শতায়ু হতে চান ৮০ বছরের দাদুভাই
ক্ষণ গণনার হিসাবে বয়স ৮০। কিন্তু মনেপ্রাণে আজও তিনি ১৮ বছরের এক তরুণ। এদেশে বয়স যেখানে পঞ্চাশ পেরোলেই মনোবল হারিয়ে অধিকাংশ মানুষ নিজেকে বৃদ্ধ ভেবে নিজেকে গুটিয়ে ফেলেন! সেখানে তিনি দেশে একটি অন্যতম সর্বোচ্চ সার্কুলেশনের জাতীয় দৈনিকের ফিচার এডিটর হিসেবে দিব্যি চাকরি করে চলেছেন। তার হাতের ছোঁয়ায় কাঁচা হাতের লেখা প্রতিবেদনে ভিন্ন মাত্রা যোগ হয়।
অনেক সময় জোত্যিষের মতো রিপোর্টারকে ডেকে বলে দেন যাও তোমার এ রিপোর্টটি পুরস্কার পাবে এবং সেটি নিশ্চিতভাবে পুরস্কারও পেয়েও যায়। ৮০ বছর বয়সেও তার তেমন কোন রোগবালাই নেই। তাই খাবারদাবারে বাছবিচার নেই, সব কিছুই খেতে পারেন।
তিনি আর কেউ নন, সমকালীন বাংলা ছড়া সাহিত্যের জীবন্ত কিংবদন্তি প্রখ্যাত শিশুসাহিত্যিক, শিশুসংগঠক ও প্রবীণ সাংবাদিক রফিকুল হক দাদুভাই আর মাত্র কয়েক ঘণ্টা পর যখন ঘড়ির কাঁটা ১২টা স্পর্শ করবে তখন তিনি ৮০ বছরে পদার্পণ করবেন। অগ্রিম শুভ জন্মদিন দাদু ভাই। জাতীয় শিশু-কিশোর সংগঠন চাঁদের হাটের প্রতিষ্ঠাতা হিসেবে তার দাদুভাই নামকরণ। ছয় দশক ধরে ছোটদের এবং বড়দের জন্য তিনি লিখে চলেছেন।
৮০তম জন্মবার্ষিকীর প্রাক্কালে বৃহস্পতিবার সন্ধ্যায় জাগো নিউজের সঙ্গে আলাপকালে তিনি বলেন, তিনি নিজেকে শিশুদের বন্ধু পরিচয় দিতে ভালবাসেন। শিশুরাই তার প্রাণশক্তি। তিনি মনের মধ্যে কখনও গ্লানি পোষণ করেন না। সব সময় খোলা মনে হাসিখুশি থাকতে ভালবাসেন।
যখন যেই অবস্থায় থাকেন না কেন দুঃখ তাকে স্পর্শ করতে পারেনা। এ জীবনে অসংখ্য মানুষের ভালবাসা পেয়েছেন বিশেষ করে শিশুদের ভালবাসা তার জীবনের বড় পাওয়া।
কত বছর বেঁচে থাকতে চান এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি হেসে বলেন, মানুষ মরণশীল তাই তাকেও একদিন পৃথিবীর মায়া ছেড়ে চলে যেতে হবে কিন্তু তাই বলে নিজেকে বৃদ্ধ ভেবে হাল ছাড়তে রাজি নন। তিনি ১০০ বছর বেঁচে থাকতে চান বলে জানান।
জীবনে কোনো অতৃপ্তি আছে কিনা এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, সৃজনশীল কাজের সাথে যারা জড়িত তারা সহজে তৃপ্ত হননা। এ জীবনে অনেক স্বীকৃতি ও ভালবাসা পেলেও এখনও মনে হয় জীবনের শ্রেষ্ঠ কাজটি তার করা হয়ে উঠেনি।
৮০ বছর বয়সে দিনলিপি সম্পর্কে জানতে চাইলে তিনি বলেন, কর্মের মাঝেই তার দিন কেটে যায়। সকালে ঘুম থেকে উঠে নাস্তা খেয়ে দৈনিক যুগান্তর অফিসের গাড়ির অপেক্ষা থাকেন। অফিসেই দিনভর পত্রিকার কাজ ও সহকর্মীদের সাথে হাসিঠাট্টায় দিন কাটে তার। ফিরতে ফিরতে সন্ধ্যা পেরিয়ে যায়। রাতে টিভি দেখে ও ব্যক্তিগত কিছু কাজ করে ১১টার মধ্যেই ঘুমিয়ে পড়েন।
এ প্রতিবেদকের সঙ্গে আলাপকালে তিনি জানান, ৮০তম জন্মদিনে তাকে রাষ্ট্রপতিসহ একাধিক মন্ত্রী তাকে লিখিতভাবে আগাম শুভেচ্ছা জানিয়েছেন আলাপের এক পর্যায়ে তিনি মহিলা বিষয়ক প্রতিমন্ত্রী মেহের আফরোজ চুমকির একটি বক্তব্যের সূত্র ধরে বলেন, এক সময় হাবিবুর রহমান ভুইয়া (ভাইয়া হিসেবে সুপরিচিত) খেলাঘরের হাত ধরে তিনি, সুকুমার বড়ুয়াসহ শিশুদের জন্য ছড়া, গল্প ইত্যাদি লিখেছেন।
