রূপালি সোনা


প্রকাশিত: ০৬:৪০ এএম, ০৬ জানুয়ারি ২০১৬

আমরা দিনের বেলায় বেশি ঘুমাই। দিনে ঘুমানোর প্রধান কারণ আমরা রাতকে বেশি ভালোবাসি। নিষিদ্ধ কালো রাতই আমাদের বাঁচিয়ে রাখে। প্রতিবছর আশ্বিন মাস এলেই আমাদের মাথার মধ্যে দুশ্চিন্তা বাসা বাঁধতে শুরু করে। অবশ্য মাথার মধ্যে দুশ্চিন্তা বাসা বাঁধতে শুরু করে না বলে আমাদের বলা উচিত এই আশ্বিন মাস আমাদের সারাবছরের মাথাব্যথার মাস। অন্য কিছু কিছু সময়ও যে আমাদের মাথাব্যথা থাকে না, একথা বলা ঠিক হবে না। থাকে, বছরের অন্য কোনো কোনো সময়েও আমাদের যথেষ্ট মাথাব্যথা থাকে।

সাধারণত এ সময় রাষ্ট্র আমাদের উপরে হুলিয়া জারি করে। আমরা  সেই হুলিয়া মানতে চাই না। যদিও রাষ্ট্রের এই হুলিয়া জারি পরোক্ষভাবে আমাদের যাপিত জীবনের উন্নয়নেরই অংশ বলে দাবি করা হলেও এতে আমাদের জীবনের টিকে থাকার সংগ্রামের নাভিশ্বাস আরো  বেড়ে যায়।

এখন যদিও বছরে একবার এই হুলিয়া জারি করা হয়, ভবিষ্যতে বছরে আরো বেশ কয়েকবার যে হবে না, আমরা জোর দিয়ে কেউ বলতে পারি না। শুনেছি, এই হুলিয়া আরো দীর্ঘ হবে। শুধু কি দীর্ঘ হবে? বছরের যেকোনো সময়, যেকোনো মাসেই হুলিয়া জারি হতে পারে।

আমরা লুকিয়ে লুকিয়ে গভীর রাতে আমাদের উপরে চাপানো রাষ্ট্রের হুলিয়া জারি ভাঙতে থাকি। মানি না। অবশ্য এসব কাজ আমরা আমাদের নিজেদের স্বার্থেই করি। রাষ্ট্রের চাপানো নিয়ম আমাদের অনেক বেশি নিরুপায় করে তোলে। নিয়ম ভাঙা ছাড়া আর কোনো উপায় দেখি না অথবা খুঁজে পাই না।

অবশ্য রাষ্ট্রের হুলিয়া মানতে শীর্ষমহল থেকে আমাদের জন্য বিকল্প উপায় বের করার চেষ্টা করে, কিন্তু চেষ্টা করলে কী হবে? রাষ্ট্রের নিচের সারিতে যারা থাকেন, তারা আমাদের নিয়ে ভাবেন না অথবা আমাদের নিয়ে অত বেশি ভাবতে চান না।

রাষ্ট্রের মধ্যম সারির মানুষগুলো হয়তো আমাদের নিয়ে এই চিন্তা করতে পারে যে, রাষ্ট্র ও সমাজের তলানি স্তরের এই সব মানুষদের ভেবে কী লাভ? আরে বাবা! আমরা তো কখনো আপনাদের কাছে গিয়ে বলতে যাইনি যে, ‘আমরা মানুষ। আমাদের নিয়ে একটু ভাবুন।’

মানুষ হিসেবে মানুষের যে অধিকার রাষ্ট্র দিয়েছে, আমরা সেই অধিকার রাষ্ট্রের কাছে কখনো চাইতে যাই না। তবে রাষ্ট্রযন্ত্রের মানুষের মুখগুলো এবং সমাজের উঁচু শ্রেণির মানুষগুলো আমাদেরকে কখনো মানুষ ভাবুক আর নাই বা ভাবুক তাতে আমাদের কোন দুঃখ নেই। আমাদেরকে তারা শুধু এই পৃথিবীতে জন্ম নেওয়া কোন নিম্ন শ্রেণির প্রাণী ভাবলেই হবে। আমরা এরচেয়ে বেশি কিছু তাদের কাছে চাই না। যদি সেটাও তারা না ভাবতে চায়, তাতেও আমাদের কোনো কিছু করার নেই। অবশ্য উপরের মানুষগুলো আমাদের যে মানুষ না ভেবে কিছু একটা ভাবে, এই ‘কিছু একটা’ ভাবাতেই আমরা খুব খুশি।

