শরীয়তপুরে ছাত্র ভর্তিতে অতিরিক্ত টাকা আদায়
শরীয়তপুর জেলার একমাত্র সরকারি বয়েজ স্কুল পালং তুলাসার গুরুদাস সরকারি উচ্চ বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক মুহম্মদ শহীদুল্লাহর বিরুদ্ধে বিভিন্ন শ্রেণিতে ছাত্রদের ভর্তি বাবদ অতিরিক্ত টাকা আদায়ের অভিযোগ উঠেছে। তিনি গত বছরের ন্যায় এ বছরও ছাত্র ভর্তি বাবদ অতিরিক্ত টাকা নিচ্ছেন।
অফিস সূত্রে জানা যায়, ২০১৬ সালে পালং তুলাসার গুরুদাস সরকারি উচ্চ বিদ্যালয়ে বিভিন্ন শ্রেণিতে ১ হাজার ৩৯ জন ছাত্র ভর্তি হয়েছে। উক্ত ছাত্র ভর্তি বাবদ প্রতি ছাত্রের কাছ থেকে এক হাজার চারশ` পঞ্চাশ টাকা করে নিচ্ছেন। এর মধ্যে ত্রিশ টাকা জমা হচ্ছে সরকারি কোষাগারে। বাকি এক হাজার চারশ` বিশ টাকা জমা হচ্ছে বিদ্যালয়ের কোষাগারে। সেখানে বিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ ১৭টি খাত দেখিয়ে উক্ত টাকা নিচ্ছেন।
এর মধ্যে খেলাধুলা বাবদ ১শ` টাকা, দরিদ্র তহবিল বাবদ ২৫ টাকা, বিদ্যালয় সাময়িকী বাবদ ৬০ টাকা, স্কাউট বাবদ ২০ টাকা, পরীক্ষা ও মুদ্রণ বাবদ একশ` ৭৫ টাকা, ছাত্র মিলনায়তন, ম্যাগাজিন, পরিচয়পত্র বাবদ ২শ` ৩০ টাকা, মসজিদ বাবদ ৫০ টাকা, মিলাদ বাবদ ৭৫ টাকা, পূজা বাবদ ১২৫ টাকা, গবেষণা বাবদ ৪০ টাকা, কম্পিউটার বাবদ ৬০ টাকা, সংস্কৃতি বাবদ ৭৫ টাকা, কৃষি বাবদ ৩০ টাকা, রেড ক্রিসেন্ট বাবদ ১৫ টাকা, লাইব্রেরি বাবদ ৪০ টাকা, বিবিধ বাবদ ২শ` টাকা ধার্য করে উত্তোলন করছেন।
আর তিন মাসের টিফিন বাবদ ২শ`২৫ টাকা নেয়া হচ্ছে। এতে করে এ বছর চৌদ্দ লক্ষ পঁচাত্তর হাজার তিনশ` আশি টাকা অত্র বিদ্যালয়ের কোষাগারে জমা পড়েছে। আর সরকারি কোষাগারে জমা পড়েছে তিন মাসে মাত্র একত্রিশ হাজার একশ` সত্তর টাকা।
সরেজমিনে দেখা যায়, পালং তুলাসার গুরুদাস সরকারি উচ্চ বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক মুহম্মদ শহীদুল্লাহ যে ১৭টি খাত দেখিয়ে ছাত্রদের ভর্তি করছেন, তাদের মধ্যে খেলাধুলা, পরীক্ষা ও মুদ্রণ এবং টিফিন ছাড়া সকল খাতগুলোই অকার্যকর রয়েছে। বিগত পাঁচ বছরের মধ্যে দরিদ্র ছাত্রদের শিক্ষা দানে সহযোগিতা করা, বিদ্যালয় সাময়িকী প্রকাশ, স্কাউটের প্রসার, ছাত্র মিলনায়তন, ম্যাগাজিন, পরিচয়পত্র প্রদান, মসজিদের উন্নয়ন, বাৎসরিক মিলাদ মাহফিল, ছাত্রদের গবেষণা, কম্পিউটারের প্রশিক্ষণ, সংস্কৃতির বিকাশ, কৃষি উন্নয়ন, রেড ক্রিসেন্ট, লাইব্রেরিসহ বিবিধ খাতে যে টাকাগুলো উত্তোলন করা হচ্ছে তা বিদ্যালয় তথা ছাত্রদেরও কোনো কাজে আসছে না। কারণ তিনি উক্ত টাকা বিদ্যালয় তথা ছাত্রদের মান উন্নয়নের ক্ষেত্রে ব্যয় না করে কোষাগারে জমা রেখেছেন।
বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক আরেকটি প্রতারণার আশ্রয় নিয়েছেন। বিদ্যালয় সাময়িকী খাতে ৬০ টাকা এবং ম্যাগাজিন খাদে ২শ` ৩০ টাকা করে নিয়েছেন অর্থাৎ একটি খাতকে দু`বার দেখিয়ে টাকা নিয়েছেন যা প্রতারণার শামিল। শুধু তাই নয়, টিফিন বাবদ যে টাকা উত্তোলন করা হয়, তা শুধু ছাত্রদের নাস্তার জন্য নেয়া হয়। এ টাকার মালিক একমাত্র ছাত্ররা। ছাত্রদের উন্নত মানের টিফিন না দিয়ে উক্ত টাকা ব্যাংকে জমা রাখা হয়েছে। যা বিদ্যালয়ের হিসাব মতে ১২ লক্ষ টাকার উপরে।
