শঙ্কায় আড়াই লাখ শিক্ষার্থী
অষ্টম জাতীয় বেতন কাঠামো সংশোধন করে সিলেকশন গ্রেড ও টাইম স্কেল বহাল রেখে স্বতন্ত্র বেতন কাঠামো গঠনের দাবিতে গত আট মাস যাবত আন্দোলন করছেন পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকরা। বিভিন্ন সময়ে তিন ঘণ্টার কর্মবিরতি, অবস্থান ধর্মঘট, মানববন্ধন ও সমাবেশ কর্মসূচি পালন করলেও এবার শিক্ষকরা শুরু করেছেন লাগাতার কর্মবিরতি।
সোমবার (১১ জানুয়ারি) থেকে দেশের ৩৭টি পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে একযোগে এ কর্মবিরতি শুরু হয়। শিক্ষকদের এ আন্দোলনে অনিশ্চয়তার মুখে পড়েছে পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের দুই লাখ ৩১ হাজার ৬৯০ জন শিক্ষার্থীর শিক্ষা জীবন।
একমাত্র ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ছাড়া বাকি সবকটি বিশ্ববিদ্যালয়ে ক্লাস-পরীক্ষা সব বর্জন করা হয়। শিক্ষার্থীদের অনুরোধে শুধুমাত্র সেমিস্টার ফাইনাল এবং ফাইনাল পরীক্ষা নেয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছে ঢাবি শিক্ষক সমিতি। সিদ্ধান্ত অনুযায়ী সেমিস্টার ফাইনাল এবং ফাইনাল পরীক্ষাসমূহ অনুষ্ঠিত হলেও বন্ধ রয়েছে মিডটার্মসহ নিয়মিত ক্লাসসমূহ। শিক্ষার্থীরা মনে করেন, এমন পরিস্থিতিতে তারা পিছিয়ে পড়তে পারেন। দীর্ঘ দিনের সেশনজটেও পড়ার আশঙ্কা তাদের।
শিক্ষকরা বলছেন, তারা বেতন-ভাতা ইস্যুতে এ আন্দোলন করছেন না। তারা আন্দোলন করছেন নতুন বেতন কাঠামোর ওয়ারেন্ট অব প্রেসিডেন্সে নিজেদের মর্যাহানির বিরুদ্ধে। মর্যাদা রক্ষায় শিক্ষকরা কোনোভাবেই ছাড় দেবেন না। মর্যাদা রক্ষার আন্দোলন যতদিন লাগবে ততদিন পর্যন্ত চালিয়ে যাবেন তারা।
বাংলাদেশ বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশনের সর্বশেষ রেকর্ড অনুযায়ী, বর্তমানে দেশের ৩৭টি পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের মোট শিক্ষার্থীর সংখ্যা দুই লাখ ৩১ হাজার ৬৯০। যার মধ্যে এক লাখ ৫৮ হাজার ৪৯৬ জন ছাত্র এবং ৭৩ হাজার ১৯৪ জন ছাত্রী। চলমান পরিস্থিতিতে দেশের উচ্চ শিক্ষা পর্যায়ের বৃহৎ এ অংশটির ক্ষতির আশঙ্কা করছেন শিক্ষার্থী থেকে শুরু করে শিক্ষকরাও।
তবে বাংলাদেশ বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক সমিতি ফেডারেশনের সভাপতি অধ্যাপক ফরিদ উদ্দিন আহমেদ বলেন, ‘শিক্ষার্থীরা হচ্ছে আমাদের প্রাণ। তাদের ক্ষতি হবে বলে আমরা ইতোপূর্বে কঠিন কোনো কর্মসূচি দেয়া থেকে বিরত ছিলাম। আমরা দাবি আদায় হওয়ার পর শিক্ষার্থীদের মেকআপ ক্লাস নিয়ে ক্ষতি পুষিয়ে নেবো।’
এমন পরিস্থিতিতে প্রধানমন্ত্রী থেকে শুরু করে সরকারের সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের দায়িত্বশীল আচরণ কামনা করছেন শিক্ষার্থীরা। অন্যদিকে শিক্ষকদের দাবির সঙ্গে সহমত পোষণ করলেও ক্লাস ও পরীক্ষা বন্ধ করে দেয়া অযৌক্তিক মনে করেন ছাত্র-ছাত্রীরা। তারা বলছেন, আমরা সেশনজটে পড়তে পারি। তাই সরকারের উচিত হবে শিক্ষকদের ন্যায্য দাবিসমূহ মেনে নেয়া।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের লেদার প্রোডাক্ট ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের ২য় বর্ষের ছাত্র মোহাম্মদ ওয়ালী উল্যাহ জাগো নিউজকে বলেন, ‘শিক্ষকদের চলমান আন্দোলন অত্যন্ত যৌক্তিক। কারণ দেশ গড়ার সর্বোচ্চ কারিগরদের মর্যাদাহানি করার অর্থ পুরো জাতির মর্যাদাহানি করা। জাতিকে একটি বিভীষিকাময় পরিস্থিতির দিকে ঠেলে দেয়ার একট চক্রান্ত। যেহেতু শিক্ষকরা বেতন-ভাতার বিষয়ে আন্দোলন করছেন না, সেহেতু তাদের জন্য সরকার সতন্ত্র বেতন কাঠামো তৈরি করতে পারেন। কারণ শিক্ষক শিক্ষকই, তার সঙ্গে আর কারো তুলনা চলে না।’
