অবৈধ করাতকলে উজাড় হচ্ছে সংরক্ষিত বনাঞ্চল
করাতকল স্থাপনে লাইসেন্স নিতে হয় বন বিভাগ থেকে। লাগে পরিবেশ অধিদপ্তরে ছাড়পত্র। মানতে হয় আরও নির্দিষ্ট কিছু বিধিমালা। চট্টগ্রামে এসবের কোনো তোয়াক্কা নেই। নিয়ম-নীতি না মেনে যত্রতত্র গড়ে উঠছে অবৈধ করাতকল। সংরক্ষিত বনাঞ্চলের আশপাশের এলাকা ঘিরে গড়ে ওঠা এসব করাতকলে হরহামেশা চেরাই করা হচ্ছে কাঠ। এতে উজাড় হচ্ছে বনাঞ্চল। ভারসাম্য নষ্ট হচ্ছে পরিবেশের।
স্থানীয়দের অভিযোগ, প্রশাসন ও বনবিভাগের কর্মকর্তাদের ‘মাসোহারা’ দিয়ে এসব করাতকল পরিচালনা করা হচ্ছে। তবে যত্রতত্র অবৈধ করাতকল স্থাপনের বিষয়টি স্বীকার করলেও মাসোহারা নেওয়ার বিষয়টি অস্বীকার করেছেন বন বিভাগের কর্মকর্তারা। এছাড়া শিগগির যৌথ অভিযান পরিচালনার কথা জানিয়েছেন তারা।
করাতকল বিধিমালা-২০১২ তে বলা আছে, কোনো সরকারি অফিস-আদালত, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, হাসপাতাল, স্বাস্থ্যকেন্দ্র, ধর্মীয় প্রতিষ্ঠান, বিনোদন পার্ক, উদ্যান ও জনস্বাস্থ্য বা পরিবেশের জন্য সমস্যার সৃষ্টি করে এমন স্থান থেকে কমপক্ষে ২০০ মিটার এবং সরকারি বনভূমির সীমানা থেকে কমপক্ষে ১০ কিলোমিটারের মধ্যে করাতকল স্থাপন করা যাবে না। এই নির্দেশনা মানা হচ্ছে না কোথাও।
সরেজমিনে চট্টগ্রামের হাটহাজারী উপজেলার ধলই, মির্জাপুর, ফরহাদাবাদ ইউনিয়ন ও পৌরসভা এলাকায় ঘুরে যত্রতত্র অবৈধ করাতকল স্থাপন করতে দেখা গেছে। পৌর সদরের রেলস্টেশন সংলগ্ন এলাকায় দুটি, করিয়ার দিঘীর পাড় এলাকায় একটি, চারিয়া বাজারের পূর্বে ঈদগাহের সামনে একটি, চারিয়া বাজারের দক্ষিণ পাশে একটি, চারিয়া মোছার দোকানের পাশে একটি, মগ্গেরহাট বাজারে দুটি, কালীবাড়ির উত্তর পাশে বালুরটাল এলাকায় একটি, এনায়েতপুর বাজারের উত্তর-পশ্চিমপাশে একটি, পূর্বপাশে একটি, এনায়েতপুর কণ্ডলীআর ঘাটায় একটি, ব্রিকফিল্ড রাস্তার মাথা এলাকায় দুটি, সোনাইকুল এলাকায় একটি, কাজির হাট বাজারের আগে একটি, বাজারের পূর্বপাশে একটি, মুহুরী ঘাটা এলাকায় একটি, নোয়াহাট বাজার রাস্তার পাশে দুটি, নাজিরহাট নতুন রাস্তার মাথা এলাকায় দুটি, নাজিরহাট ব্রিজের দক্ষিণ পাশে হালদার পাড় ইউসুফ চৌধুরী বাড়ির সড়কে একটি এবং নাজিরহাট পুরাতন বাজার এলাকায় দুটিসহ মোট ২৪টি করাতকল দেখা গেছে। এগুলোর মধ্যে হাতে গোনা দুয়েকটি ছাড়া কোনোটিরই নেই লাইসেন্স।
বনবিভাগের কর্মকর্তারা জানান, পুরো হাটহাজারী উপজেলায় মাত্র নয়টি করাতকলের অনুমোদন আছে। এছাড়া আরও ছয়টি করাতকল অনুমোদনের জন্য প্রস্তুত। অথচ পুরো উপজেলায় আছে ৫০টির বেশি করাতকল।
স্থানীয়দের অভিযোগ, ফটিকছড়ি, হাটহাজারী ও সীতাকুণ্ডের মাঝামাঝি সংরক্ষিত বনাঞ্চলের পাশে এসব অবৈধ করাতকল গড়ে ওঠায় সহজেই সেখান থেকে কাঠ এসব করাতকলে আসে। এরপর কাঠ চেরাই হয়। সেই কাঠ দিয়ে ফার্নিচারসহ অন্যান্য সামগ্রী তৈরি হয়ে বিভিন্ন এলাকায় পৌঁছে যায়।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক স্থানীয় এক বাসিন্দা বলেন, বেশিরভাগ সময় রাতে ট্রাকযোগে সংরক্ষিত বনাঞ্চল থেকে কাঠ আসে। অবৈধ হওয়ায় এসব করাতকলে হিসাব হয় না যে সংরক্ষিত বনাঞ্চল থেকে কী পরিমাণ কাঠ আসে। মাঝেমধ্যে উপজেলা প্রশাসন এসব কাঠ করাতকলে আসার সময় আটক করে। তবে বেশিরভাগ সময় কোনো ধরনের বাধা ছাড়াই বনাঞ্চল থেকে কাঠ এসে অবৈধ করাতকলে চেরাই হচ্ছে।
জানতে চাইলে হাটহাজারী এনায়েতপুর এলাকার ‘শাহজাহান স মিল’ নামে এক অনুমোদনহীন করাতকলের মালিক মোহাম্মদ আলী জাগো নিউজকে বলেন, সবাই যেভাবে পরিচালনা করছে, আমিও সেভাবে করছি। এখানে তো বেশিরভাগ করাতকলের লাইসেন্স নেই। তবে আমি অনুমোদন নেওয়ার জন্য ফাইল রেডি করছি। এখনো জমা দেইনি।
লাইসেন্স না থাকায় প্রশাসনের কোনো সমস্যা হচ্ছে কিনা জানতে চাইলে তিনি বলেন, আমার সঙ্গে প্রশাসনের যোগাযোগ ও সুসম্পর্ক আছে। তাই তেমন সমস্যা হয় না। তারপরও মাঝেমধ্যে জরিমানা করলে সেগুলো দিয়ে দেই।
জানতে চাইলে চট্টগ্রাম উত্তর বন বিভাগের হাটহাজারীর স্টেশন কর্মকর্তা ফজলুল কাদের জাগো নিউজকে বলেন, আমি কিছুদিন আগে যোগ দিয়েছি। আমার আওতাধীন এলাকায় বেশকিছু অবৈধ করাতকল আছে। এগুলোর তালিকা প্রস্তুত করা হয়েছে। এখন যাচাই-বাছাই চলছে। এই তালিকা জেলা প্রশাসক কার্যালয়ে উচ্ছেদের অনুমতির জন্য পাঠানো হবে। অনুমতি পাওয়ার পর পুলিশ, প্রশাসন ও বন বিভাগ যৌথ অভিযান পরিচালনা করবে।
মিজানুর রহমান/এমআরআর/এএ/জিকেএস