এ ব্যাপারে নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক শতাধিক ছাত্রের অভিভাবক প্রশ্ন রেখেছেন, একটি সরকারি বিদ্যালয়ে ছাত্র ভর্তির ক্ষেত্রে এতো টাকা নিচ্ছে কেন? বিগত তিন বছরে এই বিদ্যালয় থেকে কোনো ম্যাগাজিন বের করতে দেখিনি।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক অষ্টম শ্রেণির ছাত্র বলেন, আমাদের বিদ্যালয়ে বিগত দুই বছর যাবৎ কোনো মিলাদ হয় না। অথচ আমাদের কাছ থেকে মিলাদের কথা বলে ৭৫ টাকা করে নেয়া হয়েছে। একই শ্রেণির আরেক ছাত্র বলেন, আমাদের বিদ্যালয়ে কম্পিউটার শেখানোর মতো কোনো শিক্ষক নেই অথচ, প্রতি বছর আমাদের কাছ থেকে ৬০ টাকা করে নিচ্ছে।
নতুন ভর্তিকৃত ষষ্ঠ শ্রেণির ছাত্র বলেন, আমাদের গবেষণা করার মতো কোনো পাঠ্যপুস্তক নেই। তারপরও গবেষণার জন্য আমাদের কাছ থেকে ৪০ টাকা করে নিয়েছেন।
নবম শ্রেণির ছাত্র বলেন, আমাদের বিদ্যালয়ে কোনো সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান হয় না। প্রতি বছরই আমাদের কাছ থেকে ৭৫ টাকা করে নেয়া হচ্ছে। কিন্তু অনুষ্ঠানের কোনো খবর নেই। স্যাররা মনে হয় টাকাগুলো খেয়ে ফেলে।
একই শ্রেণির আরেক ছাত্র বলেন, আমাদের বিদ্যালয়ে কোনো খেলাধুলা হয় না। আমরা যারা খেলাধুলা করছি, তা আমাদের ব্যক্তিগত উদ্যোগে। শ্রেণি শিক্ষক খেলাধুলার জন্য আমাদের কাছ থেকে ১শ` টাকা করে নিয়েছে।
অষ্টম শ্রেণির আরেক ছাত্র বলেন, আমাদের বিদ্যালয়ে কৃষি কাজ করার মতো কোনো জায়গা নেই। সেক্ষেত্রে কৃষির কথা আসে কেন? বিদ্যালয়ে একটা লাইব্রেরি আছে শুনেছি। কিন্তু সেটা কোন রুম, তা জানি না। অথচ কৃষি এবং লাইব্রেরি খাত দেখিয়ে ৭০ টাকা নিচ্ছে। এতোগুলো খাতে টাকা নেয়ার পরও আবার বিবিধ খাদ দেখিয়ে প্রতিটি ছাত্রের কাছ থেকে ২শ` টাকা করে নেয়া হয়েছে, যা অমানবিক।
এ ব্যাপারে অত্র বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক মুহম্মদ শহীদুল্লাহর সঙ্গে আলাপকালে তিনি জাগো নিউজকে বলেন, ছাত্রদের ভর্তির ব্যাপারে যে টাকা নেয়া হচ্ছে তা অত্যন্ত সামান্য। শিক্ষা মন্ত্রণালয় আমাদেরকে সর্বোচ্চ দুই হাজার টাকা নিতে বলেছেন। সেখানে আমরাতো অনেক কম নিচ্ছি। প্রধান শিক্ষক ভর্তি সংক্রান্ত ব্যাপারে মন্ত্রণালয়ের বরাদ দিলেও তার স্বপক্ষে কোনো কাগজ-পত্র দেখাতে পারেননি।
এ ব্যাপারে শরীয়তপুর জেলা প্রশাসক রাম চন্দ্র দাস জাগো নিউজকে বলেন, পালং তুলাসার গুরুদাস সরকারি উচ্চ বিদ্যালয়ে ছাত্র ভর্তি হওয়ার ব্যাপারে অতিরিক্ত টাকা নেয়ার বিষয়টি আমি শুনেছি। আমি প্রধান শিক্ষক শহীদুল্লাহ সাহেবকে সমস্ত হিসেব নিয়ে আমার অফিসে আসতে বলেছি। তিনি আমার অফিসে আসবেন। হিসাব নিকাশ করার পর যদি কোনো ত্রুটি পাই, তাহলে সে মোতাবেক ব্যবস্থা নেয়া হবে।
মো. ছগির হোসেন/এমজেড/পিআর