মগবাজার-মৌচাক ফ্লাইওভারের নকশা নিয়ে ‘প্রশ্ন’
নকশাগত ক্রটি বেরিয়ে এসেছে রাজধানীর মগবাজার-মৌচাক ফ্লাইওভারের। ফ্লাইভারটির নির্মাণ কাজ অনেকদূর এগিয়ে যাবার পর এই ক্রটি জানা গেছে। এদিকে, প্রকল্পটি বাস্তবায়নে মেয়াদ আরো দেড় বছর বাড়ানো হয়েছে। চলতি জানুয়ারিতে নির্মাণ কাজ শেষ হওয়ার কথা ছিলো। কিন্তু শেষ হয়নি। তাই ২০১৭ সালের জুন পর্যন্ত নতুন সময় বেঁধে দেয়া হয়েছে। আর ব্যয় বাড়ানো হয়েছে প্রায় সাড়ে চারশ কোটি টাকা।
জানা গেছে, বাম হাতে চালিত গাড়ির কথা মাথায় রেখে নকশা প্রণয়ন করা হয় মগবাজার-মৌচাক ফ্লাইওভারের। আর সে ভুল নকশা মেনেই নির্মাণ করা হচ্ছে ফ্লাইওভারটি। এতে নানা সমস্যা সৃষ্টি হওয়ার আশঙ্কা থাকলেও এখন আর ত্রুটি সংশোধন সম্ভব নয়। বাংলাদেশে সাধারণ ডান হাতে চালিত গাড়ি চলে।
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, ভুল নকশায় নির্মাণের ফলে ফ্লাইওভারটিতে উঠতে কিছু সমস্যা হবে। ৬০ কিলোমিটারের কম গতিতে ফ্লাইওভারে ওঠায় ঝুঁকি থাকবে। বিশেষত মালবাহী ট্রাক ও কাভার্ডভ্যানের ক্ষেত্রে দুর্ঘটনার ঝুঁকি থাকবে বেশি। কারণ বেশির ভাগ ট্রাক-কাভার্ড ভ্যানের ফিটনেসে সমস্যা আছে। এগুলোর গতিও অনেক কম। ফলে ফ্লাইওভারে ট্রাক-কাভার্ড ভ্যান ওঠা নিষিদ্ধ করার প্রয়োজন হতে পারে।
সংশ্লিষ্টরা বলছে, কারণ ত্রুটি সারাতে গেলে ভাঙতে হবে ৬০টি পিলার। যা কার্যত অসম্ভব। এতে সময় যেমন লাগবে। আবার ব্যয়ও বাড়বে। সঙ্গে দীর্ঘদিন ধরে চলা জনভোগান্তিও দীর্ঘায়িত হবে।
সূত্র জানায়, ফ্লাইওভারের কাঠামোয় ত্রুটির বিষয়টি বেশকিছু দিন আগেই চিহ্নিত করেন বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) বিশেষজ্ঞরা। মূলত ভুল নকশার কারণেই এটি হয়েছে বলে তারা স্থানীয় সরকার প্রকৌশল বিভাগকে জানিয়েছেন।
প্রকল্প সংশ্লিষ্টরা বলছেন, ফ্লাইওভারের নকশা প্রণয়নে যুক্তরাষ্ট্রের বিশেষজ্ঞদের সহায়তা নেয়া হয়। আর নকশা সংশোধনে বুয়েট বিশেষজ্ঞদের সহায়তা নেয়া হচ্ছে। তাই নকশায় কোনো ত্রুটি থাকার কথা নয়। এরপরও ভিন্নমত থাকতেই পারে। এ বিষয়ে এলজিইডির কিছুই করার নেই।
জানা গেছে, ফ্লাইওভারটির মূল পরিকল্পনা ও নকশা আগেই করা হয়েছিল। তবে নির্মাণ শুরুর পর ভূগর্ভস্থ পরিষেবা সংযোগ লাইনের কারণে বিভিন্ন স্থানে পাইলিং করা সম্ভব হচ্ছিল না। তাই ফাউন্ডেশনের নকশা সংশোধনে বুয়েটের সহায়তা নেয়া হয়। পুরো নকশার বিষয়ে বুয়েটের কোনো পরামর্শ নেয়া হয়নি। এমনকি ওঠা-নামার র্যাম্পের মধ্যে অসামঞ্জস্য সৃষ্টির বিষয়টি জানালেও তারা তা বিবেচনা করেনি।