যে গল্প বলছিলাম, রাষ্ট্রের এই নিষিদ্ধকালে আমাদের জীবন যাপন একেবারেই মরণদশা হয়ে ওঠে।  সেই দশার আর্তি বলতে গেলে দম বন্ধ হয়ে আসে। আমরা তবুও মাঝে মাঝে রেগে আগুন হয়ে যাই। কিন্তু বুকের ভেতরে জ্বলে ওঠা সেই আগুন সহজেই নিভে যায়। আমরা আর কখনো সে দাউ দাউ করে জ্বলা আগুন জ্বালাতে পারি না। যা আমাদের চিরকালীন ব্যর্থতা। শুধু আমরা নই, আমাদের পূর্বপুরুষেরাও ব্যর্থ, আমাদের উত্তরপুরুষ সফল হবে কি হবে না, এখনই জোর দিয়ে বলতে পারি না।

একথা সত্য যে, আমাদের ভেতরে কারো কারো বুকের আগুন মাঝে মাঝে বিদ্রোহী হয়ে উঠতে চায়। আমার খুব আত্মবিশ্বাসের সঙ্গে বলতে পারি, সময় সুযোগ পেলে আমাদের বুকের ভেতরে দাউ দাউ করে জ্বলা সে আগুন যেকোনো সময় বিদ্রোহী হয়ে উঠবে। নিষিদ্ধকালে রাষ্ট্রের সকল স্তরের নিরাপত্তা সংস্থা আমাদের উপরে ঝাঁপিয়ে পড়ে নজরদারি শুরু করে। সে কী নজরদারি!

মনে হয় আমাদের উপরে নজরদারি না করলে তাদের চাকরিটিই থাকবে না। তাই তারা নজরদারি, খবরদারিতে আমাদের উপরে ঝাপিয়ে পড়ে। আমরা তাদের নাম শুনলেই ভয়ে, আতংকে গুটিয়ে যেতে থাকি। আমাদের কাজের নিষিদ্ধকালে জীবন যাপনের কোন কাজই করতে পারি না। কখনো কখনো আমরা মনে করি, আমাদের উচিত পালিয়ে যাওয়া, নয়তো ভয়ে সারারাতের সকল শ্রমের ফলাফলের বড় অংশ তাদের মাঝে বিলিয়ে দেওয়া।

বেশির ভাগ সময়ই আমাদের শ্রমের ফলাফল বিলিয়ে দিতে হয়। সেই বিলিয়ে দেওয়াও ঘটে চুপি চুপি, মানুষতো ভালো কাকপক্ষীও যাতে না জানে। ফলাফলের ভাগ বণ্টন অনেকটা সরকারি রিলিফ দেওয়ার মতো সিরিয়াল মাফিক শুরু করতে হয়। আমরা কী আর করবো। এই ভরা আশ্বিনে অথবা যেকোনো সময়েই আমাদের টিকে থাকার সংগ্রাম যেমন শুরু হয়, তেমনি ভাবে আমাদের ঘায়েল করারও প্রতিযোগিতা শুরু হয়। রাষ্ট্র কর্তৃক জারিকৃত এই প্রজননকালে আমাদের কাছে তারা ধারাবাহিক ভাবে আসতে থাকে।

অবশ্য আমাদের ভেতরই আমাদের শত্রু আছে। আমরাই একে অপরের ক্ষতির জন্য তাদেরকে সহযোগিতা করে থাকি। তাই নিজেদেরও যে কিছু দোষ নেই সেকথাও জোর দিয়ে বলতে পারছি না।

নিজেদের গোত্রের লোকদেরও দোষ আছে, তাদের হাসির আড়ালে ভেতরে ভেতরে একে অন্যেকে পুড়িয়ে ফেলার হিংসার দাবানল জ্বলতে থাকে। আমরা একে অন্যের মুখের হাসি বেশিক্ষণ দেখতে পারি না। আমরা লেগে থাকি, একে অন্যের পেছনে সময়ে অসময়ে লেগে থাকি। অন্যকে দিয়ে আমরা গোত্রের কাউকে ক্ষতি করার সুযোগ পেলে নিজেরাই নিজেদের ঘায়েল করি।

আমরা যখন রাতে কাজে নেমে পড়ি তখন আমাদের কাছে তারা এক এক করে আসতে থাকে। ওদের আসার সে কী ধারাবাহিকতা!