তিনি বলেন, ‘আমি মনে করি আমাদের স্যাররা তাদের শিক্ষার্থীদের জন্য যথেষ্ট আন্তরিক। যার কারণে এতদিন পর্যন্ত তারা কোনো কঠিন কর্মসূচিতে যাননি। এখন লাগাতার কর্মবিরতির মধ্যেও আমাদের সেমিস্টার ফাইনাল/ফাইনাল পরীক্ষা নেয়ার সিদ্ধান্ত গ্রহণ প্রমাণ করে তারা বেতন-ভাতার জন্য আন্দোলন করছেন না।’
অন্যদিকে শিক্ষা ও গবেষণা ইনস্টিটিউটের ৪র্থ সেমিস্টারের ছাত্রী ফারজানা স্বর্ণাও শিক্ষকদের দাবি যৌক্তিক বলে মনে করেন। তিনি বলেন, ‘আমাদের সাময়িক একটু ক্ষতি হলেও শিক্ষকদের চলমান আন্দোলন অত্যন্ত যৌক্তিক। তাই সরকারের উচিত হবে শিক্ষকদের যৌক্তিক দাবিসমূহ মেনে নেয়া, যাতে তারা আবার কর্মবিরতি বন্ধ করে ক্লাসে ফিরে যেতে পারেন।’
তবে শিক্ষক আন্দোলনে নিজেদের পিছিয়ে পড়ার আশঙ্কা করছেন রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগের চতুর্থ বর্ষের শিক্ষার্থী জোবাইদা জ্যোতি। তিনি জাগো নিউজকে বলেন, ‘আমাদের ফাইনাল পরীক্ষা আগামী ২০ জানুয়ারি অনুষ্ঠিত হওয়ার কথা। কিন্তু এই সময়ে শিক্ষকদের আন্দোলন পরীক্ষার প্রস্তুতি নিতে আমাদের বাধাগ্রস্ত করছে। আমরা পিছিয়ে পড়ার আশঙ্কাবোধ করছি।’
সেশনজটের আশঙ্কা করে তিনি বলেন, ‘কয়েক বছর আগেও রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রায় অধিকাংশ বিভাগের শিক্ষার্থী নানা মেয়াদে সেশনজটে ভুগছিলেন। তবে এর মধ্যে সেই জট অনেকটা কাটিয়ে উঠছিলেন শিক্ষকরা। তবে এই আন্দোলনে সেই জট আবার ঊর্ধ্বগামী হবে বলে আমি মনে করি।’
একই বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাস বিভাগের শিক্ষার্থী হিরু মোহাম্মদ জাগো নিউজকে বলেন, ‘শিক্ষকদের এই আন্দোলনে সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছি আমরা। এই আন্দোলন অব্যাহত থাকলে বড় ধরনের জটের আশঙ্কা করছি। তাছাড়া আমাদের এই জট কাটিয়ে উঠতে বেশ চাপের মুখে পড়তে হতে পারে।’
এদিকে শিক্ষকদের ক্লাস-পরীক্ষা বর্জনকে অর্থহীন বলে মনে করেন জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগের অষ্টম সেমিস্টারের ছাত্র ইখতিয়ার হাসান তুপান। তার মতে, শিক্ষকদের সরকারের সঙ্গে বসে আলোচনার মাধ্যমে সমস্যা সমাধান করতে হবে। তাই বলে আন্দোলনের নামে ক্লাস-পরীক্ষা বর্জন অর্থহীন। তাছাড়া শিক্ষকদের অনেকেই প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়ে টাকার বিনিময়ে ঠিকই ক্লাস নিচ্ছেন বলেও অভিযোগ এ শিক্ষার্থীর।
তবে একই বিশ্ববিদ্যালয়ের রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগের ৮ম সেমিস্টারের ছাত্র মোমিনুর রহমান মোমিন মনে করেন সমঝোতাই গ্রহণযোগ্য সমাধান। তিনি জাগো নিউজকে বলেন, ‘সমঝোতার মাধ্যমে সরকার এবং শিক্ষকদের একটা অবস্থানে আসা উচিত। আর যদি আন্দোলনই করতে হয় তাহলে শিক্ষকরা যেন পরীক্ষাসমূহ আন্দোলনের আওতামুক্ত রাখেন।’ তিনিও অভিযোগ করেন শিক্ষকরা আন্দোলনের নামে ছুটি কাটাচ্ছেন।
জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের জার্নালিজম অ্যান্ড মিডিয়া স্টাডিজ বিভাগের তৃতীয় বর্ষের শিক্ষার্থী জান্নাতুল আদন জাগো নিউজকে বলেন, ‘শিক্ষকরা তাদের মর্যাদা রক্ষার জন্য আন্দোলন করতে পারেন, কিন্তু কেন তারা শিক্ষার্থীদের ক্ষতির মুখে ঠেলে দিচ্ছেন।’
একই বিশ্ববিদ্যালয়ের ভূগোল ও পরিবেশ বিভাগের চতুর্থ বর্ষের শিক্ষার্থী শরিফুল কবির শামীম বলেন, ‘যাদের আন্দোলনই হোক না কেন মূলকথা হলো আমরা সেশনজটে পড়ছি, কিন্তু আমাদের কথা সরকার এবং শিক্ষকদের কেউই ভাবেন না।’
এমএইচ/বিএ
প্রতিবেদনটি তৈরিতে সহযোগিতা করেছেন জাগো নিউজের জবি, জাবি এবং রাবি প্রতিনিধি।