অপরাধ তদন্তে নারী অনেকেই মেনে নিতে পারে না: নাজিয়া

নিজস্ব প্রতিবেদক
নিজস্ব প্রতিবেদক নিজস্ব প্রতিবেদক
প্রকাশিত: ০১:৫২ পিএম, ০৮ মার্চ ২০২২
কাজের স্বীকৃতি হিসেবে এক বছরের কম সময়ে অন্তত পাঁচবার পুরস্কার পেয়েছেন নাজিয়া ইসলাম

‘নারীকে পুরুষের সমকক্ষ নয়, বরং অধিক গুরুত্বপূর্ণ মনে করি। কারণ, একজন মেয়ে সারাজীবন যে পরিমাণ প্রতিকূলতা অতিক্রম করে, তা অকল্পনীয়। নিজের যোগ্যতা প্রমাণ করতে হলে তাকে পুরুষের চেয়ে অনেক বেশি পরীক্ষায় অবতীর্ণ হতে হয়।’

আন্তর্জাতিক নারী দিবস উপলক্ষে এসব কথা বলেন ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশের রমনা বিভাগে কর্মকর্তা নাজিয়া ইসলাম।

২০২১ সালের ১৭ এপ্রিল ডিবির রমনা বিভাগে অবৈধ অস্ত্র উদ্ধার ও মাদক নিয়ন্ত্রণ টিমের সহকারী পুলিশ কমিশনার (এসি) হিসেবে যুক্ত হন নাজিয়া। তিনি তার কাজের স্বীকৃতি হিসেবে এক বছরেরও কম সময়ে অন্তত পাঁচবার পুরস্কার পেয়েছেন। সবশেষ অজ্ঞানপার্টির সদস্যদের গ্রেফতারের জন্য জানুয়ারিতে মাসিক অপরাধ পর্যালোচনা সভায় শ্রেষ্ঠ হন। এছাড়া অনলাইন জুয়া চক্রের সদস্যদের গ্রেফতার, বিদেশি ভেজাল মদ, বিদেশি অস্ত্র উদ্ধার, ডাকাত ধরা, অস্ত্রসহ ভুয়া ডিবি পুলিশ আটক করে পুরস্কার ও সুনাম অর্জন করেছেন।

নাজিয়া ইসলামের জন্ম ঢাকার শাহাজানপুর রেলওয়ে কলোনিতে। বাবা ছিলেন রেল কর্মকর্তা। মা জায়িকা বেগম। তিন বোনের মধ্যে বড় নাজিয়া। বেড়ে ওঠাও ঢাকায়।

মাঝে কয়েক বছর বাবার চাকরির সুবাদে কাটিয়েছেন চট্টগ্রামে। আহসানুল্লাহ ইউনিভার্সিটি অব সাইন্স অ্যান্ড টেকনোলজি থেকে কম্পিউটার সাইন্সে গ্রাজুয়েশন করেন। পুলিশে যোগদানের আগে চাকরি করেন একটি সফটওয়্যার কোম্পানিতে। এরপর ৩৪তম বিসিএসে ২০১৬ সালে পুলিশ ক্যাডারে মনোনীত হয়ে ওই বছরের ১ জুলাই চাকরিতে যোগ দেন নাজিয়া।

নারী হয়ে বেশির ভাগ সময় অপরাধীদের নিয়ে কাজ করা কতটা চ্যালেঞ্জ জানতে চাইলে নাজিয়া বলেন, ক্রাইমে (অপরাধ তদন্ত) একটা মেয়ের জন্য কাজ করা খুবই কঠিন। এখনো অনেকেই এটা মেনে নিতে পারে না। একটা মেয়ে ক্রাইমে কাজ করছে। রাত বাইরে থাকছে। এটা এখনো মানুষের মেন্টালিটির সঙ্গে অ্যাডজাস্ট করে না।

