রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকে পরিচালক হতে তদবির, রয়েছেন সাংবাদিকরাও
রাষ্ট্রায়ত্ত ৬ ব্যাংকের শূন্য থাকা পরিচালক পদে নিয়োগ পেতে দৌড়ঝাঁপ ও তদবির চলছে। রাজনৈতিক প্রভাব রয়েছে এমন ব্যক্তিরা পরিচালক পদে নিয়োগ পেতে নানা জায়গায় দেন দরবার করছেন। এই তালিকায় আমলাদের পাশাপাশি দু’একজন সাংবাদিকের নামও শোনা যাচ্ছে। অন্যদিকে, রয়েছেন ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের সঙ্গে বিভিন্নভাবে জড়িত পেশাজীবীরা। বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক ও সরকারি ব্যাংক কর্মকর্তাদের নামও শোনা যাচ্ছে। ব্যাংক সূত্রে এসব তথ্য জানা গেছে।
সূত্র জানায়, এ বিষয়ে সরকার অনেকটাই সর্তক অবস্থানে রয়েছে। রাজনৈতিক পরিচয়ে পরিচালক নিয়োগ দিলেও সরকার বিগত দিনের অভিজ্ঞতা থেকে শিক্ষা নিয়ে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নেবে।
জানা গেছে, ৬ ব্যাংকের ৩০ জনেরও বেশি পরিচালকের পদ শূন্য। পরিচালক সংকটে কোনও কোনও ব্যাংক পরিচালনা পর্ষদের সভা করতে পারছেন না। ফলে গুরুত্বপূর্ণ ঋণ অনুমোদনসহ ঝুলে আছে অনেক সিদ্ধান্ত। রাষ্ট্রায়ত্ত সবচেয়ে বড় আর্থিক প্রতিষ্ঠান সোনালী ব্যাংক। এর পরিচালনা পর্ষদের ৭ জনের মেয়াদ শেষ হয়েছে গত বছরের ১৯ ডিসেম্বর। ব্যাংকটিতে মোট ১৩ জন পরিচালক থাকার কথা । কিন্তু কোরাম সংকটের কারণে বোর্ড সভা করা যাচ্ছে না।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, শিগগিরই রাষ্ট্রায়ত্ত ৬ ব্যাংকে আরও ৯ কর্মকর্তার মেয়াদ শেষ হবে । এই শূন্য পদগুলোতে নিয়োগ দেয়া হচ্ছে আমলাদের। ইতোমধ্যে অতিরিক্ত সচিব গকূল চাঁদ দাসকে অগ্রণী ব্যাংকের পরিচালক পদে নিয়োগ দেয়া হয়েছে। এর বাইরে অতিরিক্ত সচিব মুসলিম চৌধুরী ও ফজলুল হককে নিয়োগ দেয়া হয়েছে সোনালী ব্যাংকে। অতিরিক্ত সচিব মানিক চন্দ্র দে নিয়োগ পেয়েছেন জনতা ব্যাংকে।
সূত্র মতে, তিন বাণিজ্যিক ব্যাংক সোনালী, জনতা ও অগ্রণীতে ২১ পরিচালকের পদ শূন্য আছে। এর বাইরে বিশেষায়িত বাংলাদেশ কৃষি ব্যাংক (বিকেবি), রাজশাহী কৃষি উন্নয়ন ব্যাংক (রাকাব) ও বাংলাদেশ ডেভেলপমেন্ট ব্যাংক লিমিটেডে (বিডিবিএল) ৯ পরিচালকের পদ শূন্য।
সূত্র জানায়, এ সংক্রান্ত একটি খসড়া তালিকাও করা হয়েছে। যাদের অধিকাংশই আমলা ও ব্যাংকার। তবে এরা সরকারের সমর্থক হিসেবে পরিচিত। যদিও বিগত কয়েক বছর ধরে ব্যাংকগুলোতে রাজনৈতিক পরিচয়ে পরিচালক নিয়োগ দিয়ে আসছে সরকার।