আমরা যখন পূর্ণিমার শরীর বেয়ে বেয়ে নেমে আসা সৌন্দর্যে স্নান করে পদ্মার ভরা বুকে চষে বেড়িয়ে রূপালি সোনা তুলি তখন ওরা আমাদের শ্রম চাষের ফলালের ভাগ নিতে আসে।

কখনো কখনো দলে দলে ওদের ধারাবাহিক আসার খবর আমাদের কানে আসলে আমরা কেউ কেউ নৌকা নিয়ে পালিয়ে যাই। সবসময় তো আর পালিয়ে পালিয়ে থাকা সম্ভব হয় না। আমরা কোনো না কোনো সময় ওদের হাতে ধরা খেয়েই যাই। ধরা খাওয়া ছাড়া আমাদের আর কোন পথ থাকে না। আমরা ওদের কাছে পালাতে ব্যর্থ হয়ে উঠি।

ব্যর্থ হওয়ার পেছনে অবশ্য অনেকগুলো যুক্তিযুক্ত কারণ আমি খুব সহজেই উপস্থাপন করতে পারি। কিন্তু এতোগুলো যুক্তি দেখালে আমরা আর আমরা থাকি না। আমরা কখনো কখনো হয়ে উঠি আমাদের প্রতিদ্বন্দ্বী।
 
যাই হোক। আমাদের কাছে সন্ধ্যার পর পরই ওরা দলে দলে আসতে থাকে। আমরাও মেনে নেই আমাদের উপরে তাদের ধারাবাহিক জুলুম নির্যাতন। না মেনে নিয়ে কোন উপায় নেই।

সন্ধ্যার পরে পদ্মার ভরা বুকে যখন জ্যোৎস্না ঝিলিক মেরে ওঠে তখন থেকেই আমাদের কাছে চেয়ারম্যানের খবর আসে। সে তার কিছু লোকজন আমাদের কাছে পাঠায়।

তাদের তো খুশি করতেই হয়। তাদের খুশি না করে, আমাদের কোনো উপায় থাকে না। তারা চেয়ারম্যানের লোক। চেয়ারম্যানের ইশারায় তারাই এই এলাকার সবকিছু নিয়ন্ত্রণ করে। তাদেরকে ভয়ে আমরা কখনো কোনো কিছু বলতে সাহস করি না। আমাদের উপরে তাদের চাহিদা মেটাতে আমরা সবসময় চেষ্টার কোন কমতি রাখি না।

শুধু কী তাই! এই চেয়ারম্যান আমাদের সংসদ সদস্যের খুব কাছের মানুষ। তাকে খুশি না করলে কী হয়! মাঝে মাঝে তো মাঝরাতে তিনি নিজেই আমাদের কোনো না কোনো ঘরে এসে হাজির হন।

চেয়ারম্যানের বউ, ছেলে-মেয়ে সব ঢাকায় থাকে। যখন তার গতরের ভেতরে রক্তের প্রবাহ শোল মাছের পোনার মত খলবল খলবল করে নাচুনি কুদুনি দিয়ে ওঠে, তখন তিনি আমাদের পাড়ায় এসে হাজির হন।

অবশ্য তার কাছে আমাদের এই পাড়ায় যতগুলো ঘর আছে, সব ঘরেরই লোকজনের মুখ মুখস্ত। যেসব ঘরে ছিনালি গতরের মেয়ে আছে, সেসব ঘরেই তিনি ঘণ্টা দুয়েক ফূর্তি করেন। আমরা অসহায়, আমাদের ঘরের ছিনালি গতরের মেয়েদেরকে দিয়ে সে তার গতরের আগুন নেভায়। আমরা প্রতিবাদ করার সাহস পাই না।