তিনি বলেন, আমার অনেক প্রতিবন্ধকতা ফেস করতে হয়েছে। মেইন যেটা ফেস করছি- আসামিদের আনার পর, তারা লেডি অফিসারের আন্ডারে ইন্টারোগেট করার সময় কোনো কিছু কো-অপারেট করতে চায় না। এমন একটা রিঅ্যাক্ট করে যে, আমি তাদের ইন্টারোগেট করতে পারবো না। তারা গ্রাহ্য করে না। এমনিতেই তো অপরাধীরা অনেক দুষ্টু প্রকৃতির হয়।

প্রথমদিকে পরিবার খুব দুশ্চিন্তায় থাকতো জানিয়ে নাজিয়া বলেন, দায়িত্বের কারণে দেখা যাচ্ছে তিন-চার দিন আমি বাসায় যেতে পারি না। প্রথমদিকে বাবা এটা খুবই রিস্ক মনে করতেন। এমনও হয়েছে তিন-চার দিন ধরে লাগাতার ফিল্ডে থাকতে হয়েছে। অপরাধীকে ফলো করছি, তো করছি...। একটা বিষয় নিয়ে কাজ শুরু করলে তা শেষ না করা পর্যন্ত লেগে থাকতে হয়।

একটু এদিকে-সেদিক হলে অপরাধী ধরা মুশকিল হয়ে যায় বলে জানান এই গোয়েন্দা কর্মকর্তা। তিনি বলেন, একজনকে টার্গেট করেছি। সে মুভ করতেছে। তার পেছনে আমিও মুভ করছি। মুভ করতে করতে একপর্যায়ে গিয়ে হয়তো তাকে ধরতে পারছি। স্যারদের নির্দেশনায় আল্লাহর রহমতে আমার সাকসেস রেট ৯৯ শতাংশ।

সবশেষ ভুয়া ডিবি পুলিশ পরিচয়ে বিদেশি অস্ত্রসহ ডাকাত দলের পাঁচ সদস্যকে গ্রেফতার করেন নাজিয়া ইসলাম। এ বিষয়ে তিনি বলেন, শেষ অপারেশনটা খুব রিস্কি ছিল। প্রথমে ভেবেছিলাম নরমাল অস্ত্র। শেষ পর্যন্ত জানতে পারলাম লোডেড বিদেশি পিস্তল রয়েছে। আমরা বারবার ক্রস চেক করে দেখলাম যে, আসলেই লোডেড পিস্তল। সর্বোচ্চ ৩০ সেকেন্ডের টার্গেট নিয়ে তাদের ধরি। কারণ ওই সময়ের মধ্যে ধরতে না পারলে তারা গুলি করে দেবে।

অপরাধ তদন্তে নারী অনেকেই মেনে নিতে পারে না: নাজিয়া

পুলিশের মহাপরিদর্শক (আইজিপি) বেনজীর আহমেদকে স্যালুট জানাচ্ছেন নাজিয়া ইসলাম

মেয়ে হয়ে পুলিশে আসা কেন জানতে চাইলে নাজিয়া বলেন, আমি খুবই কনজারভেটিভ পরিবারের মেয়ে। আমার বাবা-মা খুবই কনজারভেটিভ। তারা কখনোই চাননি এটি। তারা চেয়েছেন-তাদের মেয়ে ব্যাংকার হবে অথবা শিক্ষক। নিরিবিলি কোনো জব তাদের পছন্দ ছিল।

তিনি আরও বলেন, আমি যখন বুঝতে শিখেছি তখন থেকেই চিন্তা ছিল, এমন একটা জায়গায় কাজ করবো যেখানে আমার মেধা আর সাহস কাজে লাগাতে পারবো। যেটায় অ্যাডভেঞ্চার আছে। ক্রাইম রিলেটেড অ্যাডভেঞ্চার। এ কারণে আসলে পুলিশে আসা। আমাকে যখন ভাইবা বোর্ডে জিজ্ঞেস করা হয়, তুমি কেন পুলিশে আসতে চাও। আমার মনে হয়েছে পুলিশে আসলে আমি কিছু দিতে পারবো।