এদিকে, অগ্রণী ব্যাংকে ১২ সদস্যের পর্ষদের ৮ জনেরই মেয়াদ শেষ হওয়ার পথে। এর মধ্যে ৬ সদস্যের মেয়াদ ইতোমধ্যে শেষ হয়েছে। এই মাসে আরও একজন এবং আগামী মার্চে আরেকজন পরিচালকের মেয়াদ শেষ হবে। চেয়ারম্যান ড. জায়েদ বখত ছাড়া মাত্র তিনজন পরিচালক রয়েছেন ব্যাংকটিতে।
জানা যায়, রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকে পরিচালক পদে রাজনৈতিক নেতা-কর্মীদের নিয়োগ না দেয়ার ব্যাপারে চিন্তা-ভাবনা চলছে। আওয়ামী লীগ সরকারের গত মেয়াদে রাষ্ট্রায়ত্ত সোনালী, অগ্রণী ও বেসিক ব্যাংকে একাধিক ঋণ কেলেঙ্কারির ঘটনায় রাজনৈতিক বিবেচনায় নিযুক্ত পরিচালকদের সম্পৃক্ততা পাওয়া গেছে। সেই পরিপ্রেক্ষিতে আগের অবস্থান থেকে সরে আসতে চায় সরকার।
বর্তমান সরকারের পরপর দুই মেয়াদেই রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকিং খাতে হলমার্ক ও ‘বিসমিল্লাহ’র মতো বহুল আলোচিত আর্থিক কেলেঙ্কারি হয়েছে। এ ছাড়া বিভিন্ন ব্যাংকে ছোট-বড় অসংখ্য কেলেঙ্কারির ঘটনা ঘটেছে। বেসিক ব্যাংকের সাড়ে ৪ হাজার কোটি টাকার ঋণ কেলেংকারি রয়েছে। এসব আর্থিক কেলেঙ্কারির ঘটনার সঙ্গে রাজনৈতিক বিবেচনায় নিয়োগ পাওয়া পরিচালনা পর্ষদ সদস্যদের সম্পৃক্ততার অভিযোগ উঠেছে। পরিস্থিতি সামলাতে পর্যবেক্ষক নিয়োগ দিয়েছে বাংলাদেশ ব্যাংক।
এসব কারণে বর্তমানে আগের অবস্থান থেকে সরে এসে দলীয় নেতা-কর্মীদের বদলে অবসরপ্রাপ্ত আমলা ও সাবেক ব্যাংকারদের নিয়োগের উদ্যোগ নিয়েছে সরকার।
সাবেক গভর্নর সালেহউদ্দিন আহমেদ বলেন, আমলা ও ব্যাংকাররা একটা গণ্ডির মধ্যে থাকেন। শুধু এই দুই পেশা থেকেই পরিচালক নিতে হবে, তা জরুরি নয়। শিক্ষক, ভালো ব্যবসায়ী বা অন্য পেশাজীবীদের কথাও ভাবা যায়। তবে সেটি রাজনৈতিক পরিচয়ের বাইরে হতে হবে। সুশাসনের জন্য ভালো পরিচালকের পাশাপাশি ব্যবস্থাপনারও উন্নয়ন জরুরি বলে মনে করেন তিনি।
২০০৯ সালের ১২ এপ্রিল জারি করা অর্থ মন্ত্রণালয়ের প্রজ্ঞাপনে বলা হয়, অর্থনীতিবিদ, সনদপ্রাপ্ত হিসাববিদ, আর্থিক বাজার, মুদ্রানীতি ও আর্থিক ব্যবস্থাপনা বিষয়ে অভিজ্ঞতা ও দক্ষতাসম্পন্ন ব্যক্তি, সাবেক ব্যাংকার, আইনজ্ঞ, ব্যবসায়ী এবং কমপক্ষে একজন নারী পেশাজীবীকে ব্যাংকের পর্ষদ সদস্য করা হবে। কিন্তু গত ছয় বছরে তা মানা হয়নি, বরং সমাজসেবক আখ্যা দিয়ে অনেক রাজনৈতিক নেতা-কর্মীকে পর্ষদ সদস্য বানানো হয়েছে।
এদিকে ব্যাংকের পরিচালনা পর্ষদের সদস্যদের কার্যক্রমেও বিধি-নিষেধ আসতে পারে। চেয়ারম্যানের জন্য সুসজ্জিত কক্ষ থাকা, জ্যেষ্ঠ নির্বাহীদের মতো চেয়ারম্যানদের অফিস করা, পর্ষদ বৈঠক ছাড়া পরিচালকদের ব্যাংকে আসা-যাওয়া ঠেকাতে চায় সরকার। অর্থ মন্ত্রণালয় এ নিয়ে নতুন প্রজ্ঞাপন জারি করতে পারে বলে জানা গেছে।
এসএ/এসকেডি/আরআইপি