চালু হচ্ছে পতেঙ্গা টার্মিনাল, ‘অগ্রগতি’ নেই বে-টার্মিনালের
চলতি বছরের মাঝামাঝি সময়ে শেষ হচ্ছে চট্টগ্রাম সমুদ্রবন্দরের পতেঙ্গা কনটেইনার টার্মিনালের (পিসিটি) নির্মাণ কাজ। শেষ মুহূর্তের কাজের পাশাপাশি এখন আলোচনা হচ্ছে এটি পরিচালনার বিষয়ে। দেশি নাকি বিদেশি? বিদেশি হলে কোন দেশের কোম্পানিকে দিয়ে?
এসব নিয়ে চলছে সরকারের ঊর্ধ্বতন মহলে দেন-দরবার। তবে পিসিটির কাজ সমাপ্তের দিকে হলেও দৃশ্যমান কোনো অগ্রগতি নেই বন্দরের মেগা প্রকল্প বে-টার্মিনালের। এখনো জমি অধিগ্রহণ এবং ফিজিবিলিটি স্টাডিতে আটকে আছে প্রকল্পটি।
বন্দর সূত্র জানায়, সময়ের ব্যবধানে বন্দরে পণ্য কিংবা কনটেইনার হ্যান্ডলিংয়ের পরিমাণ বাড়ছে। বাড়তি এই চাপ সামলাতে পিসিটি নির্মাণ প্রকল্প গ্রহণ করে বন্দর কর্তৃপক্ষ। বন্দরের মূল জেটি থেকে ভাটির দিকে চট্টগ্রাম ড্রাই ডক ও চট্টগ্রাম বোটক্লাবের মধ্যবর্তী প্রায় ২৬ একর জায়গায় নির্মাণ করা হচ্ছে এ প্রকল্প।
২০১৭ সালের ১৩ জুন ১ হাজার ৮৬৮ কোটি টাকা প্রাক্কলিত ব্যয়ে প্রকল্পটি অনুমোদিত হয়। বন্দরের নিজস্ব অর্থায়নে ২০১৯ সালের মধ্যে এই প্রকল্প বাস্তবায়ন করার কথা ছিল। তবে কয়েক দফা পিছিয়ে এ বছরের মাঝামাঝি জুন কিংবা জুলাইয়ে এই প্রকল্প সম্পন্ন করতে যাচ্ছে বন্দর কর্তৃপক্ষ।
জানতে চাইলে পতেঙ্গা কন্টেইনার টার্মিনালের প্রকল্প পরিচালক মিজানুর রহমান জাগো নিউজকে বলেন, এ প্রকল্পের কাজ ৮৬ ভাগ শেষ। এখন চলছে শেষ মুহূর্তের কাজ। এ বছরের জুলাইয়ে কাজ শেষ হবে বলে আশাবাদী।
সূত্র জানায়, পিসিটির অপারেশনাল কাজ শুরু হলে এই টার্মিনালে এক সঙ্গে তিনটি জাহাজ থেকে কনটেইনার ওঠানো-নামানোর সুবিধা থাকবে। এখান থেকে বছরে সাড়ে চার লাখ কনটেইনার হ্যান্ডলিং করা যাবে। এছাড়াও একই টার্মিনালে তেলবাহী জাহাজ ভেড়ানোর সুবিধাও থাকবে।
এই টার্মিনালে থাকবে ব্যাকআপ ফ্যাসিলিটিজসহ ৫৮৩ মিটার দীর্ঘ কনটেইনার জেটি, ২২০ দীর্ঘ ডলফিন জেটি, ৮৯ হাজার বর্গমিটার আরসিসি ইয়ার্ড, ২ হাজার ১২৮ বর্গমিটার কনটেইনার শুল্ক স্টেশন, ২ হাজার ১৫০ মিটার লম্বা ৬ মিটার উচ্চ কাস্টম বন্ডেড হাউজ, ২ হাজার ৫০০ মিটার রেলওয়ে ট্রাক, ৪২০ মিটার ফ্লাইওভার, এক হাজার ২০০ বর্গমিটার মেকানিক্যাল ওয়ার্কশপ এবং ৫ হাজার ৫৮০ বর্গমিটারের অফিস বিল্ডিং।