অবশ্য তিনি আমাদের মেয়েগুলোর উপরে নিজে কখনো চাষবাস করে ফসল ফলান না। জন্ম বিরতিকরণ পদ্ধতি ব্যবহারে তিনি আমাদের আইডল হতে পারেন। আমরা আসলে ভেতরে ভেতরে চেয়ারম্যান ও তার লোকজনদের খুব ভয় পাই। তাদেরকে খুশি করার পেছনে আমাদের আরো কিছু কারণ আছে।

এই মুহূর্তে বলতে হয়, যখন আমাদের গোত্রের ভেতরে কখনো কারো মেয়ে, ছেলে এবং বউকে নিয়ে ঝগড়া, বিবাদ অথবা ভাগিয়ে নিয়ে যাওয়ার কোন ঘটনা ঘটে, তখন আমরা চেয়ারম্যানের কাছেই প্রথমে নালিশ নিয়ে যাই। তখন তিনিই হয়ে ওঠেন আমাদের সর্বময় কর্তা।

এই তো সেদিনের ঘটনা। ঘটনাটির এক মাস পার হয়নি। আমাদের পাড়ার যতীনের ছোটছেলের বউ অঞ্জলিকে এক রাতে চুপি চুপি ঘরে এসে পাশের ঘরের সুবলের ছোটছেলে মুকুন্দ চেটেপুটে খেয়েছে।

ঘটনাটি প্রথমে কেউ জানতো না। একমাত্র সাক্ষী অঞ্জলির অসুস্থ শাশুড়ি। প্রথমে সে ঘটনাটি চেপে গেলেও দুইদিন পরে যখন তার ছেলে পদ্মার বুক থেকে বাড়ি ফিরে আসে, তখন সে অঞ্জলি ও মুকুন্দের ঘটনাটি প্রকাশ করে। মূলত তখন এই ঘটনা নিয়ে তুমুল হইচই পড়ে যায়। শুরু হয় ঝগড়া বিবাদ। শেষ পর্যন্ত ঘটনার সত্যতা নিয়েই প্রশ্ন ওঠে। অঞ্জলিতো কিছুতেই পরকীয়া স্বীকার করতে চায় না। কিন্তু  শাশুড়ি আর এই বউকে রাখতে চান না।

শেষ পর্যন্ত চেয়ারম্যানই সকলের একমাত্র ভরসা। কিন্তু সেই বিচার তো চেয়ারম্যান এখনো শেষ করেননি। ব্যবসার কাজে কাল সে খুলনায় যায় অথবা আজ বউ, ছেলে-মেয়ের টানে ঢাকায় যায়।

এভাবেই চেয়ারম্যান আজ সালিশ করবে, কাল সালিশ করবে করে করে ব্যস্ততায় দিন কাটিয়ে দিচ্ছে। শেষ পর্যন্ত আমরা এইটুকু আশ্বস্ত হতে পারি যে, এই ঘটনার একটি সালিশ দরবার তিনি আমাদের ঠিকই করে দেবেন।

আমার ধারণা অবশ্য একটু একটু করে বদলে যাচ্ছে। কেন জানি আমি অনেকের মতো অনেক কিছুই বিশ্বাস করতে পারি না। এমনকি আমাদের এই চেয়ারম্যানকেও না। চেয়ারম্যানের লোকজনের পরেই আমাদের কাছে আসে পুলিশ।

থানার বড়সাহেব শুধু নিষিদ্ধকালেই নয়, চেয়ারম্যানের লোকজনের মতো রোজ রাতেই আমাদের কাছে পুলিশ পাঠান। কখনো কখনো বড়সাহেব নিজেই দ্রুতগতির জলযানে চলে আসেন। তাদের দেখে পালাতে শুরু করি। কখনো কখনো পালিয়ে যাই আবার কখনো কখনো পালাতে পারি না। বড়সাহেব আমাদের কাছে এসে বলেন, ‘আজ রাতে তোদের এখানে বিশেষ অভিযান করতে এসেছি। আমার মাল বুঝিয়ে দে, নইলে তোদের বিপদ। আমি তোদের এখানে আসবো, আমাকে আমার মাল বুঝিয়ে দিবি আর যদি না আসি থানায় মাল পাঠিয়ে দিবি। এই হারামির বাচ্চারা তোরা নাকি মাল ঠিকমতো দিতে চাস না?’
‘না, স্যার। ঠিকমতোই তো আমরা পাঠাই দেই।’
‘আমি তো ঠিকমতো আমার ভাগের মাল পাই না। তোদের বিরুদ্ধে আমার পুলিশ তো আমার কাছে নালিশ দেয়, তোরা নাকি মাল দিতে চাস না?’
আমরা কেউ কেউ আমতা আমতা করে বলতে থাকি, ‘না, স্যার। আমরা ঠিকমতোই আপনার নামে মাল পাঠাই দেই।’
‘শোন। আজ তোদের হুঁশিায়ার করে গেলাম। পরে যদি ঠিকমতো আমার ভাগের মাল না পাই তাইলে তোদের সবাইকে পদ্মার রূপালি সোনা ভারতে পাচারের মামলায় লটকায়ে দেবো।’