সূত্র জানিয়েছে, ফ্লাইওভারের নকশা বিশ্লেষণেই অসামঞ্জস্যের বিষয়টি স্পষ্ট হওয়া যায়। কারণ ফ্লাইওভারে ওঠার র্যাম্পগুলোয় পিলার রয়েছে আটটি। আর নামার র্যাম্পগুলোয় পিলার রয়েছে ১১টি করে। এতে ওঠার র্যাম্পের দৈর্ঘ্য দাঁড়িয়েছে প্রায় ২০০ মিটার আর নামার ক্ষেত্রে ৩২০ মিটার।
ফ্লাইওভারে ওঠার রাস্তা বেশি ঢালু হয়, যাতে স্বাভাবিক গতিতে গাড়ি চালিয়েই ওঠা যায়। আর নামার রাস্তাটি হয় তুলনামূলক খাড়া। ফলে গতি কমিয়ে দ্রুত ফ্লাইওভার থেকে নামা যায়। এতে ফ্লাইওভারে ওঠার র্যাম্পটির দৈর্ঘ্য বেশি ও নামার র্যাম্পের দৈর্ঘ্য থাকে কম।
তবে মগবাজার-মৌচাক ফ্লাইওভারের সাতরাস্তা, মগবাজার, মালিবাগ, রাজারবাগ পুলিশ লাইন, শান্তিনগরসহ প্রতিটি এলাকায় ওঠার র্যাম্প অনেক বেশি খাড়া। এজন্য এগুলোর দৈর্ঘ্যও রয়েছে কম। আর নামার র্যাম্পগুলো তুলনামূলক বেশি ঢালু। ফলে এগুলোর দৈর্ঘ্যও বড় রাখা হয়েছে। অর্থাৎ বাম হাতে চালিত যানের জন্য নির্মিতব্য এ ফ্লাইওভার ডান হাতে চালিত যানের জন্য ব্যবহার করতে হবে।
এদিকে মগবাজার-মৌচাক ফ্লাইওভারে শান্তিনগর ছাড়া অন্য কোনো স্থানে ডানে মোড় নেয়ার সুযোগ নেই। তিনতলাবিশিষ্ট ফ্লাইওভার নির্মাণ করা হলেও মগবাজার, বিশ্বরোড ইন্টারসেকশন ও টঙ্গী ডাইভারশন রোডে ওঠার কোনো র্যাম্প রাখা হয়নি। এতে ফ্লাইওভারের যানবাহনের সংখ্যা কমে যাবে বলে ধারণা করা হচ্ছে।
স্থপতি ইকবাল হাবিব জানান, জবাবদিহিতার বাইরে গিয়ে এ ধরনের অবকাঠামো নির্মাণ সামগ্রিকভাবে মঙ্গল বয়ে আনবে না। মগবাজার-মৌচাক ফ্লাইওভারের নকশার ত্রুটি মহাখালী ফ্লাইওভারের ক্ষেত্রেও ছিল। মহাখালী ফ্লাইওভার নির্মাণের ফলে এয়ারপোর্ট পর্যন্ত সচল ডাইভারশন তৈরি করা যায়নি। মহাখালী ফ্লাইওভারের কার্যকারিতা বাড়াতে তেজগাঁও শিল্প এলাকার দিকে একটা উইং দরকার ছিল, এটাও করা যায়নি। মহাখালীর মতো মগবাজার-মৌচাক ফ্লাইওভারও এক প্রকার অকার্যকর করে নির্মাণ করা হচ্ছে।
তিনি আরো বলেন, আমাদের গাড়িচালকরা কোন দিকে বসেন, অথবা আমরা জাপান-যুক্তরাষ্ট্র নাকি ব্রিটিশ- কোনো সিস্টেমে চলব, তা বিবেচনা করা ছাড়াই এটি নির্মাণ করা হয়েছে। এসব বিবেচনা না করার ক্ষেত্রে অন্যতম কারণ গণশুনানি ছাড়াই এ ধরনের বড় অবকাঠামো নির্মাণ। আর গণশুনানি হয় না বলেই এ ধরনের অবকাঠামো নির্মাণের সময়ও জনদুর্ভোগের বিষয়টি গুরুত্ব দেয়া হয় না।
জানা গেছে, ২০০৩ সালের দিকে যুক্তরাষ্ট্রের একটি প্রতিষ্ঠান মগবাজার-মৌচাক ফ্লাইওভারের নকশা প্রণয়ন করে।
এসএ/এসএইচএস/বিএ