত ঘরের উপর উল্টে পড়ার তিনটি ঘটনায় রাতে ঘুমন্ত অবস্থায় সাতটি শিশু নিহত হয়।
পর্যবেক্ষণে দেখা যায়, শিশুরা গ্রামীণ সড়কে বেশি হতাহত হচ্ছে। কারণ গ্রামীণ সড়কগুলো বসত বাড়ি ঘেষা এবং এই সড়কের যানবাহনসমূহ কোনো প্রকার নিয়ম-নীতি মেনে চলে না। সড়ক নিয়ন্ত্রণে আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর উপস্থিতিও থাকে না। আবার শিশুরাও সড়ক ব্যবহারের কোনো নিয়ম-নীতি জানে না।
বিষয়টি নিয়ে সরকারের সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের মধ্যে যেমন কোনো উদ্বেগ নেই, তেমনি সাধারণ মানুষের মধ্যেও কোনো প্রকার সচেতনতা সৃষ্টির লক্ষণ দেখা যাচ্ছে না। অথচ এই অব্যবস্থাপনার মধ্য দিয়ে নীরবে আমাদের শিশুরা নিহত হচ্ছে, পঙ্গু হচ্ছে। এটা জাতির জন্য অপূরণীয় ক্ষতি। কারণ প্রতিটি শিশুই অমিত সম্ভাবনাময় এবং আজকের শিশুরাই আমাদের ভবিষ্যৎ।
এফএইচ/এমপি/এএসএম