খুঁড়িয়ে চলছে মাতৃভাষা ইনস্টিটিউট, পরিচিতি নেই ভাষা জাদুঘরের
একুশে ফেব্রুয়ারিকে আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস হিসেবে ১৯৯৯ সালে স্বীকৃতি দেয় ইউনেস্কো। ২০১০ সালে জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদে সর্বসম্মতিক্রমে একুশে ফেব্রুয়ারিকে আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস হিসেবে পালনের সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়। একই বছরের ২১শে ফেব্রুয়ারি রাজধানী ঢাকার বুকে যাত্রা শুরু করে আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা ইনস্টিটিউট। প্রতিষ্ঠার এক যুগ পেরুলেও মাতৃভাষা নিয়ে গবেষণায় বিশেষ কোনো অর্জন নেই প্রতিষ্ঠানটির। কর্মকর্তারা বলছেন সংকট রয়েছে জনবলের। ইনস্টিটিউটের ভিতরে একটি সমৃদ্ধ জাদুঘর থাকলেও প্রচার-প্রচারণার অভাবে পরিচিতি নেই সাধারণ মানুষের কাছে।
আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা ইনস্টিটিউট (আইএমএলআই) আইন অনুযায়ী, প্রতিষ্ঠানটির জন্য ২৩টি সুনির্দিষ্ট কাজের কথা বলা আছে। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো- দেশে ও দেশের বাইরে বাংলাভাষা প্রচার ও প্রসারে কার্যক্রম গ্রহণ, পৃথিবীর বিভিন্ন দেশ ও ক্ষুদ্র জাতিগুলোর ভাষা সংগ্রহ, সংরক্ষণ ও গবেষণা-প্রশিক্ষণের উদ্যোগ নেওয়া, বাংলাসহ অন্যান্য ভাষা আন্দোলনের বিষয়ে গবেষণা ও ইউনেস্কোর সদস্য দেশগুলোতে প্রচার, বাংলাভাষার আন্তর্জাতিকীকরণে কার্যক্রম গ্রহণ, বিভিন্ন ভাষার উপাদান ডাটাবেজে সংরক্ষণ, অডিও ভিজ্যুয়াল পদ্ধতিতে বিলুপ্ত বা প্রায় বিলুপ্ত ভাষাগুলোকে দৃশ্যমান করা, বিভিন্ন ভাষার অভিধান প্রকাশ ও হালনাগাদকরণ, ভাষা ও বর্ণমালার আর্কাইভ নির্মাণ এবং পরিচালনা, সব ভাষার বিবর্তন বিষয়ক গবেষণা, ভাষাবিষয়ক আন্তর্জাতিক প্রতিষ্ঠান-সংস্থা ও সংশ্লিষ্টদের সঙ্গে যোগাযোগ রাখা এবং বিশ্বমানের লাইব্রেরি ও তাতে ভাষার ওপর লিখিত যাবতীয় বই, ব্যাকরণ রাখা।
তবে প্রতিষ্ঠানটির নির্ধারিত ২৩টি কাজের লক্ষ্যমাত্রার অধিকাংশই শুরু করা হয়নি। কয়েকটি আংশিক বাস্তবায়ন হয়েছে। পাশাপাশি বাংলাভাষার আন্তর্জাতিকীকরণে নানা উদ্যোগও নেওয়ার কথা। কিন্তু বিদেশে বাংলা ভাষার প্রসারে নেওয়া হয়নি তেমন কোনো পদক্ষেপ।
মাতৃভাষা ইনস্টিটিউটে সংরক্ষণ করা হয়েছে জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ভাষণ ও আলোকচিত্র
বাংলাসহ বিশ্বের বিভিন্ন ভাষা গবেষণা, সংরক্ষণ ও প্রচার-প্রসারের জন্য ইনস্টিটিউটের মধ্যেই গড়ে তোলা হয় একটি জাদুঘর। তবে এক যুগেও দর্শনার্থী টানতে পারেনি ভাষা জাদুঘর।
রোববার (২০ ফেব্রুয়ারি) সরেজমিনে দেখা যায়, রাজধানীর সেগুনবাগিচায় শিল্পকলা একাডেমির পাশে অবস্থিত মাতৃভাষা ইনস্টিটিউট পরিষ্কারে ব্যস্ত কয়েকজন পরিচ্ছন্নতাকর্মী। একুশে ফেব্রুয়ারি সামনে রেখে প্রধানমন্ত্রীর অনুষ্ঠান উপলক্ষে সাজসজ্জা করা হচ্ছে। তবে ভাষা জাদুঘর ছিল জনশূন্য। এখানে মাঝে মধ্যে কিছু শিক্ষার্থী পরিদর্শনে আসেন বলে জানান জাদুঘরের দায়িত্বরত একজন কর্মকর্তা।