যেখানে, বর্তমানে চট্টগ্রাম বন্দর জেটিতে ৯ মিটার গভীরতা ও ১৯০ মিটার দৈর্ঘ্যের পণ্যবাহি জাহাজ ভিড়তে পারে। সেখানে এই টার্মিনাল অপারেশনে গেলে ১৯০ মিটার দৈর্ঘ্যের এবং ১০ দশমিক ৫ মিটার ড্রাফটের জাহাজ ভেড়ানো যাবে।
এসব সুবিধাসম্পন্ন এই টার্মিনাল নির্মাণ কাজ শেষের দিকে হওয়ায় বর্তমানে আলোচনা চলছে পরিচালনার বিষয় নিয়ে। সরকারের পরিকল্পনা রয়েছে টার্মিনালটি বিদেশি কোনো অভিজ্ঞ কোম্পানি দিয়ে পরিচালনার। এই লক্ষ্যে বিভিন্ন বিদেশি কোম্পানির সঙ্গে আলোচনা অব্যাহত রেখেছে সরকারি-বেসরকারি অংশীদারত্ব (পিপিপি) কর্তৃপক্ষ।
আলোচনায় রয়েছে ডেনমার্কের ‘মায়ের্কস লাইন’, সৌদি আরবের ‘রেড সি গেটওয়ে টার্মিনাল’, দুবাইয়ের ‘ডিপি ওয়ার্ল্ড’। তবে এখনো কোনো প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে চূড়ান্ত কথা হয়নি।
এদিকে, এখনো পর্যন্ত টার্মিনাল পরিচালনায় কোম্পানি চূড়ান্ত না হওয়ায় শুরুতে আদৌও বিদেশি প্রতিষ্ঠান দিয়ে পরিচালনা শুরু করা যাবে কি-না, তা নিয়ে দেখা দিয়েছে সংশয়। কারণ একটি প্রতিষ্ঠান দায়িত্ব দেওয়া হলে তারা যন্ত্রপাতি কিনে অপারেশনাল কাজে যেতে নির্দিষ্ট সময়ের প্রয়োজন রয়েছে। সেক্ষেত্রে বন্দরের উদ্যোগে অপারেশনাল কাজ শুরু হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে। পরে বিদেশি কোম্পানিকে দায়িত্ব দেওয়া হতে পারে।
জানতে চাইলে বন্দর সচিব ওমর ফারুক জাগো নিউজকে বলেন, পিপিপি কর্তৃপক্ষ অপারেটর নিয়োগ করবেন। যতটুকু জানি বিদেশি বিভিন্ন কোম্পানি আলোচনায় রয়েছে। শুরুতে বিদেশি কোম্পানি দিয়ে সম্ভব না হলে বন্দরের নিজস্ব তত্ত্বাবধানে অপারেশনাল কাজ শুরু হবে। পরে বিদেশি কোম্পানি দিয়ে অপারেশনাল কাজ করানো হতে পারে।
তবে পতেঙ্গা টার্মিনাল চালুর বিষয়ে আলোচনা চললে আগামীর বন্দর খ্যাত বে-টার্মিনালের নেই তেমন কোনো অগ্রগতি। প্রধানমন্ত্রীর অগ্রাধিকারভিত্তিক এই মেগা প্রকল্পের উদ্বোধনের পর পেরিয়ে গেছে তিন বছর। শুরুতে কিছুটা জটিলতা থাকলে সরকারের ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের হস্তক্ষেপে সেটি কাটিয়ে উঠার চেষ্টা করা হচ্ছিল। তারপরও এই প্রকল্পের দৃশ্যমান তেমন কোনো অগ্রগতি দেখা যাচ্ছে না।