পরবর্তীতে রোকনউজ্জামান দাদা ভাই ও তার মৃত্যুর পর তিনি হাল ধরেছেন। ভবিষ্যতে তিনি মারা গেলে শিশুদের জন্য লেখালেখির জন্য কে বা কারা থাকবেন তা নিয়ে ভাবেন।
এক নজরে দাদু ভাই :
রফিকুল হকের জন্ম ৮ জানুয়ারি ১৯৩৭। পিতা মরহুম ইয়াছিন উদ্দিন আহম্মদ, মাতা মরহুমা রহিমা খাতুন। পৈত্রিক নিবাস রংপুর শহরের কামালকাচনায়। আদি নিবাস ভরতের পশ্চিমবঙ্গের কুচবিহার শহরে। ব্যক্তিগত জীবনে স্ত্রী মুক্তিযোদ্ধা হামিদা হকের মৃত্যুর পর তিনি আবার বিয়ে বন্ধনে আবদ্ধ হন।
তার দুই ছেলে ও এক মেয়ের মধ্যে ছোট ছেলে জ্যোতি হক শিক্ষার্থী অবস্থায় এক দুর্ঘটনায় নিহত হন। আমাদের মহান মুক্তিযুদ্ধ ও বাঙালি জাতীয়তাবাদের চেতনায় উজ্জীবিত এ কলমসৈনিক স্বাধীকার আন্দোলন ও স্বাধীনতা সংগ্রামের প্রতিটি ধাপে সক্রিয় ও তাৎপর্যপূর্ণ অবদান রাখেন তিনি।
সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ বাঙালি, জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে নিয়ে বাংলাদেশে প্রথম ছাড়া লেখার কৃতিত্বের অধিকারী তিনি। রফিকুল হক দাদুভাই একজন স্বনামধন্য গীতিকার ও নাট্যকার। টেলিভিশন ও বেতার মাধ্যমে তার লেখা অসংখ্য বড়দের ও ছোটদের নাটক এবং শিশুতোষ গান দর্শক-শ্রোতাদের মুগ্ধ করেছে।
মরমী সঙ্গীত শিল্পী আবদুল আলীমের কণ্ঠে তার লেখা গান ‘নাইয়ারে নায়ের বাদাম তুইলা, কোন দূরে যাও চইলা’ আজও গ্রামবাংলার সাধারণ মানুষের প্রিয় গান। দাদুভাই দীর্ঘ পাঁচ দশক ধরে সাংবাদিকতা পেশায় নিয়োজিত আছেন। অধুনালুপ্ত দৈনিক ‘পূর্বদেশ’র ছোটদের পাতা ‘চাঁদের হাট’-এর সম্পাদক দাদুভাই এ সময়ের অনেক খ্যাতিমান লেখক, সাংবাদিক, শিল্পী ও সংস্কৃতিকর্মীর প্রতিষ্ঠার ভিত তৈরি করেছেন। উপমহাদেশে শিশু-কিশোরদের প্রথম সংবাদপত্র ‘কিশোর বাংলা’ তার সম্পাদনায় ঢাকা থেকে দীর্ঘদিন প্রকাশিত হয়।
তিনি বিভিন্ন জাতীয় দৈনিকের সাংবাদিক হিসেবে গুরুত্বপূর্ণ পদে কাজ করেছেন। বর্তমানে তিনি দৈনিক যুগান্তরের ফিচার সম্পাদক। বাংলা শিশুসাহিত্যে গুরুত্বপূর্ণ অবদানের জন্য রফিকুল হক দেশ ও বিদেশে অসংখ্য পুরস্কার ও সম্মাননা লাভ করেছেন। শিশুসাহিত্যে সামগ্রিক অবদানের জন্য ২০০৯ সালে তিনি বাংলা একাডেমি পুরস্কার ও ফেলোশিপ লাভ করেন।
গত বছর তাকে বাংলাদেশ শিশু একাডেমি পুরস্কারে ভূষিত করা হয়। শুক্রবার রাজধানী ঢাকাসহ সারাদেশে চাঁদের হাটের বিভিন্ন শাখা, সাহিত্যানুরাগী ও গুণগ্রাহীরা বিভিন্ন কর্মসূচির মাধ্যমে জাকজমকভাবে দাদুভাইয়ের ৮০তম জন্মদিনের উৎসব পালন করছে।
ঢাকায় বাংলা একাডেমির আব্দুল করিম সাহিত্যবিশারদ মিলনায়তনে সকাল ১০টা থেকে দিনব্যাপী তিন পর্বে আনন্দ উৎসবের আয়োজন করা হয়েছে।
এসব পর্বে যথাক্রমে তথ্যমন্ত্রী হাসানুল হক ইনু, মহিলা ও শিশু বিষয়ক প্রতিমন্ত্রী মেহের আফরোজ চুমকি ও সংস্কৃতিমন্ত্রী আসাদুজ্জামান নূর প্রধান অতিথি হিসেবে উপস্থিত থাকবেন। উৎসবের উদ্বোধন করবেন অধ্যাপক আনিসুজ্জামান।
এমইউ/এসএইচএস/এমএস