ভাষা জাদুঘর ঘুরে দেখা যায়, এখানে ১০১টি দেশের ভাষার পরিচিতি, বাংলা ভাষা আন্দোলনের ইতিহাস ও আলোকচিত্র, বঙ্গবন্ধুর ৭ মার্চের ভাষণ ও আলোকচিত্র, ১৯৭১ সালের স্বাধীনতা যুদ্ধের নানান আলোকচিত্র, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ও ঢাকা মেডিকেল কলেজের শিক্ষার্থীদের ভাষা আন্দোলনের আলোকচিত্র, বাংলা ভাষার বিবর্তন, ভার্চুয়াল রিয়ালিটি ডিভাইস (ভিআর) এবং ভাষা ও স্বাধীনতার ওপর নানা ধরনের দালিলিক প্রমাণ রয়েছে।
জাদুঘরের উত্তর পাশের দেওয়ালে রয়েছে ভাষাশহীদদের ছবি। ভাষা আন্দোলনের বেশ কিছু আলোকচিত্র। তৎকালীন পত্রপত্রিকার রিপোর্ট। বাংলাদেশের শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের কাছে কানাডায় অবস্থিত বহুজাতিক ভাষাপ্রেমিক গোষ্ঠীর পক্ষ থেকে রফিকুল ইসলামের লেখা চিঠি। এর পরিপ্রেক্ষিতেই সরকার যে উদ্যোগ নিয়েছিল, তাতে অমর একুশে ফেব্রুয়ারি ইউনেস্কোর আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবসের স্বীকৃতি পায়। আছে ইউনেস্কোর আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস ঘোষণার সনদের ছবিও।
ইনস্টিটিউটের ভাষা জাদুঘরে রয়েছে ১০১টি দেশের ভাষার পরিচিতি
আরও আছে ১৯৭১ সালের ২৬ মার্চ রাতে জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বাংলাদেশের স্বাধীনতার যে ঘোষণা দিয়েছিলেন, তা পরদিন ছাপা হয়েছিল বিভিন্ন বিদেশি পত্রিকায়। এর মধ্যে অন্যতম ছিল ভারতের অমৃতবাজার পত্রিকা। ওই ঘোষণার বিস্তারিত বিবরণসংবলিত পত্রিকাটির ১৯৭১ সালের ২৭ মার্চ সংখ্যাটিও রয়েছে। আরও আছে বঙ্গবন্ধুর ঢাকার রেসকোর্স ময়দানে ৭ মার্চের ঐতিহাসিক ভাষণের ছবি।
জাদুঘরে দর্শনার্থী টানা প্রসঙ্গে আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা ইনস্টিটিউটের মহাপরিচালক মো. বেলায়েত হোসেন তালুকদার জাগো নিউজকে বলেন, আমাদের এখানে নিয়মিত দর্শনার্থী না থাকলেও দেশের বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের শিক্ষক-শিক্ষার্থীরা আসেন। এখান থেকে তারা প্রয়োজনীয় তথ্য সংগ্রহ করেন। অনেক গবেষক তার গবেষণা কাজের জন্য নিয়মিত আসছেন। ভাষা জাদুঘরে দর্শনার্থীর সংখ্যা বাড়াতে প্রচার-প্রচারণা শুরুর চিন্তা-ভাবনা করা হচ্ছে।
দ্রুত সময়ের মধ্যে এ বিষয়ে পদক্ষেপ নেওয়া হবে বলেও জানান তিনি।
প্রতিষ্ঠার পর থেকে এ পর্যন্ত ভাষা বিষয়ে একাধিক গবেষণা-জার্নালসহ বিভিন্ন প্রকাশনা, সেমিনার ও কর্মশালা আয়োজনের পাশাপাশি প্রতি বছর আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস পালন করে প্রতিষ্ঠানটি। এর বাইরে প্রাথমিক ও মাধ্যমিক পর্যায়ের শিক্ষকদের বাংলা প্রবিধানের ওপর প্রশিক্ষণ দেয়।
ইনস্টিটিউটের ভাষা জাদুঘরে রয়েছে ১০১টি দেশের ভাষার পরিচিতি
আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা ইনস্টিটিউটের পরিচালক (ভাষা, গবেষণা ও প্রশিক্ষণ) অধ্যাপক মো. শাফীউল মুজ নবীন জাগো নিউজকে বলেন, ভাষা দিবস আরও তাৎপর্য করে তুলতে আমরা আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা পদক চালু করেছি। প্রতিবছর একবার এই পদক দুই ভাগে দেওয়া হয়। এর একটি আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা জাতীয় পদক, অপরটি আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা আন্তর্জাতিক পদক। প্রত্যেক ভাগে দুজন করে মোট চারজনকে এ পদক দেওয়া হয়।
ইনস্টিটিউটের কর্মকাণ্ড প্রসঙ্গে তিনি বলেন, দেশের পাঁচটি ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠীর ভাষায় বঙ্গবন্ধুর ভাষণ অনুবাদ করা হয়েছে। ১৯৭১ সালের ৭ মার্চের ভাষণ ও ১৯৭২ সালে বঙ্গবন্ধুর স্বদেশ প্রত্যাবর্তনের দিনে দেওয়া ভাষণ অনুবাদ করা হয়েছে। এসব ভাষণ অনুবাদ করা হয়েছে চাকমা, মারমা, সাদ্রী, ত্রিপুরা ও গারো ভাষায়। ব্রেইল ও শ্রবণপ্রতিবন্ধীদের জন্যও ভাষণের ওপর প্রকাশিত হয়েছে দুটি করে বই।
এছাড়া ভাষণ দুটি আইপিএতে (ইন্টারন্যাশনাল ফোনেটিক অ্যালফাবেট) তৈরি করা হয়েছে। নিয়মিত গবেষণা জার্নালের বাইরে আরও দুটি বিশেষ প্রকাশনা করা হয়। এগুলো হলো- মাতৃভাষা বঙ্গবন্ধু সংখ্যা ও বঙ্গবন্ধু মাদার ল্যাঙ্গুয়েজ ইস্যু। ত্রৈমাসিক নিউজ লেটার প্রকাশ করা হয় দু’টি ভাষায়। প্রাথমিক ও মাধ্যমিক স্তরের শিক্ষকদের বাংলা ভাষা উচ্চারণ, বানান ও বাক্য গঠনের ওপরও প্রশিক্ষণ কর্মসূচি আছে বলেও জানান শাফীউল মুজ নবীন।
ইনস্টিটিউটের ভিতরে একটি সমৃদ্ধ জাদুঘর থাকলেও প্রচার-প্রচারণার অভাবে পরিচিতি নেই সাধারণ মানুষের কাছে
খোঁজ নিয়ে জানা যায়, আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা ইনস্টিটিউটে গবেষণা নীতিমালা তৈরি করা হয়েছে। অর্থ মন্ত্রণালয়ের অনুমোদনের পর এটি জারি করা হলে গবেষণার লক্ষ্যে ফেলো নিযুক্ত করা হবে। এছাড়া এমফিল ও পিএইচডি ডিগ্রি দেওয়ার পরিকল্পনাও আছে। তবে প্রতিষ্ঠানটি হয়ে গেছে অনেকটা ফেব্রুয়ারিকেন্দ্রিক। প্রতিষ্ঠানটির জনবল সংকটও তীব্র। ফলে প্রেষণে নিয়োগ পাওয়া কর্মকর্তারাই ভরসা।
এর কার্যক্রম ও অর্জন সম্পর্কে জানতে চাইলে প্রতিষ্ঠানটির মহাপরিচালক মো. বেলায়েত হোসেন তালুকদার জাগো নিউজকে বলেন, আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা ইনস্টিটিউট অন্যসব প্রতিষ্ঠানের মতো নয়। ভাষার মতো একটি কঠিন বিষয়ের গবেষণা আর অন্য বিষয়ের গবেষণা সমান নয়। তাই সমীক্ষা হলেও তা চূড়ান্ত করে গ্রন্থ প্রকাশে বিলম্ব হয়। আমাদের জনবল সংকট রয়েছে। সব পদে এখনো নিয়োগ করা সম্ভব হয়নি।
‘আসলে এ প্রতিষ্ঠানের জন্য দরকার বিশেষায়িত জনবল। বাংলাদেশের কোনো বিশ্ববিদ্যালয় তা তৈরি করে না। তাই এ ধরনের পদে নিয়োগ দেওয়া যায়নি। তবে নিয়োগ প্রক্রিয়াধীন।’
এমএইচএম/কেএসআর/এএ/এএসএম