জানা গেছে, বন্দরের সক্ষমতা বাড়াতে ২০১৭ সালে নগরের পতেঙ্গা ও হালিশহর সমুদ্র উপকূলভাগে বিস্তীর্ণ ভূমি এবং সাগরঘেঁষে ‘বে-টার্মিনাল’ নির্মাণের একটি প্রকল্প গ্রহণ করে। ২০১৮ সালের ১ নভেম্বর প্রকল্পটির উদ্বোধন করেছিলেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা।
নির্মাণ সংশ্লিষ্টরা জানান, বে-টার্মিনাল হলে প্রায় ১২ মিটার ড্রাফট (পানির ভেতরে থাকা জাহাজের অংশ) এবং পাঁচ হাজার টিইইউস (২০ ফুট দৈর্ঘ্যের) ধারণ ক্ষমতার জাহাজ এখানে ভেড়ানো যাবে। যেখানে বর্তমানে চট্টগ্রাম বন্দর জেটি-বার্থে ভিড়তে পারছে সর্বোচ্চ ৯ দশমিক ৫ মিটার ড্রাফটের এবং প্রায় দুই হাজার টিইইউস ধারণ ক্ষমতার জাহাজ।
এছাড়াও বে-টার্মিনালে একইসঙ্গে ভিড়তে পারবে ৩৫ থেকে ৫০টি জাহাজ। জোয়ার-ভাটার ওপর নির্ভরশীল থেকে চট্টগ্রাম বন্দর পরিচালনা করতে হলেও বে-টার্মিনালে এ জটিলতা থাকবে না। ফলে চট্টগ্রাম বন্দরের জট অনেকাংশে কমে যাবে। খরচ কমে গতি আসবে আমদানি-রফতানি বাণিজ্যে। বে-টার্মিনাল চালু হলে দেশের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি বহুগুণ বাড়বে।
বে-টার্মিনালের অগ্রগতির বিষয়ে জানতে চাইলে বন্দর সচিব ওমর ফারুক জাগো নিউজকে বলেন, ভূমি অধিগ্রহণের কিছু কাজ বাকি আছে। এছাড়া এই প্রকল্পের সার্বিক বিষয়ে ফিজিবিলিটি স্টাডি করা হচ্ছে। দৃশ্যমান অগ্রগতি না থাকলে অভ্যন্তরীণ কাজ চলমান রয়েছে।
চট্টগ্রাম বন্দর ব্যবহারকারী ফোরাম ও চট্টগ্রাম চেম্বারের প্রেসিডেন্ট মাহবুব আলম জাগো নিউজকে বলেন, দিন দিন চট্টগ্রাম বন্দরে আমদানি-রপ্তানি বাড়ছে। বাড়তি চাপ সামলাতে আগেভাগে উদ্যোগ নিতে হবে বন্দর কর্তৃপক্ষকে। দেশের স্বার্থে এবং ব্যবসায়ীদের স্বার্থে বন্দরের সক্ষমতা বাড়াতে হবে। এক্ষেত্রে পতেঙ্গা টার্মিনাল নির্মাণ শেষের দিকে- এটি সুখবর। বে-টার্মিনালও দ্রুত চালুর বিষয়ে সরকারকে উদ্যোগ নিতে হবে। যতদ্রুত সম্ভব, ততদ্রুত করতে হবে।
চট্টগ্রাম বন্দর দিয়ে দেশের ৯৪ ভাগ আমদানি-রফতানি হয়ে থাকে। আবার মূল রপ্তানি বাণিজ্যের ৯৮ শতাংশ এ বন্দর দিয়ে হয়। প্রতি বছর জাহাজ, কার্গো ও কনটেইনার হ্যান্ডলিং বাড়তে থাকায় তা সামাল দেওয়া চট্টগ্রাম বন্দরের জন্য একটি চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়াচ্ছে। এজন্য সক্ষমতা বাড়াতে নতুন প্রকল্প হাতে নিতে হচ্ছে বন্দর কর্তৃপক্ষকে।
মিজানুর রহমান/এমআরএম