আমরা থরথর করে কাঁপতে থাকি। মনে হয় তিনি যত দ্রুত চলে যাবেন, ততই আমাদের মঙ্গল। এখনকার বড়সাহেবের চেয়ে আগের বড়সাহেব অন্য প্রকৃতির মানুষ ছিল।

পুরনো বড়সাহেবকে তো আমরা যে নিজেরা মাল পছন্দ করে দিতাম, তিনি সেই মালই খেতেন। কিন্তু এখনের বড়সাহেব নিজে বেছে বেছে মাল খুঁজে নেন। তিনি যখন চলে যান তখন আমাদের মন ভেঙে যায়। আমরা সবাই বলতে থাকি, ‘শালা, বাইনচোদ কোথাকার। কত কষ্ট করে রাত জেগে জেগে গতর খেটে সোনা তুলি, সেই সোনা শালারা ছোঁ মেরে নিয়ে যায়।’

আমরা রাগে দুঃখে ক্ষোভে গজগজ করতে থাকি। আমাদের এই গজগজানি টুকুই সম্বল। আবার রাত জেগে সোনা তুলতে ব্যস্ত হয়ে পড়ি।

গভীর রাতে পদ্মার বুকে চাঁদের আলোয় আমরা যখন কচুরিফুলের মত ভেসে বেড়াই তখন কখনো কখনো আমার চোখের সামনে দলে দলে কচুরিপানা এসে ভাসতে থাকে। প্রতিটি পানাতেই ফুটে থাকে মুগ্ধতার কচুরিফুল। রং বেরঙের গোলাপ, গন্ধরাজ, হাসনাহেনা, রক্তকরবী, শিউলির চেয়েও কচুরিফুল আমায় বেশি মুগ্ধ করে।

চকচকে হালকা বেগুনি রঙের পাপড়িগুলোর কোনো কোনোটির মাঝে গাঢ় নীল রঙের নকশায় হলুদ ফোটাগুলো সৌন্দর্যের দ্যূতি ছড়িয়ে রাখে। কচুরিফুলের এতো বিচিত্র সৌন্দর্য মুগ্ধতার দৃষ্টিতে তাকিয়ে না দেখলে বোঝাই যায় না। সবুজ কচুরিপাতার মাঝে ঝাড়বাতির মত সৌন্দর্য ছড়িয়ে ফুটে থাকে। যেন চোখ জুড়িয়ে যায়।

আমার অবশ্য সেই শৈশবের শুরুতেই, যখন আমি স্মৃতি ধারণ করার ক্ষমতাপ্রাপ্ত হই, তখন থেকেই কচুরিফুল আমাকে মুগ্ধ করে রাখে।

নদীর বুকে স্রোতের টানে ঝাঁকে ঝাঁকে কচুরিপানায় মাথা উঁচু করে ফুলগুলো দুলতে দুলতে ছুটতে থাকে। যখন স্রোতের টানে ছুটতে থাকে, তখন এক একটি কচুরিপানা গায়ে গায়ে ধাক্কা খেতে খেতে ছুটতে থাকে। একদৃষ্টিতে তাকিয়ে দেখতে কী ভীষণ সুন্দর লাগে!