নাজিয়া বলেন, আমি নিজেকে কখনো মেয়ে মনে করি না। এমনও হয়েছে অপারেশন করতে করতে আমার টিমের ছেলেরা টায়ার্ড হয়ে গেছে। কিন্তু আমি তো ঠিক আছি। তখন তারা আবার নতুন উদ্দীপনা পেয়েছে। আমার মা বলতেন, ‘তুমি যাই করো তা যেন মানব কল্যাণে হয়। একটা মানুষেরও যদি মঙ্গল করতে পারো তাই তোমার অর্জন।’ বিশেষ করে মা আমাকে সব সময় এতো সাপোর্ট দেন যা বলার মতো না। যতো রাত হোক যতো সমস্যা হোক আমি সব শেয়ার করতে পারি মায়ের কাছে। আর তিনিও আমাকে সাপোর্ট দেন। মায়ের সঙ্গে সম্পর্ক বন্ধুত্বের।

২০২২ সালে এসেও নারীরা বৈষম্যের শিকার উল্লেখ করে তিনি বলেন, নারীকে নিজের যোগ্যতা প্রমাণ করতে হলে তাকে একজন পুরুষের চেয়ে অনেক বেশি পরীক্ষায় অবতীর্ণ হতে হয়। তাই বলে মেয়েরা থেমে নেই, থেমে যাবেও না। যত কষ্টই হোক, বাধা-বিপত্তি আসুক, নিজেকে নিয়ে যেতে হবে স্বপ্নের সীমানায়।

অপরাধ তদন্তে নারী অনেকেই মেনে নিতে পারে না: নাজিয়া

বিসিএসে ভাইবার কথা মনে করে নাজিয়া ইসলাম বলেন, তখন আমাকে প্রশ্ন করা হয়েছিল, ‘নারীর ক্ষমতায়নের উদাহরণ দাও।’ উত্তর দিয়েছিলাম, আমাদের মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা হার না মেনে এগিয়ে চলা এক নারী। আমৃত্যু এটাই বিশ্বাস থাকবে।

নাজিয়ার মাথায় সব সময় কাজ করে অপরাধী ধরা। তিনি বলেন, আমার রাতের স্বপ্নগুলোও এরকম হয় যে, আমি একদিন বোনের সঙ্গে ঘুমাচ্ছি, আমি না কি ঘুমের মধ্যে বলে উঠেছি, ‘ইস! ধরতে পারলাম না।’ ঘুমের মধ্যেও আমার মাথায় এগুলো ঘুরতে থাকে। স্বপ্নের মধ্যে দেখা যাচ্ছে যে অভিযান পরিচালনা করছি। লাইফটা একেবারে দায়িত্ব পালনের সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে জড়িয়ে গেছে।

অপরাধী ধরা এখন অনেক চ্যালেঞ্জের উল্লেখ করে গোয়েন্দা পুলিশের এই কর্মকর্তা বলেন, আগে টেকনোলজি ব্যবহার করে যতটা সহজে অপরাধী ধরা যেত এখন তা আরও কঠিন। কখনো তারা ডিজিটাল কখনো ম্যানুয়ালি চলে আসছে। ফলে এখন ম্যানুয়াল এবং টেকনোলজি দুটি ব্যবহার করতে হচ্ছে।

টিটি/জেডএইচ/জেআইএম

পাঠকপ্রিয় অনলাইন নিউজ পোর্টাল জাগোনিউজ২৪.কমে লিখতে পারেন আপনিও। লেখার বিষয় ফিচার, ভ্রমণ, লাইফস্টাইল, ক্যারিয়ার, তথ্যপ্রযুক্তি, কৃষি ও প্রকৃতি। আজই আপনার লেখাটি পাঠিয়ে দিন [email protected] ঠিকানায়।