একজন ডাক্তারের ফাঁসি


প্রকাশিত: ০৫:৩৬ এএম, ১৫ জানুয়ারি ২০১৬

অফিস শেষ করেছি। এখন খোলা সবুজ লনের মাঝে সরু একটা রাস্তা ধরে হাসপাতালের দিকে যাচ্ছি। শীতের শেষ বেলায় হালকা রোদে হাঁটছি। মনটা ফুরফুরে। হাসপাতালে একজন রোগী দেখতে যাচ্ছি। বিশেষজ্ঞ ডাক্তার হিসেবে আমাকে ডাকা হয়েছে। এই রোগী একজন পরিচিত ডাক্তার। জেল পুলিশ তার রুমের বাইরে পাহারা দিচ্ছে। এই ডাক্তারের যাবজ্জীবন কারাদণ্ড হয়েছে। প্রায় এক যুগ আগে যখন এ শহরে এসেছিলাম তখন তার সাথে আমার প্রথম পরিচয়। তিনি ছিলেন একজন ডাকসাইটে হৃদরোগ বিশেষজ্ঞ। অগাধ সম্পত্তির মালিক ছিলেন তিনি। অস্বাভাবিক দম্ভ আর কড়া মেজাজের জন্য তার দুর্নাম ছিল।

তিনি অনেক রুগীকে না দেখেও তাদের দেখেছেন বলে অর্থ কামিয়েছেন সরকারের তহবিল থেকে। একটি ওষুধের পার্শ্ব প্রতিক্রিয়ার গবেষণাতে জেনে শুনে ভুল তথ্য গোপন করেছিলেন ওষুধ কোম্পানির কাছ থেকে বিপুল অর্থের বিনিময়ে। অবশেষে ধরা পড়লেন। প্রথমে তার বিরুদ্ধে মামলা হলো। ফ্লোরিডা অঙ্গ রাজ্যের মেডিকেল বোর্ড তাদের নিজস্ব তদন্তে তাকে অপেশাগত কাজের জন্য তার মেডিকেল চিকিৎসার সনদপত্র বাতিল করল। ফৌজদারি আদালত তাকে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড দিল। তার সব সম্পত্তি বাজেয়াপ্ত হয়েছে। গত দু’বছর ধরে তিনি সেই সাজা পাচ্ছেন। মরবার আগ পর্যন্ত তা চলবে।

অপরাধ প্রমাণ হওয়ার আগ পর্যন্ত তাকে কেউ অপরাধী বলে গালি দেয়নি। তার অফিসে কেউ ঢিল মারেনি। তার সামাজিক মর্যাদা ক্ষুণ্ণ হয়নি। তাকে দেখলাম। পরীক্ষা করলাম। তার পরিবারের কেউ জানে না সে এখানে। তার জন্য কেউ তার পছন্দের খাবার পাঠায়নি। তার বয়স প্রায় ৭০ । তিনি খুব বেশিদিন বাঁচবেন না। হাসপাতাল থেকে বেরিয়ে সেই একি পথ ধরে গাড়ির কাছে যাচ্ছি। অন্ধকার হয়ে এসেছে। মনটা বিষণ্ণ।

আজ বাংলাদেশের পত্রিকাতে একটি খবর দেখলাম। একজন স্ত্রী রোগ বিশেষজ্ঞ ডাক্তারের ফাঁসির দাবিতে আন্দোলন হচ্ছে। ডাক্তারটির হাসপাতালটি ভাংচুর হয়েছে। এই ডাক্তারটির বিরুদ্ধে অপরাধ ভয়াবহ। তার চিকিৎসার গাফিলতিতে একজন প্রসূতির মৃত্যু হয়েছে। সদ্য জন্ম নেয়া শিশুটি তার মাকে দেখতে পেল না। এটি একটি হৃদয় বিদারক ঘটনা। এই প্রসূতিটি একজন মন্ত্রীর আত্মীয়।

ঘটনাটি প্রমাণ না হওয়া পর্যন্ত এই ডাক্তারটিকে ফাঁসির দড়ির কাছে নেয়াটা সঠিক নয়। বাংলাদেশে বি.এম.ডি.সি বলে যে সংস্থা রয়েছে তাদের এখানে একটা মুখ্য ভুমিকা আছে। তারা পেশাজীবীদের এ ধরনের আচরণের তদন্ত করবেন, তাদের দোষী বা নির্দোষী প্রমাণ করবেন। এটা জনগণের জন্য যেমন দরকার, তেমনি একজন ডাক্তারের জন্যও দরকার। যাতে একজন নির্দোষ ডাক্তার যেন অহেতুক কষ্ট না পান। আর একজন দোষী ডাক্তার যেন তার প্রাপ্য সাজা পান। একি সাথে ফৌজদারি বিচারও চলতে পারে।

একটি দেশ যখন মধ্য আয়ের দেশ হয়েছে, একটি দেশ যখন আরও উঁচুতে যাবার পথে রয়েছে, এখনি আমাদের সময় এসেছে আমাদের পেশাগত মূল্যবোধগুলো উপরে তুলে ধরার, আমাদের পেশাজীবীদের সংস্থাগুলোকে শৃঙ্খলার মাঝে আনার। এতে পঁচা আপেলগুলো ছুঁড়ে ফেলা যাবে। অযথা হারাবে না প্রাণ। ডাক্তার হবে সাবধানী। আর ডাক্তারদের ফাঁসির জন্য মানব্বন্ধন হবে না দীর্ঘ।

লেখক : ডা. বিএম আতিকুজ্জামান, পরিপাকতন্ত্র ও লিভার বিভাগীয় প্রধান, ফ্লোরিডা হাসপাতাল, ফ্যাকাল্টি, কলেজ অব মেডিসিন, সেন্ট্রাল ফ্লোরিডা ইউনিভার্সিটি

এআরএস/আরআইপি

পাঠকপ্রিয় অনলাইন নিউজ পোর্টাল জাগোনিউজ২৪.কমে লিখতে পারেন আপনিও। লেখার বিষয় ফিচার, ভ্রমণ, লাইফস্টাইল, ক্যারিয়ার, তথ্যপ্রযুক্তি, কৃষি ও প্রকৃতি। আজই আপনার লেখাটি পাঠিয়ে দিন [email protected] ঠিকানায়।