আবার কখনো কখনো সেই ফুলের ডানায় চিত্রল প্রজাপতিরা মনের সুখে ঢেউয়ের তালে তালে দুলতে থাকে। কচুরিফুলের ডানায় প্রজাপতির এমন সুখ দেখলে ঘরে থাকা আমার ময়নার কথা মনে পড়ে যায়।

আমার আশায় সারারাত ঘরে জ্বলেপুড়ে মেয়েটি একা একা কাটিয়ে দেয়। এই চাঁদজাগা রাতে পদ্মার বুকে ভেসে ভেসে কখনো আমার চোখে-মুখে ময়নার মুখ ভেসে উঠলে আমিও জ্বলতে থাকি।

আবার কখনো কখনো দুশ্চিন্তায় মগ্ন হয়ে যাই- ঘরে একা পেয়ে মুকুন্দের মতো কেউ কী আমার ময়না পাখিটিকে ফুসলিয়ে ফাসলিয়ে আদর করছে?

যে গল্প বলছিলাম। শুধু কী চেয়ারম্যান আর পুলিশই আমাদের ধাওয়ার উপরে রাখে, ব্যাপারটি কিন্তু তা নয়। দিন যত যায়, আমাদের রক্তচোষাদের দল তত বেশি হয়। এখন শুধু চেয়ারম্যান আর থানার বড়সাহেব নন। একে একে জুটেছে মান্নান ও লস্কর দস্যু বাহিনী।

মান্নান ও লস্করকে ছোটবেলা থেকেই দেখে আসছিলাম। আমি যখন ক্লাস ফাইভে পড়ি তখন এই লস্কর আমাদের সাথেই প্রাইমারি স্কুলে পড়তো। শেষপর্যন্ত লস্কর প্রাইমারির গণ্ডি পেরোলেও বেশি দূর এগিয়ে যেতে পারেনি। আমিও পারিনি। পড়াশোনায় খুব খারাপ ছাত্র হওয়ায় হাইস্কুলের পাঠ শেষ না করেই জীবনের প্রয়োজনে কাজে নেমে পড়েছি।

লস্কর ও মান্নানেরা রাতে পদ্মার বুকে যতদূর পর্যন্ত বন্দুক নিয়ে যেতে পারে, ততোটুকুই নাকি তাদের মালিকানা! আমরাও বোবা মানুষের মতো বেঁচে আছি। ওদের বিরুদ্ধে কিছু  বলতে পারি না।
 
আমাদের উপরে জুলুম করেই চলছে। আমরা মুখবুজে সব নিরবে সহ্য করেই যাচ্ছি। এই নিষিদ্ধ রাতে পদ্মার বুকে সারারাত ভেসে বেড়িয়ে আমরা যখন কিছু ছোট বড় রুপালি সোনার মুখ দেখি, তখনই ওরা এসে আমাদের নৌকায় হানা দেয়। আমাদের শ্রমের ফলাফল সব বন্দুকের মুখ ঠেকিয়ে নিয়ে যায়। আমরা সামান্য প্রতিবাদও করতে পারি না।

সন্ধ্যারাতের পর থেকেই দলে দলে এসে আমাদের শ্রমের বিনিময়ে পাওয়া সব চকচকে রূপালি সোনাগুলো নিয়ে যায়, আমরা তখন অনুনয়-বিনয় ছাড়া মুখ দিয়ে আর কোনো কিছুই বলতে পারি না। অথবা আমরা কোনো কিছু বলতে সাহস করতে পারি না।

আমার শুধু মাঝে মাঝে চিৎকার করে বলতে ইচ্ছে করে,‘আমি ওদের বিরুদ্ধে দাঁড়াবো। ওদের বন্দুক কেড়ে নিয়ে গুলি করে ঝাঁঝড়া করে দেবো ওদের বুক। আমি একদিন দাঁড়াবোই দাঁড়াবো।’

কিন্তু কখনোই আমি ওদের বিরুদ্ধে দাঁড়াতে পারি না। সেই সময় ও সুযোগ যদি কোনোদিন আমার সামনে এসে পড়ে, আমি অবশ্যই ওদের বিরুদ্ধে দাঁড়াবো। মনের ভেতরে এমন সুপ্ত আশা লালন করে আসলেও কবে কখন সুযোগ পাবো, আমি বলতে পারি না। যদি কোনোদিন সেই প্রতিশোধের পথ পেয়ে যাই, আমি নির্বিঘ্নে ওইপথে হেঁটে যাবো।

