শিক্ষক আন্দোলনে বিপর্যস্ত শিক্ষা ব্যবস্থা


প্রকাশিত: ০২:৪৭ পিএম, ১১ জানুয়ারি ২০১৬

৩৭টি পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের লাগাতার ধর্মঘটের কারণে ক্লাস পরীক্ষা বন্ধ রয়েছে। ৩০৬টি সরকারি কলেজের শিক্ষকরা প্রতিদিন দুই ঘণ্টা করে কর্মবিরতি পালন করছেন। ফলে বছরের শুরুতেই বিশ্ববিদ্যালয় ও সরকারি কলেজের অর্ধকোটিরও বেশি শিক্ষার্থীর পড়াশুনা ব্যাহত হচ্ছে। একই সঙ্গে এমপিওভুক্ত শিক্ষকরাও শর্তহীনভাবে দাবি আদায়ে কর্মসূচি ঘোষণা করেছেন। দাবি আদায় না হলে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে তালা ঝুলিয়ে দিয়ে লাগাতার ধর্মঘটের হুমকি দিয়েছেন। প্রাথমিকের শিক্ষকরাও যেকোন সময় আন্দোলনে নামতে পারেন। ফলে শিক্ষকদের আন্দোলনে অচল হয়ে পড়তে পারে গোটা শিক্ষা ব্যবস্থা।

বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক সমিতি ফেডারেশন সূত্রে জানা গেছে, অষ্টম জাতীয় বেতন স্কেলের এর আগে বিশ্ববিদ্যালয়ের মোট অধ্যাপকের ২৫ শতাংশ সিলেকশন গ্রেড পেয়ে গ্রেড-১-এ যেতে পারতেন। নতুন বেতন কাঠামোতে সিলেকশন গ্রেড তুলে দেয়ায় সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের গ্রেড-১-এ যাওয়ার পথ বন্ধ হয়ে গেছে। বেতন স্কেলের প্রজ্ঞাপন অনুযায়ী কার্যত তৃতীয় গ্রেড থেকেই তাদের অবসরে যেতে হবে।

অষ্টম জাতীয় বেতন স্কেল ঘোষণার পর থেকেই বেতন বৈষম্য ও মর্যাদার অবনমনের প্রতিবাদে কালো ব্যাজ ধারণ, কর্মবিরতি পালনসহ নানা কর্মসূচি পালন করেছেন বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষকরা। সোমবার থেকে পাঠদান ও পরীক্ষা নেয়া বন্ধ করে ৩৭টি পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকরা লাগাতার কর্মবিরতি পালন করছেন।

খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, দেশের ইতিহাসে একযোগে সব পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষকদের নজিরবিহীন কর্মবিরতিতে ভোগান্তিতে পড়েছেন প্রায় ৫৬ লাখ শিক্ষার্থী। অনেক বিশ্ববিদ্যালয়ের ফাইনাল পরীক্ষার মাঝপথে এই কর্মবিরতি শুরু হওয়ায় পরীক্ষা নিয়ে অনিশ্চয়তায় পড়েছেন শিক্ষার্থীরা। শিক্ষকদের কর্মবিরতির প্রথম দিন সোমবার থেকেই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়সহ দেশের সবগুলো পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে নিয়মিত ক্লাস ও পরীক্ষা বন্ধ রয়েছে। শ্রেণিকক্ষ ও শিক্ষকদের রুমগুলোতে ঝুলছে তালা। শিক্ষকদের কর্মবিরতির কারণে শিক্ষার্থীদের মধ্যেও দীর্ঘ সেশনজটের আশঙ্কা দেখা দিয়েছে।

বাংলাদেশ বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক সমিতির মহাসচিব অধ্যাপক এ এস এম মাকসুদ কামাল বলেন, শিক্ষকদের পক্ষ থেকে যে দাবি জানানো হয়েছিল তার বাস্তবায়ন না হওয়ায় লাগাতার কর্মবিরতিতে যেতে শিক্ষকরা বাধ্য হয়েছেন। তবে আন্দোলন দীর্ঘদিন চললে শিক্ষার্থীরা সেশনজটে পড়তে পারে। আর এজন্য সরকারই দায়ী থাকবে। ২ জানুয়ারি কর্মবিরতি ঘোষণার পর থেকে এখন পর্যন্ত সরকারের কোন পর্যায়ের সঙ্গে তাদের কোনো আলোচনা হয়নি বলেও ক্ষোভ প্রকাশ করেন তিনি।

তিনি আরো বলেন, সিনিয়র মন্ত্রীরা পর্যন্ত শিক্ষকদের দাবি বাস্তবায়নের জন্য সুপারিশ করেছেন। কিন্তু এটা যাদের বাস্তবায়নের কথা তারা তা বাস্তবায়ন করেনি। দাবি আদায় না হওয়া পর্যন্ত আন্দোলন চলবে বলেও জানান তিনি।

শিক্ষামন্ত্রী নুরুল ইসলাম নাহিদ বলেন, শিক্ষকদের দাবিগুলো তারা অর্থ মন্ত্রণালয়কে জানিয়েছেন। দাবির বিষয়গুলো নিয়ে সরকারের বিভিন্ন পর্যায়ে আলাপ-আলোচনা চলছে।

সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের কর্মবিরতির আগেই আন্দোলনে নেমেছেন ৩০৬টি সরকারি কলেজের প্রায় ১৫ হাজার শিক্ষক। সিলেকশন গ্রেড, টাইম স্কেল বাতিল করায় এবং অধ্যাপকদের বিদ্যমান বৈষম্যমূলক বেতন স্কেল আপগ্রেডেশনের দাবিতে ৪ ও ৫ জানুয়ারি সারাদেশের সব সরকারি কলেজ বন্ধ রেখে শিক্ষকরা সর্বাত্মক কর্মবিরতি পালন করেছেন। কিন্তু তাদের দাবির কোনো বাস্তবায়ন না হওয়ায় সোমবার থেকে ২২ জানুয়ারি পর্যন্ত প্রতিদিন বেলা ১২টা থেকে দুই ঘণ্টা কর্মবিরতি পালন করবেন।

বিসিএস সাধারণ শিক্ষা সমিতির মহাসচিব আই কে সেলিম উল্লাহ খন্দকার বলেন, ‘তাদের কর্মবিরতির পরও দাবি মানা না হলে ২২ জানুয়ারি সাধারণ সভা করে পরবর্তী কর্মসূচি ঘোষণা করা হবে।’ তবে পরবর্তী কর্মসূচি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের মতো লাগাতার ধর্মঘটের কথা ভাবছেন বলে সংগঠনের নেতারা জানিয়েছেন। কর্মবিরতির আন্দোলনে নামলে জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের অধিভুক্ত সরকারি কলেজগুলোর অন্তত ২৬টি পরীক্ষা পিছিয়ে যেতে পারে। সবচেয়ে ক্ষতিগ্রস্ত হবেন আসন্ন এইচএসসি পরীক্ষার্থীরা। বিশ্ববিদ্যালয় ও সরকারি কলেজের শিক্ষকদের আন্দোলনের মাঝেই শর্তহীনভাবে অষ্টম জাতীয় বেতন কাঠামো কার্যকরের দাবিতে কর্মসূচি ঘোষণা করেছেন এমপিওভুক্ত শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের শিক্ষক-কর্মচারীরা।

শিক্ষক সমিতির সভাপতি মুহম্মদ আবু বকর সিদ্দিক বলেন, ‘দান-সহায়তা’ দেয়ার ঘোষণার মাধ্যমে শিক্ষকদের অপমান করা হয়েছে। শর্তহীন বেতন স্কেল কার্যকরসহ শিক্ষানীতির বাস্তবায়নের দাবিতে মঙ্গলবার থেকে ১৪ জানুয়ারি শিক্ষক-কর্মচারীদের কালোব্যাজ ধারণ এবং ১৬ জানুয়ারি এক ঘণ্টা কর্মবিরতি পালন করা হবে। এছাড়া ১৮ জানুয়ারি কেন্দ্রীয় কর্মসূচি হিসেবে সকাল ১১টায় জাতীয় প্রেসক্লাবের সামনে শিক্ষক-কর্মচারীদের মানববন্ধন ও বিক্ষোভ সমাবেশ এবং প্রধানমন্ত্রীকে স্মারকলিপি প্রদান করা হবে। এরপরও যদি দাবি না মানা হয় তাহলে ফেব্রুয়ারি মাসে অনুষ্ঠিত এসএসসি পরীক্ষার পর আগামী মার্চ মাস থেকে স্কুল-কলেজে তালা ঝুলিয়ে অবিরাম ধর্মঘট পালন করা হবে।

নতুন বেতন কাঠামোতে শতভাগ বেতন বাড়লেও আন্দোলনের প্রস্তুতি নিচ্ছেন সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষকরা। সংগঠনের নেতারা সংবাদ সম্মেলন করে দাবি জানিয়েছেন, নতুন পে-স্কেলে টাইম স্কেল ও সিলেকশন গ্রেড তুলে দেওয়ায় ৪০ হাজার শিক্ষক ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন। তারাও যে কোনো সময় আন্দোলনে নামতেন পারেন।

সোমবার রাজধানীর সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে আওয়ামী লীগ আয়োজিত এক সমাবেশে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা চলমান শিক্ষক আন্দোলনের কড়া সমালোচনা করে বলেছেন, ছেলে-মেয়েদের পড়াশোনা বন্ধ করবেন না। এটি কেউ মেনে নেবে না। শিক্ষকদের বেতন ১২৩ ভাগ বাড়ানোর পরও কেন তাদের এই আন্দোলন প্রশ্ন রেখে তিনি বলেন, শিক্ষা কার্যক্রম যেন সুষ্ঠুভাবে চলে এটি আমরা চাই।

বিশ্লেষকদের মতে, বেতনভাতার ইস্যুতে সব পর্যায়ের শিক্ষকদের আন্দোলনের ইতিহাস দেশে এই প্রথম। এ আন্দোলন অনেক দূর পর্যন্ত গড়াতে পারে। এর সঙ্গে তৃতীয় কোনো পক্ষ ভিড়ে যেতে পারে। শিক্ষক আন্দোলনকে ইস্যু করে দেশে অস্থিতিশীল পরিস্থিতি সৃষ্টি হতে পারে। যে কারণে ইস্যুটি দ্রুত নিরসনের জন্য সরকারের প্রতি আহ্বান জানিয়েছেন।

এনএম/জেডএইচ/আরআইপি

পাঠকপ্রিয় অনলাইন নিউজ পোর্টাল জাগোনিউজ২৪.কমে লিখতে পারেন আপনিও। লেখার বিষয় ফিচার, ভ্রমণ, লাইফস্টাইল, ক্যারিয়ার, তথ্যপ্রযুক্তি, কৃষি ও প্রকৃতি। আজই আপনার লেখাটি পাঠিয়ে দিন [email protected] ঠিকানায়।