আমি আমার পূর্বপুরুষদের অপমান, লাঞ্ছনা, বঞ্চনা আর নির্যাতনের প্রতিশোধ নেবো। আমি আমার পরের প্রজন্মকে প্রতিশোধের পথ দেখাবো। যদি সুযোগ পেয়ে যাই আমি অবশ্যই ওদের বিরুদ্ধে দাঁড়াবো।

আধা পূর্ণিমার রাত। আমি দুইজন সহযোগীকে নিয়ে যখন পদ্মার বুকে চকচকে রূপালি সোনা তুলতে ব্যস্ত ঠিক তখনই লস্করের লোকজন এসে বললো,‘এই তোদের নৌকায় তোলা সব মালগুলো আমাদের ট্রলারে উঠিয়ে দে।’ আমরা বলে উঠলাম, ‘না, দেব না। আমরা একটিও মাল আর তোদের দেব না। আমাদের এই দুঃসময়ে সব যদি তোদের দিয়ে দেই, তাহলে আমাদের তো না খেয়ে মরতে হবে।’
‘তোরা না খেয়ে থাকলে আমাদের কী শালা।’ ওরা আমাদের নৌকায় হুড়মুড়িয়ে উঠে ইলিশভর্তি বাক্সগুলো নিয়ে যেতে লাগলো। আমরা ওদের বাঁধা দিতে থাকি। কিন্তু ওরা তো থামে না। আমাদের নৌকায় উঠে সব বাক্সগুলো নিয়ে যাচ্ছে, আমরা বাঁধা দিচ্ছি।

আমাদের মাঝে চলতে থাকলো ধাক্কাধাক্কি জোরাজুরি। আমরা কিছুতেই ওদের বাক্সগুলি নিয়ে যেতে দিচ্ছিলাম না। কিন্তু ওরা কিছুতেই আমাদের বাক্সগুলো ফিরিয়ে দিচ্ছিল না।

হঠাৎ বিকট গুলির শব্দ। আমি টের পেলাম আমার বুকেও একটি গুলি এসে ঢুকে পড়েছে। আমি আর কোনো কিছুই করতে পারি না। ক্রমেই আমার হাত পা মাথা অবশ হয়ে যাচ্ছে। আমি যেন আর দম নিতে পারছি না। কেমন করে যেন সবকিছু বদলে যেতে শুরু করলো অথচ আমি বুকের ভেতরে পুষে রাখা পুরনো ক্রোধ কিছুতেই জ্বলে উঠাতে পারছি না। হঠাৎ আমার চোখের সামনে ময়নার মুখ ভেসে ওঠে। আহা! কী মায়াময়ী মুখ।

তাকিয়ে দেখি, শুধু আমি নই, আমার দুই সহযোগীও নৌকার গলুইয়ের কাছে চিৎ হয়ে পড়ে গেছে। একে একে আমরা সবাই জলে পড়ে যাচ্ছি।

আমার খুব কষ্ট হচ্ছে। এতো ভারি কষ্ট যেন বুকটা ফেটে বেরিয়ে আসতে চাইছে। শুধু কী ময়নার জন্য কষ্ট পাচ্ছি, ছয় মাস পরে ময়নার কোল জুড়ে যে আসছে, তার জন্যও ভীষণ কষ্ট পাচ্ছি।

আধো চাঁদের আলোয় পদ্মার বুক আমাদের রক্তে লাল হয়ে উঠেছে। আমরা হয়তো কচুরিফুলের মতো স্রোতের টানে একে অন্যের গায়ে ধাক্কা খেতে খেতে ভেসে যাচ্ছি দূরে বহু দূরে। কোথাও কেউ নেই । শুধু পদ্মার জলে আমার ময়না নিরন্তর আমায় খুঁজে ফিরছে অথচ আমি তার ধারে কাছে কোথাও নেই।

এসইউ/এইচআর/পিআর

পাঠকপ্রিয় অনলাইন নিউজ পোর্টাল জাগোনিউজ২৪.কমে লিখতে পারেন আপনিও। লেখার বিষয় ফিচার, ভ্রমণ, লাইফস্টাইল, ক্যারিয়ার, তথ্যপ্রযুক্তি, কৃষি ও প্রকৃতি। আজই আপনার লেখাটি পাঠিয়ে দিন [email protected] ঠিকানায়।

আরও পড়ুন